নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি আজ অস্বাভাবিক স্তরে পৌঁছেছে। গত এক বছরে ডালের দাম ২১.৯৫ শতাংশ, আনাজের দাম ৩২.৪২ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম ৫৮.০৫ শতাংশ এবং আলুর দাম ৬৪.০৫ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যা খান, সে সবের দামে যেন আগুন লেগেছে। ভোট মিটতে না মিটতেই এমনকি দুধের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাড়িতে শিশু ও অসুস্থ মানুষ থাকলে দুধ ছাড়া চলে না। এ দিকে সমীক্ষার পর সমীক্ষা দেখাচ্ছে, সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। এই অবস্থায় কী করে সংসার চলবে, কী ভাবে পরিবারের সদস্যদের দুক্সবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হবে– এ কথা ভেবে মানুষ জেরবার।
গত কয়েকমাস ধরেই মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের চড়া দাম ধাক্কা দিচ্ছে মানুষকে। প্রবল গরম ও বর্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম আরও চড়তে পারে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বার বার সতর্ক করেছে। কিন্তু সরকারের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি।
কিন্তু কেন এই মূল্যবৃদ্ধি? কেন্দ্রের বিজেপি সরকার খাদ্যপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে শেয়ার বাজারে খাদ্যশস্য সহ সমস্ত খাদ্যপণ্য নিয়ে ‘ডেরিভেটিভ ট্রেডিংক্স বা আগাম দাম নির্ধারণের নামে ফাটকা খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খাদ্যের ক্ষেত্রে এটাই নাকি বহু প্রতীক্ষিত আর্থিক সংস্কার বলে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম খুব প্রচার করে। এই ফাটকা কারবার এবং অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের যোগসাজশই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী।
মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে যাওয়া মানুষকে রক্ষা করতে একটা দেশের বা রাজ্যের সরকারের ভূমিকা কী? সরকার কি মূল্যবৃদ্ধির সামনে নিষ্ক্রিয় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে? এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খারাপ আবহাওয়ার অজুহাত তুলে অতি মুনাফার লোভে যেমন খুশি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে যাবে, আর সরকার তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাটুকুও করবে না? মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের নামে রাজ্য সরকার কয়েক বছর আগে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল। সেই টাস্ক ফোর্সের ভূমিকা কী, রাজ্যের মানুষ জানেন না। দীর্ঘ দিন তার দেখাও পাননি মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে হুংকারটুকুও দিচ্ছেন না। অসাধু ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের জন্য বাজারে হানাও দিচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের ভূমিকাও তাই। ফলে দুই সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বাজারে একতরফা চলছে মূল্যবৃদ্ধির দাপাদাপি।
মূল্যবৃদ্ধি একটি নিঃশব্দ ঘাতক। যখন সাধারণ মানুষের আয় বাড়ার সুযোগ নেই, তখন এই বিপুল মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যপণ্য কিনতে পারবে না। ফলে বাড়বে অপুষ্টি। এই রকম একটি বিষয় সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতা কি মানা যায়! বড় ব্যবসায়ী ও অসাধু কালোবাজারিদের স্বার্থেই কি সরকারের এ ব্যাপারে এতখানি অবহেলা ?
গণবন্টন ব্যবস্থা অর্থাৎ রেশন দোকানের মাধ্যমে একসময় চাল, গম, চিনি, ডাল, তেল সহ বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরকার স্বল্পমূল্যে দিত। এখন চাল আর কিছু ক্ষেত্রে গম ছাড়া রেশনে কিছুই মেলে না। খাদ্য ব্যবসাকে খোলাবাজারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি সরকারের নীতি অনুসারে সমস্ত খাদ্যপণ্য মজুত করার অবাধ ছাড়পত্র বৃহৎ মালিকদের দেওয়া হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে দুর্বল করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। রাজ্য সরকারগুলিও তাকেই অনুসরণ করছে। ফলে ছোট মজুতদারদের জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট মালিকরা। সবজি, টম্যাটো সহ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে দাম যখন বাড়ে, কৃষকরা সেই বাড়তি দাম পান না। সাধারণ চাষিদের উৎপাদিত আলু, সবজি সংরক্ষণের মতো হিমঘরের ব্যবস্থা নেই। যতটুকু আছে তা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে সবজি কেনে ১ টাকা কিলো দরে, আর সাধারণ মানুষকে তার জন্য দিতে হয় কিলো পিছু ৫০ টাকা।
এখন জনগণের সামনে একটি রাস্তাই খোলা আছে। গণআন্দোলনের চাপে এই সরকারকে মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার সমাধান হিসেবে ১৯৫০-এর দশকেই এসইউসিআই(সি) খাদ্যপণ্যের সার্বিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করার দাবি তুলেছিল। অর্থাৎ সরকার কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য দামে সরাসরি খাদ্যপণ্য কিনবে। তারপর সে নিজেই তা জনগণকে ন্যায্য দামে বিক্রি করবে। মাঝখানে কোনও দাম বাড়ানোর দুষ্টশক্তি থাকবে না। এই ব্যবস্থা চালু করলে কৃষক যেমন ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন, তেমনই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা থেকে জনসাধারণ বাঁচবে। কিন্তু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কোনও সরকারই বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী এই দাবি মানতে রাজি হয়নি।
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে খরা বন্যা বৃষ্টি ইত্যাদি সাময়িক কারণ এবং মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের ভূমিকা ছাড়াও সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ববাজারে যখন অপরিশোধিত তেলের দাম ক্রমাগত কমেছে তখনও সরকার এখানে দাম কমায়নি। এটাও মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে। এর বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জরুরি। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নামলে শাসক শ্রেণি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু পুঁজির সেবক সরকার নিজে থেকে এ কাজ করবে না। এখানেই রয়েছে গণআন্দোলনের জরুরি প্রয়োজনীয়তা।