রং বদলায়, দিন বদলায় না

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীন স্বশাসিত সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ পপুলেশন সায়েন্স’ এর তথ্য বলছে শুধুমাত্র আরবের নানা দেশে কর্মরত যে ভারতীয় শ্রমিকরা এই অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে আসতে পারছেন না, সেই সংখ্যাটা প্রায় ২৯ হাজার (সূত্রঃ আনন্দবাজার, ১৩-৫-২০২৪)। শুধু বিদেশে কর্মরতরাই নয়, দেশের মধ্যে যারা অন্য রাজ্যে কর্মরত, তাঁদের একটা বড় অংশও ভোট দিতে আসেনি। তথ্য বলছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট দিতে ঘরে আসতে পারেন না নির্বাচনের সময়। ২০১৯ সালে এইভাবেই ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছেন এক কোটিরও বেশি শ্রমিক।

এই পরিযায়ী শ্রমিকরা কি ভারতের নাগরিক নন? রাষ্ট্র, সরকার– কতটুকু স্বীকৃতি দেয় এঁদের? এ দেশ ঠিক কতখানি তাঁদের, কোভিড অতিমারির সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন ওঁরা।

দেশ জুড়ে, দেশের বাইরে প্রান্তে প্রত্যন্তে ছড়িয়ে থাকা এই শ্রমজীবী মানুষগুলো ভেবেই পাচ্ছিলেন না, কোনও আগাম ব্যবস্থা ছাড়া এমন রাতারাতি লকডাউন ঘোষণা করে তাঁদের ঘরে ফেরার সব পথ বন্ধ করে দিতে পারে তাঁদেরই দেশের সরকার। রোগ-ব্যাধি নিয়ে চিন্তা করার সময়টুকুও ছিল না, আতঙ্কে দিশেহারা অবস্থায় নিরুপায় হয়ে কেউ হাঁটতে শুরু করেছেন মাইলের পর মাইল, কেউ কোলের শিশু সন্তানকে ট্রাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে নিজে কোনওমতে ঝুলে পড়েছেন ট্রাকের পিছনে, কেউ খাবার আর জলের অভাবে বা পথশ্রমে অসুস্থ হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেছেন। সে দৃশ্য মর্মান্তিক!

পেটের দায়ে ভিনরাজ্যে এমনকি ভিনদেশেও পাড়ি দিতে হয় তাঁদের, ঘরবাড়ি স্ত্রী-সন্তান-পরিবার ছেড়ে অথবা সপরিবারেই। হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনে ওঁদের ভয়াবহ অবস্থার ছবি তখন উঠে আসত প্রতিদিনের সংবাদপত্রে। একদল শ্রমিককে রাস্তায় বসিয়ে পাইপ দিয়ে তাঁদের শরীরে জীবাণুনাশক স্প্রে করছে পুলিশ, কোনওমতে নাকমুখ ঢেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। মহিলা, শিশু সহ একদল শ্রমিক হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছেন নির্জন রেললাইনে, রাতের অন্ধকারে তাঁদের পিষে দিয়ে যাচ্ছে মালবাহী ট্রেন। মা যে আর বেঁচে নেই এ কথা বুঝতে পারেনি একরত্তি ছেলে, প্ল্যাটফর্মে মৃত শ্রমিক মায়ের শরীর থেকে বারবার চাদর তুলে তাঁকে জাগাতে চাইছে সে। তেলেঙ্গানা থেকে ছত্রিশগড় হেঁটে আসার পথেই ঝরে গেল বারো বছরের মেয়ে জামলো মকদম, মায়ের কোলে আর ফেরা হয়নি তার।

সভ্যতার ইমারত গড়া হয় যাঁদের শ্রমে, করোনাকালে তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের এই নিদারুণ অমানবিকতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, এই দেশে এই সমাজে শ্রমিকদের অবস্থান আসলে কোথায়। কতজন পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই সময়! কতজনের কাজ গিয়েছিল! ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠায়, ২০২০-র সেপ্টেম্বরে শ্রমমন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী লোকসভায় সটান বলে দিলেন– এসব তথ্য জানা নেই তাঁদের। অর্থাৎ সুরক্ষা দেওয়া তো দূরের কথা, এই হাজার হাজার মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের তথ্য-পরিসংখ্যান রাখারও প্রয়োজন মনে করেনি বিজেপি সরকার। হয়তো ইচ্ছে করেই রাখেনি নিজেদের সীমাহীন অপদার্থতা চাপা দিতে। চূড়ান্ত অব্যবস্থার মুখে পড়ে মহিলা-শিশু সহ এতগুলো মানুষের মৃত্যুর পরেও কি নড়েচড়ে বসেছিল সরকার? কোনও পদক্ষেপ নিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার সুরাহা করতে?

২০২১ সালে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময় ‘সোয়ান’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার করা সমীক্ষা বলছে, ৮২ শতাংশ শ্রমিকের কাছে পড়েছিল দু-দিন পেট চালানোর মতো রেশন, ৭৬ শতাংশ-এর হাতে খরচ করার মতো ছিল কমবেশি ২০০ টাকা, ৯২ শতাংশ শ্রমিক তখনও মালিকের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থের কানাকড়িও পাননি আর ৫৬ শতাংশ শ্রমিক তখনই কাজ হারিয়ে বসে আছেন এক মাসেরও বেশি (সূত্রঃ দ্য ওয়ার, ১৯.৭.২০২৩)। অথচ, এ কথা আজ সবাই জানেন, ওই সময় পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন এইভাবে প্রাণ হাতে করে ক্ষতবিক্ষত পায়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটছেন, অক্সিজেনের অভাবে চিকিৎসার অভাবে শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, ঠিক তখন কয়েকশো গুণ বেশি মুনাফা কামিয়েছেন দেশের ধনকুবের পুঁজিপতিরা। বিশ্বের ধনীর তালিকায় প্রথম দশে নতুন করে উঠে এসেছেন বেশ কিছু ভারতীয় শিল্পপতি, যাঁদের সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গভীর বন্ধুত্ব এবং ‘আদান-প্রদান’ সর্বজনবিদিত। তাদের সমস্ত সেবা এবং দায়বদ্ধতা তুলে রাখা থাকে আম্বানি-আদানিদের জন্য, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছয় না।

দেশ জুড়ে ক্রমাগত বাড়ছে দারিদ্র, কর্মহীনতা, অপুষ্টি, ক্ষুধা, বৈষম্য। এই ক’বছরে কতটা পাল্টেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন? ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে এমএনরেগা প্রকল্পে একশো দিনের কাজের জন্য বরাদ্দ ৩৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে সরকার, একের পর এক শ্রমিকবিরোধী আইন গায়ের জোরে পাশ করিয়েছে লোকসভায়। ২০১৩, ২০১৯,২০২৩ এ তিন তিনবার যমুনা নদীর জল বিপদসীমা পেরিয়ে উপচে পড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দিল্লির কয়েকশো পরিযায়ী শ্রমিকের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। চতুর্দিকে এই অনিশ্চয়তার অন্ধকার যত বাড়ছে, শ্রমিকরাও রুজিরুটির তাগিদে আরও মরিয়া হচ্ছেন, একটা বিরাট সংখ্যক শ্রমিক প্রতি বছর দেশ ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন আরব-ইউরোপ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। কতজন এভাবে চলে যাচ্ছেন? কতজনের আর জীবনেও ফেরা হচ্ছে না নিজের দেশের ভোটে? বিগত কাতার বিশ্বকাপের প্রস্তুতিপর্বে মৃত প্রায় ২৫০০ শ্রমিকের মতো কতজনের মৃত্যু হচ্ছে প্রিয়জনের থেকে বহুদূরে বিদেশের মাটিতেই? নাঃ, আজও এসবের সঠিক হিসেব নেই সরকারের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ যাঁদের বলেছিলেন ‘সভ্যতার পিলসুজ’, তাঁদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সরকার বা নির্বাচন কমিশন কারও তরফেই কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না। শ্রমিক সুরক্ষার আরও হাজার আইনের মতোই নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকারটুকুও ওই খাতায়-কলমেই আটকে থাকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। ২০২০-র লকডাউনে রেললাইনে পড়ে থাকা রক্তমাখা রুটি, ২০২৩-এ সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে আটকে মৃত্যুর আতঙ্কে প্রহর গোনা বা ২০২৪ এ খড়গপুরের কারখানার সুরক্ষাবিহীন ব্যবস্থায় বহুতল থেকে পড়ে শেষ হয়ে যাওয়া–এই হল আজকের ‘গণতন্ত্রে’ শ্রমিকের পাওনা, প্রান্তিক মানুষের জীবন।

অথচ সরকার এঁদের সমস্যা দূর করার কথা ভাবে না। পাঁচ বছরের আন্তর ভোট হয়। নতুন সরকার আসে, পুরনো সরকার যায়! সরকারের রং বদলায়। বদলায় না শুধু এঁদের দুঃখের জীবন।