আগামী ২৪ এপ্রিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর তিয়াত্তরতম প্রতিষ্ঠা দিবস। দেশের শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ। প্রতিষ্ঠা দিবসকে সামনে রেখে তাঁর বত্তৃতার একটি মূল্যবান অংশ আমরা প্রকাশ করলাম।
‘‘… দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর আমি রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তার মধ্যে তিরিশটা বছর আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ দেশে একটা নতুন ধরনের দল, সত্যিকারের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী দল হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করেছি। বয়স আমার খুব বেশি হয়নি। কিন্তু, কর্মীদের তৈরি করার পিছনে, দলটা তৈরি করার পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি ইতিমধ্যেই অসুস্থ। কিন্তু, সে তো এ দেশে বিপ্লব গড়ে তোলার জন্যই। আমি লক্ষ করেছি, অসুবিধায় পড়লেই আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা খারাপ করে ফেলেন। অথচ, সকলে মিলেমিশে কষ্টের মধ্যেও শান্ত মেজাজে পরস্পরকে বুঝিয়ে শৃঙ্খলার সাথে কাজ করতে পারি– এ জিনিস শুধু যে আমাদেরই ক্ষমতা, সামর্থ্য এবং চরিত্র গড়ে তোলে তাই নয়, এ জনসাধারণকেও অনেক জিনিস শেখায়। এত কষ্ট, এত অসুবিধার মধ্যেও যতটুকু শৃঙ্খলা আপনারা দেখিয়েছেন, তাতে সিউড়ির মানুষ, বীরভূমের মানুষ একবাক্যে আপনাদের প্রশংসা করেছে। এমনকী পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যেও কথা হচ্ছে যে, তাদের মধ্যেও এতখানি শৃঙ্খলা নেই। তবু যতটুকু অসন্তোষ আপনাদের মধ্যে দানা বেঁধেছে, তা আমায় অত্যন্ত ব্যথা দিয়েছে।
আপনারা পশ্চিমবাংলার সমস্ত জেলা থেকে প্রচুর সংখ্যায় ডেলিগেট এসেছেন। একমাত্র পশ্চিম দিনাজপুর জেলা থেকে অল্প কয়েকজন ডেলিগেট এসেছেন। আপনাদের ওপর পশ্চিমবাংলার আগামী দিনের সংগ্রাম অনেকখানি নির্ভর করে। আমি আপনাদের কাছে ভারতবর্ষের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার বর্তমান পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অবস্থা কী– বিভিন্ন দলগুলো কী করছে, কী চাইছে, আর আমরা কী করছি, কী চাইছি– সেটা আপনাদের সামনে রাখব। আশা করব, এই সম্মেলনের উদ্দেশ্যকে আপনারা ব্যর্থ হতে দেবেন না। আপনারা আপনাদের কাজ করবার জন্য, সংগ্রামের জন্য মূল রাজনৈতিক লাইন এবং ধারা প্রচারের, কর্মের এবং সংগঠনের পদ্ধতি ও প্রোগ্রাম– এইসব এবং আপনাদের কর্তব্য-কর্ম বুঝে নিয়েই এ সম্মেলন থেকে ফিরে যাবেন। বৃষ্টিতে সমস্ত ভিজে যাওয়ার জন্য আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আবার বর্ষা এসে হয়তো আরও অসুবিধার মধ্যে আপনাদের ফেলবে। তবু আমি আশা করব, যাবার সময় একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আপনারা ফিরবেন যে, আপনাদের সামনে একটা যে চ্যালেঞ্জ এসেছে পশ্চিমবাংলায়, তার মোকাবিলা করার জন্য আপনারা সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
বাইরে আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতিতে অনেক পক্ষ দেখা গেলেও এবং কাগজগুলি অনেক পক্ষ দাঁড় করালেও, আমি মনে করি, মূল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে পক্ষ হচ্ছে মাত্র দু’টো– একটা বিপ্লব, আর একটা বিপ্লব-বিরোধিতা– সে যে নামেই হোক। কংগ্রেসের তরফ থেকেই হোক, তার রাজনীতির মাধ্যমেই হোক, বামপন্থার নানা ভেলকি দেখিয়েই হোক, গণতান্ত্রিক সমাজবাদের ‘নারা’ লাগিয়ে হোক বা দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার নানা স্লোগান এবং চটকদার রাজনীতির নামেই হোক– একটা বিপ্লব-বিরোধিতার রাজনীতি, আর একটা বিপ্লব গড়ে তোলার রাজনীতি।
এই বিপ্লব-বিরোধিতার রাজনীতি সচেতনভাবে হোক, অজ্ঞাতসারে হোক, না বুঝে হোক ফ্যাসিবাদ নিয়ে আসার পথ প্রশস্ত করেছে– যেমন, ইটালিতে ও জার্মানিতে বুদ্ধিজীবীরা, ছাত্র-যুবরা আত্মবিস্মৃত হয়ে ফ্যাসিবাদ আনতে কার্যত সাহায্য করেছিল। তারা বুঝে ফ্যাসিবাদ আনেনি। হিটলারের মিথ্যা প্রগতিশীল স্লোগানে, তার জাতীয় সমাজতন্ত্রের ধাপ্পাবাজিতে, মুসোলিনির গণতান্ত্রিক সমাজবাদের ধোঁকাবাজিতে, জাতীয়করণ ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের ধোঁকাবাজিতে বিভ্রান্ত হয়ে বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র-যুব সম্প্রদায় সেখানে ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করে বসল। ‘মনোপলিস্ট’দের টাকার কাছে তারা নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দিল। নাৎসি গুণ্ডাবাহিনীতে তারা দলে দলে নাম লেখাল। এতটুকু তাদের বিবেকে বাধল না। তাই দেখুন, সমগ্র ইউরোপের মধ্যে যে জার্মানি ছিল একদিন শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্পে, শ্রমিক আন্দোলনে সমস্ত দিক থেকে একটা ঐতিহ্যপূর্ণ শক্তিশালী জাতি, আজ নাৎসিবাদের পরিণতিতে সেই জার্মানি হতমান, দ্বিধাবিভক্ত। জগতে তার সেই গৌরব আর নেই। এই নাৎসিবাদ জার্মানির এবং দুনিয়ার কী ধ্বংসসাধন এবং ক্ষতিসাধন করে গেল– দুনিয়ার মানুষ যাকে একবাক্যে ধিক্কৃত করেছে, মানবতার চরম শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু ইটালিতে ও জার্মানিতে যখন এই ফ্যাসিবাদ এসেছিল, তখন কিন্তু সে এসেছিল প্রতারণার ছদ্মবেশে মায়াজাল বিস্তার করে। এসেছিল প্রগতি আর সমাজতন্তে্রর বিভ্রান্তিকর স্লোগানের আড়ালে।
ভারতবর্ষেও ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে সেই ফ্যাসিবাদ নিয়ে আসার চক্রান্ত চলছে। গত ২৪শে এপ্রিলের সভায় আমি একটা জিনিস বোঝাতে চেয়েছিলাম। আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, যারা আমাদের দেশের বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ‘স্মল প্রোডাকশন’ (ক্ষুদ্র উৎপাদন) এবং ‘স্মল পিজ্যান্ট ফার্মিং’ (ছোট ছোট খামার প্রথায় চাষবাস) পদ্ধতিকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে দেশের কৃষি সমস্যা এবং বেকার সমস্যার সমাধানের কথা বলছেন, তারা যে দল বা আদর্শেরই তকমাধারী হোন না কেন, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে দেশের অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদ গড়ে তুলতেই কার্যত সাহায্য করে চলেছেন। আর একটা জিনিস আমি সেদিনের সভায় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনসভা বিঘ্নিত হওয়ার জন্য আমি সেদিন তা পরিষ্কার করতে পারিনি। আমি সেদিন দেখাতে চেয়েছিলাম, গণআন্দোলনে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর ‘স্ট্র্যাটেজি’ (রণকৌশল) কী। কী কী কৌশল দিয়ে তারা নিজেদের দলের কর্মী এবং সমর্থকদের– যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয়, তাদের বিভ্রান্ত করছে, জনতাকেও বিভ্রান্ত করছে এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা তাদের সমস্ত কার্যক্রমের দ্বারা শুধু ইলেকশন রাজনীতির আন্দোলনকেই শক্তিশালী করছে। তাদের এই রাজনীতি পুঁজিবাদকে কোনও দিক থেকেই দুর্বল করতে পারে না এবং শেষপর্যন্ত বিপ্লবের শক্তিকেও জন্ম দিতে পারে না। যাকে আমরা জনতার রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া বলি, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা অক্ষম।
আমি জনতার এই রাজনৈতিক শক্তি বলতে গ্রামে গ্রামে ও শহরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জনসাধারণ ও যুবশক্তিকে নিয়ে তেমন ধরনের সচেতন সংগ্রামশীল কমিটি গড়ে তোলার কথা বলছি, যারা মাথা খাটিয়ে সমস্ত রকমের কাজ বিপ্লবী গণলাইনের ভিত্তিতে নিজেরাই সামাল দিতে পারে, ঝক্কি সামাল দিতে পারে। যারা জনতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে– দাপটে নয়, পুলিশের শক্তির সাহায্যেও নয়, গুন্ডামির সাহায্যেও নয়– করে স্বকীয় গুণ, ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাভাবনার দ্বারা, চরিত্রের দ্বারা, সংগঠন শক্তির দ্বারা। যারা সমস্ত বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নিজেদের কাজ সামাল দিতে পারে– আমি তেমন ধরনের কার্যকরী, রাজনৈতিকভাবে সচেতন শক্তিশালী গণকমিটি গ্রামের স্তর থেকে জাতীয় স্তর পর্যন্ত গড়ে তোলার কথা বলছি। কারণ, বিরুদ্ধ শক্তির দিক থেকে বাধাবিপত্তি কখন কীভাবে আসবে সব সময় জানা যায় না। অনেক বুদ্ধি থাকলে কিছু কিছু হয়তো ধরা যায়। কিন্তু, বিরাট জ্ঞানী হলেও সমস্ত ‘অচানক’ আক্রমণ ধরে ফেলা যায় না। এরূপ অবস্থার সামনে সব সময়ই বিপ্লবী আন্দোলনকে পড়তে হয়। তাই বিপ্লবী সংগঠকদের ব্যক্তিগতভাবে এবং কমিটিগতভাবে এইরকম উপযুক্ত ক্ষমতা থাকা দরকার– যারা যে কোনও অবস্থার সামনে মাথা খারাপ করে, তর্কাতর্কি করে, গোলমাল করে কাজ নষ্ট করে দেয় না।
(‘ভারতবর্ষের গণআন্দোলন ও যুবকদের কর্তব্য’ ২১ জুন, ১৯৭৫ পশ্চিমবাংলার সিউড়িতে অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনের ভাষণ থেকে)