যোগ্যদের চাকরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে

কোচবিহার

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চাকরিহারা শিক্ষিকা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। পিতৃসম প্রিয় শিক্ষককে আঁকড়ে ধরে ছাত্রী কাঁদছে। নিজেদের স্কুলের প্রিয় দশ জন শিক্ষকের চাকরি-বাতিলের বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিলবের করছে ছাত্র-ছাত্রীরা। কোথাও আবার ছ’বছর ধরে নির্ভর করে রয়েছেন যে তরুণ শিক্ষকদের উপর, তাদের ভূমিকার কথা স্বীকার করে চোখের জল আটকাতে পারছেন না প্রধান শিক্ষক। রাজ্যের সর্বত্রই চোখের জল ফেলতে ফেলতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রিয় স্কুল ত্যাগ করতে দেখলেন বঙ্গবাসী। দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক শিক্ষিকা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। ছেলে-বৌমার চাকরি নেই এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে মারা গেলেন মা। এমন এক বিপর্যয়ের বহুবিধ ঘটনার সাক্ষী রইল বাংলা। যদিও ২৫ হাজার ৭৫২ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি গেলেও যারা দুর্নীতি করল তাদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থার কথা শোনা গেল না!

এর ফল ভয়াবহ এক সংকট। সংকট শুধু ওই শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের পরিবারে নয়, গোটা রাজ্যের স্কুলশিক্ষাতেই এ এক মারাত্মক বিপর্যয়। দু-একটা উদাহরণ দিলে ভয়াবহতাটা স্পষ্ট হবে– মুর্শিদাবাদের অর্জুনপুর হাইস্কুলের ৬৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩৬ জনের চাকরি চলে গেল। আবার ধূপগুড়ির ঘোষপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক সংখ্যা শূন্য হয়ে গেল। রাজ্যের প্রায় ৩১২৫টি বিদ্যালয়ে এই চাকরি বাতিলের প্রভাব পড়ল। পঠন-পাঠন কী ভাবে চলবে– মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। আগামী দিনে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগ। হিসাব বলছে, নবম দশম শ্রেণিতে ১২,৯৪৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার, একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে ৫,৭৫৬ জন, গ্রুপ সি পদে ২,৪৮৩ এবং গ্রুপ ডি পদে ৪,৫৫০ জনের চাকরি বাতিল হল। এমনিতেই রাজ্যে দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ নেই। স্কুলগুলিতে হাজার হাজার শূন্য পদ। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। এমন একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা, অথচ রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি খুঁজে বার করার দায়িত্বে থাকা সিবিআই অফিসাররা, আদালতে সকলের চাকরি বাতিলের জন্য সওয়াল করা সাংসদ-আইনজীবী থেকে শুরু করে বিচারপতি পর্যন্ত কেউই কিন্তু এই ঘটনার দায় নিতে নারাজ। নিঃসন্দেহে এর প্রথম দায় বর্তায় তৃণমূল সরকারের উপর। রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬-র প্রথম স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্টে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে তা দিনের আলোর মতো সত্য। লক্ষ লক্ষ টাকায় চাকরি বিক্রি হয়েছে।প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি, তৃণমূল কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মী সরাসরি এই দুর্নীতিতে যুক্ত, তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। এই পরীক্ষায় ওএমআর শিট কারচুপি, ব়্যাঙ্ক জাম্পিং, সাদা খাতায় চাকরি, এসএসসি-র সুপারিশ ছাড়াই নিয়োগ, প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরে নিয়োগ, প্যানেলে নাম না থাকলেও নিয়োগ ইত্যাদি ভুরিভুরি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যে অভিযোগ রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তর এবং এসএসসিও অস্বীকার করেনি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরের সভায় যোগ্য অযোগ্যর ভাগটা কিছুটা গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রথমে যোগ্যদের চাকরির ব্যাপারটা দেখব বলে প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করলেন একদল অযোগ্য লোক এতদিন শিক্ষকতার চাকরি করছিলেন। এর মানে দাঁড়ায়, রাজ্য সরকারই দুর্নীতির পথে এদের নিয়োগপত্র দিয়েছে! তাহলে তাঁর সরকারের শিক্ষা দপ্তর এবং দলীয় বশংবদদের দ্বারা পরিচালিত এসএসসিকে তিনি প্রশ্ন করেননি কেন কাদের মদতে প্রায় ৬ হাজার অযোগ্য লোক শিক্ষাক্ষেত্রে ঢুকে পড়ল? আর কেউ না জানুক, তৃণমূল কংগ্রেসের ছোট-বড় নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতারা তো অবশ্যই জানতেন কারা টাকার বিনিময়ে চাকরি বেচেছে এবং কারা কিনেছে! এর জবাব তো প্রশাসন এবং শাসক দলের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে হবে। একই ভাবে জবাব দেওয়ার দায় বর্তায় শিক্ষামন্ত্রীর ওপর। কিন্তু যে শিক্ষামন্ত্রী স্কুলে ছুটি দেওয়ার মতো একটা সাধারণ সিদ্ধান্তও নিজের দায়িত্বে নিতে পারেন না, এ ক্ষেত্রে তিনি যে মুখ্যমন্ত্রীর আড়ালেই মুখ লুকোবেন তা অজানা নয়।

নেতাজি ইন্ডোরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের বলেছেন, আপনারা স্কুলে গিয়ে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ দিন। আর বলেছেন সরকার সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ চাইবে। এই কথা বলবার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর এতবড় সভা ডাকানোর দরকার ছিল কি? তাঁর মুখ রক্ষায় তিনি একটা বক্তব্য রাখলেন, কিছু বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে স্তাবকতা করালেন। চাকরিহারা শিক্ষকদের নিয়ে এই প্রহসনের কী প্রয়োজন ছিল? তিনি তো স্পষ্ট করে বললেন না, যোগ্য হয়েও দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত যাঁরা, তাঁদের নিয়ে সরকার কী করবে! তাঁর দলের যারা দুর্নীতি করেছে তাদের শাস্তির জন্য তিনি কতটা আন্তরিক চেষ্টা করবেন, তাও জানালেন না! মানুষ তো আজ এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর চাইছে! বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা দিনের পর দিন রোদে পুড়ে জলে ভিজে ধরনা চালিয়ে গেছেন এই কলকাতাতেই। যে মুখ্যমন্ত্রী আজ এত ‘মানবিক’ হচ্ছেন, তিনি একবারও তাঁদের ডেকে কথা বলেছেন এতগুলো বছরে?

২০১৬-র প্যানেলে দুর্নীতির অভিযোগে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল। পরে রঞ্জিত বাগ কমিটি গঠন হয়। তার রিপোর্টের পর সিবিআই তদন্ত চলতে থাকে। এরপর ২০২৪-এর ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এই প্যানেল সম্পূর্ণ বাতিল করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ভুক্তভোগী চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এবং মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি (এসটিইএ) সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ ৭ মে ২০২৪ অন্তবর্তীকালীন স্থগিতাদেশদেয়। পরবর্তী শুনানি চলাকালীন দেশের তাবড় তাবড় আইনজীবীদের সওয়ালের পরেও বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও সঞ্জয় মিশ্রের বেঞ্চ এই প্যানেল বাতিলের রায় দেন। যার পরিণতিতে এই অচলাবস্থা। এসএসসি-র দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিবিআই ৬,২৭৬ জনকে ‘টেন্টেড’ (কালি মাখা) বলেছে। এদের গায়ে যে দুর্নীতির কালি লেগে আছে তা আদালতের রায়ে এদের বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশেই স্পষ্ট। বাকিদের তিন মাস বাদে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বললেও সুপ্রিম কোর্ট এদের অস্বচ্ছভাবে নিযুক্ত বলেনি। তবে বলেছে, এর মধ্যেও কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মিশে থাকতে পারে। এই সন্দেহের ভিত্তিতেই এত মানুষের চাকরি বাতিল হয়েছে। আদালত বলেছে, এমনভাবে দুর্নীতির প্রমাণকে ঢাকা দেওয়া হয়েছে যে তার থেকে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ নিয়োগ আলাদা করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই তাঁরা বাতিল করে দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে পুরো প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতির শিকার। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, যে সব সরকারি কর্তা এবং শাসক দলের নেতা দুর্নীতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে পরিণত করেছেন, তাঁরা ধূর্ততার সাথে দুর্নীতি ঢাকা দেবেনই। বিচারব্যবস্থার কাজ তো ছিল এই দুর্নীতি চক্রের হদিশ বার করে তা ভাঙা! তাঁদেরই তো কর্তব্য তদন্তকারী সংস্থাকে বাধ্য করা দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে। এ ক্ষেত্রে সিবিআই এবং আদালত উভয়েই এই কঠিন দায়িত্বটি পালনে ইচ্ছুক নন অথবা অপারগ বলে কি তার দায় নিতে হবে নিরপরাধ হাজার হাজার শিক্ষককে? ‘শত অপরাধী ছাড়া পাক একজন নির্দোষও যেন শাস্তি না পায়’– ন্যায়বিচারের এই মূল নীতিটিও কি চাকরিহারাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? আদালত তো এঁদের দোষী বলেনি, তবু শাস্তি এরাই পাবেন! গণতান্ত্রিক দেশের বিচারব্যবস্থার এই তবে মহিমা!

সংবাদমাধ্যমে দেখা গেল, একদা এই বিষয়ে যিনি বিচার করেছিলেন, সেই প্রাক্তন বিচারক এবং বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সিবিআই যে মাদার ডিস্ক উদ্ধার করেছিল, সেখানে সব ওএমআর শিট রয়েছে। তা প্রকাশ করুক। এসএসসি বলুক ওইগুলিই আসল। তাহলেই অযোগ্যদের বোঝা যাবে এবং যাঁরা যোগ্য তাঁদের আর পরীক্ষায় বসতে হবে না’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ এপ্রিল ২০২৫)। এটা যদি জানাই ছিল, অভিজিতবাবু তাঁর নেতা প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই কথা বলবার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেওয়ার আর্জি জানাননি কেন? তিনি নিজেও তো সুপ্রিম কোর্টকে এই তথ্য সরবরাহ করতে পারতেন। করলেন না কেন? নাকি অপেক্ষা করছিলেন, সব এলোমেলো হয়ে যাক তাতে তাঁর দলের ভোটে ফয়দা হবে, এ জন্য? তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের সাথে এঁরাও কি তা হলে সমান ভাবে ২৬ হাজার মানুষের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী নন? এর সাথে বলতে হয় সিপিএম-এর রাজ্যসভা সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের কথা। তিনি আগাগোড়া লড়ে গেছেন পুরো প্যানেলটাকেই বাতিল করতে।

হাজার হাজার অসহায় দিকভ্রান্ত চাকরিহারাদের যন্ত্রণাকে নিয়ে ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলো। এদের অনেকেই জল্লাদের মতো উল্লাস করছেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, ২০২৬ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এলে তাঁরা নাকি এই চাকরিহারাদের কথা ভাববেন! তা হলে ত্রিপুরায় সিপিএম আমলে কোর্টের রায়ে চাকরি যাওয়া ১০ হাজার শিক্ষকের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় বসার পরেও তাদের সরকার সেই প্রতিশ্রুতি রাখল না কেন?

যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বহাল রাখার দাবির আন্দোলনকে শুরু থেকেই সর্বতোভাবে সমর্থন জানিয়েছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের গত বছর থেকে টানা আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে এই দল। এই প্যানেল বাতিলের রায় ঘোষণার দিনেই ৩ এপ্রিল রাজ্যের সর্বত্র এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-এর ডাকে গণ আইনঅমান্যের প্রধান দাবি হয়ে ওঠে– যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরির দায়ভার রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে। রাজ্যের সর্বত্র এই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হচ্ছে।

আজ প্রয়োজন এই চাকরিহারা যোগ্য প্রার্থীদের সাথে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। একমাত্র এই পথেই সরকার তথা বিচারব্যবস্থা, সিবিআই-এর মতো তদন্তকারী সংস্থাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথার্থ সক্রিয় হতে ও যোগ্যদের চাকরি বিনা শর্তে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা যাবে।