এবারের উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া দুই কৃতী ছাত্র সংবাদমাধ্যমে তাদের সাফল্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আজকের দিনের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের বিরূপতার কথা জানিয়েছে৷ বলেছে, রাজনীতির নামে যে হানাহানি রক্তপাত চলছে, তা তারা পছন্দ করে না৷ তাই এই রাজনীতি থেকে তারা দূরে সরে থাকতে চায়৷
আদর্শহীন ভোটসর্বস্ব বড় দলগুলির অনৈতিক কার্যকলাপ ও এলাকা দখলের নোংরা রাজনীতি শুধু এই দুই কিশোরকেই নয়, বহু সংবেদনশীল বিবেকবান মানুষকেই রাজনীতি সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে৷ প্রসঙ্গত এই ছাত্ররা যেখান থেকে উঠে এসেছে, বর্তমান রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বীরভূম ও কোচবিহার জেলা সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকা জায়গাগুলির অন্যতম৷ খুন, পাল্টা খুন, ঘর জ্বালানো, অফিস দখল, হুমকি, দাদাগিরি, অসংযত কথাবার্তা, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার উদগ্র প্রয়াস, নিকৃষ্ট স্বার্থের প্রয়োজনে বিরোধী রাজনৈতিক দলে অবলীলায় মিশে যাওয়া– এই সমস্ত কিছুই রাজনীতিকে আজ নামিয়ে এনেছে ঘৃণ্য আবর্জনার স্তরে৷ সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বেশিরভাগ মানুষই এমন রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতে চান৷
কিন্তু এড়িয়ে চলতে চাইলেই কী এড়িয়ে চলা যায়? অর্থনীতি যেমন সমাজের ভিত্তি তেমনি রাজনীতিও তার অবিচ্ছেদ্য উপরিকাঠামো৷ ফলে চাইলেও রাজনীতিকে পরিহার করে কোনও মানুষের জীবন, কর্ম ও অবস্থান চলতে পারে না৷
রাজনীতি হল সমাজ পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি৷ আর সমাজ যেহেতু শোষক ও শোষিত এই দুই ভাগে বিভক্ত তাই এ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও দু’রকমের৷ একটি দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের প্রচলিত শোষণমূলক ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার, যা শাসক শ্রেণির রাজনীতি৷ এই রাজনীতির উদ্দেশ্য হল, সমাজের অধিকাংশ মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানে ব্যর্থ, পচন ধরা, মরতে বসা এই ব্যবস্থায় কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বিকাশের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে সেটাকেই একটু মেরামত করে এগিয়ে চলার ব্যবস্থা করা৷ এই মেরামতিতে সমাজকাঠামোর পচন রোধ করা সম্ভব হয় না৷ তাই রাজনীতি, নীতিনৈতিকতা, সংস্কৃতি আজ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে৷ আর রাজনীতির এই আদর্শহীন কুৎসিত রূপটি দেখে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠছে৷ হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা৷ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ৷ এর ফলে সুবিধা হচ্ছে শাসকদের৷ সমাজ মননের এই রাজনীতি বিমুখতা তারা টিকিয়ে রাখতে চায়৷ কারণ তাতেই তাদের শাসন–শোষণের আয়ুষ্কাল দীর্ঘায়িত হয়৷
এর বিপরীতে রয়েছে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি৷ সেটি হল প্রচলিত ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থাটির মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশের রাস্তাটি উন্মুক্ত করা৷ এই প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ প্রতিফলিত করে বলে একটি আদর্শবোধের জন্ম দেয়৷ যুগে যুগে সকল বড় মানুষই এই আদর্শবাদী রাজনীতির পতাকা বহন করেছেন৷ তাঁরা মানুষকে, বিশেষত ছাত্র–যুবশক্তিকে এই রাজনীতিতে আহ্বান করেছেন৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন৷ আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে, এমনকী স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছুদিন রাজনীতি একটি মহৎ কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে৷ রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সমাজের চোখে শ্রদ্ধার পাত্র৷ নেতাজি ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁর আহ্বানে ছাত্র–যুবশক্তি সেদিন দেশমুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ– অধ্যয়নই ছাত্র জীবনের তপস্যা– এই বচনের দোহাই দিয়ে ছাত্রদিগকে দেশসেবার কার্য হইতে নিরস্ত রাখিবার চেষ্টা অনেকেই করিয়া থাকেন৷ অধ্যয়ন কোনও দিন তপস্যা হইতে পারে না৷ অধ্যয়নের অর্থ কতকগুলি গ্রন্থ পাঠ ও কতকগুলি পরীক্ষা পাশ৷ ইহার দ্বারা মানুষ স্বর্ণপদক লাভ করিতে পারে– হয়তো বড় চাকুরি পাইতে পারে– কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করিতে পারে না৷’’ সেদিন তিনি ছাত্রসমাজকে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, চরিত্র এবং পৌরুষের বিকাশের জন্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রয়োজন৷ কর্মহীন চিন্তা চরিত্র গঠনের পক্ষে যথেষ্ট নয় এবং এই কারণে চরিত্রের বিকাশের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, শৈল্পিক ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর কর্মে যোগ দেওয়া প্রয়োজন৷ গ্রন্থকীট, সুবর্ণ পদকধারী এবং অফিসের করণিক উৎপাদনের প্রচেষ্টা করা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উচিত নয়– বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত চরিত্রবান মানুষ তৈরি করা…’’ (১৯ আগস্ট ’২৯,পাঞ্জাবী ছাত্র সম্মেলনে লাহোর অধিবেশনের ভাষণ)৷
কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা এল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে৷ কায়েম হল সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে মুষ্টিমেয় পুঁজিমালিক কর্তৃক দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষের উপর দমন–পীড়ন চালাবার পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা৷ যা ইতিমধ্যেই বিকাশের ক্ষমতা হারিয়ে মুমূর্ষু দশায় পৌঁছেছে৷ ধূলিসাৎ হয়ে গেল শত শত বীর শহিদ স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বপ্ন৷ ক্ষয়িষ্ণু প্রতিক্রিয়াশীল এই ব্যবস্থার হাত ধরে গোটা সমাজ কাঠামোতেই পচন ধরল৷ পচা–গলা এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে গিয়ে রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল চূড়ান্ত আদর্শহীন ক্ষমতালোভী কিছু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় নোংরা খেয়োখেয়ি আর লুটপাটের জায়গা৷ এই রাজনীতির প্রতি বিরাগের কথাই বলেছে ওই দুই কৃতী কিশোর৷ কিন্তু এটাই রাজনীতির একমাত্র ধারা নয়৷ আরও একটা ধারা তো পাশাপাশি রয়েছে, যেটি আজকের দিনের বিপ্লবী ধারা৷ যা রাজনীতির পচে যাওয়া ধারাটাকে পাল্টে নতুন ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে৷ সেটাকে চিনে নিয়ে শক্তিশালী করতে না পারলে, শুধু রাজনীতি বিমুখতার দ্বারা কার্যত পচে যাওয়া ধারাটিকে টিকে থাকতে সাহায্য করা হবে৷ আজকের দিনে রাজনীতি বিমুখ মানসিকতা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ কিন্তু বিরক্ত হয়ে এ থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে এই জঘন্য পরিস্থিতি পাল্টাবে না৷
উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই প্রবল দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করেছে৷ বাবা–মা, শিক্ষক–শিক্ষিকা বা অন্য কোনও সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্য তাদের এই জায়গায় পৌঁছতে সাহায্য করেছে৷ এই ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ভবিষ্যতের একটা সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে বিভোর হয়ে আছে৷ কেউ ডাক্তার হতে চাইছে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা গবেষক বা শিক্ষক হতে চাইছে৷ কিন্তু প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ এই পথ তারা কীভাবে অতিক্রম করবে– এই উদ্বেগ বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ তাদের সাহায্যের জন্য হাত পাততে হচ্ছে৷ এ সবই তো রাজনীতির সাথে যুক্ত! শিক্ষা তো মানুষকে সামাজিক সম্পদে পরিণত করে৷ কাজেই শিক্ষার দায়িত্ব সমাজেরই বহন করা উচিত৷ তা না হলে, ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ এই গণতান্ত্রিক স্লোগানটি অর্থহীন হয়ে যায়৷ আবার শিক্ষান্তে চাকরির সুযোগ মিলবে কি না, সেটাও অনিশ্চিত৷ কারণ, সাধারণ পিয়নের চাকরির জন্য পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও লাইনে দাঁড়িয়ে৷ শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি, দারিদ্র, বেকারি প্রভৃতি অন্তরায়গুলি দূর করতেও চাই রাজনীতি– বিপ্লবী রাজনীতি, যার ভিত্তি সঠিক নীতি–আদর্শ৷
দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বার্থে সঠিক নীতি আদর্শের ভিত্তিতে যথার্থ নেতৃত্বে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ এই বিপ্লবী রাজনীতিই পারে এইসব সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখানোর পাশাপাশি রাজনীতির নামে চলতে থাকা জঘন্য কার্যকলাপ বন্ধ করতে৷ এ দেশের বুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে লড়াই–আন্দোলনের সেই প্রকৃত রাজনীতির ঝান্ডা তুলে ধরেছে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যথার্থ মার্কসবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷ এই দলটির শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে জনজীবনের যাবতীয় সংকট দূর হওয়ার প্রশ্নটি৷
আজকের সংসদীয় ভোটবাজ রাজনীতির বিষময় প্রভাব দেখে রাজনীতিকে পরিহার করে চললে অসচেনতভাবে হলেও সেই বিষময়তার আবর্তেই নিজেদের আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলা হয়৷ সমাজজীবনের সমস্যাগুলির চরিত্র সঠিকভাবে অনুধাবন করে আদর্শভিত্তিক রাজনীতির চর্চাই মানুষকে তার নিজের কাছে এবং সমাজের কাছে প্রকৃত মানুষ হওয়ার গৌরবের অধিকারী করতে পারে৷