যে দেশে কেন্দ্রীয় সরকার রেলের উন্নতি বলতে স্টেশনে শপিং মল তৈরি, ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক বেচে ব্যবসা করা বোঝে, যাত্রী পরিষেবার উন্নতি বলতে বোঝে ট্রেন থেকে স্টেশন, লাইনের ধারের জমি সহ সব সম্পত্তি একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের হাতে বেচে দেওয়া–সে দেশে রেলযাত্রায় সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার হাল কী হতে পরে তা আর একবার বুঝিয়ে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের দোমোহনিতে ১৩ জানুয়ারির ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা আবার দেখিয়ে দিল রেলযাত্রী এবং জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে সরকার কতটা উদাসীন। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নিজেই যা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় যাত্রীবাহী ট্রেনগুলির রক্ষণাবেক্ষণের হাল কতটা শোচনীয়।
রেলের রক্ষণাবেক্ষণের দশা কতটা বেহাল হলে একটা এ’প্রেস ট্রেনে এমন লজঝড়ে ইঞ্জিন জোড়া হতে পারে যে, তার যন্ত্রাংশ খুলে ঝুলতে থাকে! উত্তরবঙ্গে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ারে কয়েক বছর আগেই ওভারহেড বিদ্যুৎ লাইন চালু হয়েছে। অথচ নিউজলপাইগুড়ির মতো বড় স্টেশনে এমনকি আলিপুরদুয়ার ডিভিশনের কোথাও বিদ্যুৎ চালিত ইঞ্জিনের মেরামতি বা খরাপ ইঞ্জিন বদলে দেওয়ার মতো পরিকাঠামোটুকুও গড়ে তোলেনি রেল কর্তৃপক্ষ। রেলমন্ত্রী নাকি ফটোগ্রাফারদের সাক্ষী রেখে একেবারে ইঞ্জিনের তলায় ঢুকে পরীক্ষা চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে তাঁর পরিচালিত রেলে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ খুলে পড়ে গিয়েই ট্রেন বেলাইন হয়েছে। জনসাধারণ এবং রেলযাত্রীদের প্রতি নূ্যনতম দায়বদ্ধতা থাকলে এরপর রেলমন্ত্রীর মুখ লুকানোই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গেল তিনি তাঁর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মতোই নির্লজ্জ। গঙ্গায় শত শত মানুষের লাশ ভাসতে দেখেও প্রধানমন্ত্রী যেমন উন্নয়নের বাণী দেন ক্যামেরার সামনে। রেলমন্ত্রীও তাই করলেন।
অথচ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় বসার পর থেকে পূর্বতন কংগ্রেসের মতোই ট্রেনের টিকিটের উপরে সেফটি সারচার্জ, ডেভলপমেন্ট সারচার্জ বসিয়ে চলেছে। ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের এক রেলপ্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতিদিন রাতে তিনি শতাধিক বছরের পুরনো রেল ব্রিজগুলি নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি যে সত্যিটা বলেননি, রেলযাত্রা সাধারণ যাত্রীদের কাছে প্রতিদিনের দুঃস্বপ্নের বিষয়ই হয়ে উঠেছে। এর সুরাহা করার জন্য তাঁরা কী করেছেন? তাঁরা রেল লাইন, ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের কাজের বেশিরভাগটাই তুলে দিচ্ছেন বেসরকারি ঠিকাদারদের হাতে। রেলের অভিজ্ঞ স্থায়ী গ্যাংম্যান, লেভেল ক্রশিংয়ের গেটম্যানরা তাঁদের এলাকার লাইনকে নিজের হাতের তালুর থেকেও বেশি চিনতেন। সেই কর্মীদের বদলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চুক্তি ভিত্তিক ঠিকাদার দিয়ে এইসব কাজ করাবে। সাড়ে তিনলক্ষের বেশি অভিজ্ঞ কর্মী, যাঁরা নিরাপদ রেলযাত্রার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতেন, তাঁদের জোর করে অকালে ভিআরএস নিতে সরকার বাধ্য করেছে।
এখন চলছে স্টেশন ডেভলপমেন্টের নামে সেগুলিকে বেসরকারি কোম্পানির হাতে বেচে দেওয়ার কাজ। স্টেশনে বড় বড় কোম্পানিকে ব্যবাবসার সুযোগ করে দিলেই নাকি উন্নয়ন হবে! এই উন্নয়নের অজুহাতে সাধারণ যাত্রীদের টিকিটের উপর ১০ থেকে ৫০ টাকা চার্জ বসেছে। কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার রেল কোচ তৈরির কারখানাগুলিকে করপোরেট কোম্পানিতে পরিণত করেছে যাতে এগুলি বেচা যায়। ইঞ্জিন তৈরির কারখানাগুলিকেও একদিকে বেসরকারি হাতে বেচতে চাইছে অন্যদিকে রেলের নিজস্ব কারখানায় উন্নত মানের ইঞ্জিন বানানোর পরিকাঠামোকে দুর্বল করে বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আমদানি করছে। এতে নেতা-মন্ত্রীদের কাটমানি খাওয়ার সুযোগ বাড়লেও যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তা যে এতটুকু বাড়েনি তা একের পর এক দুর্ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং রেলমন্ত্রী একাধিক বেসরকারি ট্রেন চালু করে তার গুণগান করে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা গল্প শোনাচ্ছেন বেসরকারি তেজস এক্সপ্রেসের মতো অত্যাধুনিক ট্রেন অতিদ্রুত ছুটবে, তার জন্য বিশেষ রেললাইন পাতা হবে। প্রধানমন্ত্রী বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন ফেরি করছেন। রেল নাকি একেবারে অত্যাধুনিক সব কোচ বানাচ্ছে, যাতে দুর্ঘটনা হলেও একটি কোচ অপরটির মধ্যে ঢুকে গিয়ে মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটবে না। অথচ দোমোহনীর ঘটনায় দেখা গেল রাজস্থান থেকে গৌহাটি এইরকম বিশাল দূরত্বের একটি এ’প্রেস ট্রেনে ব্যবহার করা হয়েছে মান্ধাতার আমলের কামরা এবং বহু পুরনো লজঝড়ে ইঞ্জিন। রেলমন্ত্রী নিজেই যে ইঞ্জিনের ‘গুণমানের’ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ রেলের কর্মীরাই জানাচ্ছেন, আধুনিক প্রযুক্তির কোচ রেলের হাতে আছে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ সাধারণ যাত্রী যে সমস্ত ট্রেনে যাতায়াত করেন সেগুলিতে এই সমস্ত আধুনিক প্রযুক্তির কোচ ব্যবহারে কেন্ত্রীয় সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষ আদৌ ইচ্ছুক নন। রেল জোনগুলিতে কিছু আধুনিক কোচ দেওয়া হলেও তার বেশিরভাগটাই বাতানুকুল। স্লিপার ক্লাস, দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য আধুনিক কোচ প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে অধিকাংশ যাত্রী কার্যত প্রাণ হাতে করেই যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রেলের কোচ রক্ষণাবেক্ষণের স্তরে স্তরেও স্থায়ী কর্মীর বদলে ঠিকা কর্মী দিয়ে কাজ, আউট-সোর্সিং এবং বেসরকারিকরণ শুরু হয়েছে। একদল স্বার্থান্বেষী এবং করপোরেট সংবাদমাধ্যম প্রচার করে, এতেই উন্নয়ন হবে, কাজের প্রতি কর্মীদের দায়বদ্ধতা বাড়বে। দোমোহনীর দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিল সরকারের এই নীতি জনগণের জীবনের ক্ষেত্রে কতটা বিপজ্জনক।