আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত কবি জয় গোস্বামীর ‘এই অসহ নিষ্ঠুরতা কেন’ (৯ জুলাই) নিবন্ধে স্ট্যালিন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা–
দেশের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়করা যে নির্মম নিষ্ঠুরতায় ৮৪ বছরের বৃদ্ধ অসুস্থ স্ট্যান স্বামীকে কারাগারের অন্তরালে তিলে তিলে হত্যা করেছে তা যে কোনও বিবেকবান মানুষকে যন্ত্রণাবিদ্ধ না করে পারে না। দেশের মানুষের এই যন্ত্রণার কথাই কবির কলমে বিধৃত হয়েছে। এ জন্য তিনি আমাদের ধন্যবাদের পাত্র। তাঁকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে হোঁচট খেলাম। দেখলাম কবি অনাবশ্যকভাবে স্ট্যালিন জমানার কথা তুলে রুশ কবি মান্দেলস্তামের প্রতি স্ট্যালিনের অত্যাচারের কল্পিত কাহিনী পরিবেশন করেছেন এবং লিখেছেন, ‘অবশেষে কবি ও শিল্পী মান্দেলস্তাম প্রবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, এবং ওই বন্দি শিবিরেই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।’ অন্য কথা বাদ দিলেও বলতে হবে, এখানে দুটো তথ্য ভ্রান্তি আছে। কবি মান্দেলস্তাম নিউমোনিয়ায় মারা যাননি, মারা গিয়েছিলেন টাইফয়েডে। ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস পরে শ্রমশিবিরে। তাঁর জন্ম ১৪ জানুয়ারি, ১৮৯১ এবং মৃত্যু ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৮। অর্থাৎ মান্দেলস্তাম, কবি জয় গোস্বামী কথিত ৩৯ বছর বয়সে মারা যাননি, মারা গিয়েছিলেন ৪৭ বছর বয়সে।
এরপর কবি জয় গোস্বামী, রাশিয়ার প্রবল শীতে মান্দেলস্তামকে গরম পোশাক সরবরাহ না করার কল্পকাহিনী বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘নিচয়ই স্তালিনের এ রকমই নির্দেশ ছিল। এও নিচয়ই গোপন সূত্রে পাঠানো নির্দেশ।’ কোথা থেকে তিনি এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন, কবি জয় গোস্বামী তা আমাদের জানাননি। জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। যেভাবে তিনি জোরের সাথে ‘নিচয়ই’ শব্দটি দু-বার ব্যবহার করেছেন তাতে মনে হচ্ছে এটা তাঁর কল্পনা। একে আমরা কবি-কল্পনাও বলতে পারি। কিন্তু কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে স্ট্যালিনের মতো একজন ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে যে অভিযোগ তোলা যায় না এ সত্য নিচয়ই তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার আসি কবি মান্দেলস্তাম সম্পর্কে স্ট্যালিনের ভূমিকা প্রসঙ্গে।
এ কথা ঠিক, ১৯৩৪ সালে কবি মান্দেলস্তামকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই ঘটনায় সারা দেশ হতচকিত হয়ে পড়ে। দু-জন প্রথিতযশা কবি এর প্রতিকারে উদ্যোগী হয়েছিলেন– আন্না আখমোটাজ ও বরিস পাস্তেরনাক। পাস্তেরনাক বুখারিনের সাহায্য চাইলেন। বুখারিন পত্র দিলেন স্ট্যালিনকে।
সব শুনে স্ট্যালিন বললেন– ‘কে কবি মান্দেলস্তামকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল? কী লজ্জা!’ মান্দেলস্তামকে তখনই ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল।
তারপর, স্ট্যালিন ফোন করলেন পাস্তেরনাককে।
স্ট্যালিন– মান্দেলস্তাম-এর বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিষয়টি আমাকে বা লেখকদের সংগঠনকে জানাননি কেন?– আমি যদি কবি হতাম এবং আমার বন্ধু বিপদে পড়ত, তবে তাঁকে সাহায্য করার জন্য যতদূর যেতে হয় আমি যেতাম।
এই ঘটনা স্মরণ করে পরবর্তীতে মলোটভ বলেছিলেন– ‘স্ট্যালিন বললেন, বন্ধুকে রক্ষা করার সাহস পাস্তেরনাকের নেই।'(স্ট্যালিনঃ সেবাগ মন্টেফিওরে, রান্ডম হাউস, নিউইয়র্ক, ২০০০)।
একই ঘটনা স্মরণ করে, কবি পত্নী নাদেজাদা মান্দেলস্তাম লিখেছেন, স্ট্যালিন মান্দেলস্তাম সম্পর্কে পাস্তেরনাককে বলেছিলেন, হি ইজ এ জিনিয়াস, ইজ নট হি? (হোপ এগেইন্টস হোপ, পৃঃ ১৪৬)।
মুক্তির পর কবি মান্দেলস্তাম লিখেছিলেন তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘ভরনেজ নোটবুক’, ‘অন দি আননোন সোলজার’ ইত্যাদি। তিন বছরে অনুবাদ করেছিলেন উনিশটি গ্রন্থ। এই হল ইতিহাস। কবি মান্দেলস্তাম সম্পর্কে এই ছিল স্ট্যালিন ও সোভিয়েত সমাজতন্তে্রর ভূমিকা। সেই সময়, স্ট্যালিন শিল্পী সাহিত্যিকদের মানব মনের রূপকার বলে বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের কামান আছে, বন্দুক আছে, কিন্তু আমাদের চাই নতুন ধরনের মানুষ এবং আপনারাই তার স্রষ্টা। তাঁর ও সোভিয়েত সমাজতন্তে্রর অকৃপণ সহায়তায় সেদিন সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র-বিজ্ঞান, এক কথায় জ্ঞান জগতের সমস্ত ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছিল তা সশ্রদ্ধ চিত্তে গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সবাই স্বীকার করেছিলেন। একে অস্বীকার করা যায়? এই অগ্রগতি বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়কে ব্যাখ্যা করব কীভাবে? স্ট্যালিন ও সোভিয়েত সমাজতন্তে্রর এই ভূমিকার কথা আমরা ভুলে যাব? ভুলে যেতে পারি? সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যাঁরা স্ট্যালিন বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে তৃপ্ত হন, কবি জয় গোস্বামী তাঁদের দলে নাম লেখাবেন।