বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি সহ অতি-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু বেতন-মজুরি বাড়াতে রাজি নয় সরকারি-বেসরকারি মালিকরা। এই অবস্থায় গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন দু দেশের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের অজুহাতে দুনিয়া জুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম আরও চড়িয়ে দিচ্ছে একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা। এত ক্ষতি সত্তে্বও কোনও পক্ষই কিন্তু রাজি নয় যুদ্ধ থামাতে।
নামে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলেও এই যুদ্ধ আসলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রাশিয়ার। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধজোট ‘ন্যাটো’-র ওপর চাপ রাখতে ইউক্রেনে হামলা জারি রেখেছে রাশিয়া। অন্য দিকে এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকা সহ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা লাগাতার অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে ইউক্রেনকে। যুদ্ধ অবসানের শান্তির শর্ত বারবার নানা অজুহাতে বানচাল করে দিতে সচেষ্ট তারা। ফলে চরম দুর্দশার শিকার হচ্ছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না যুদ্ধ-ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অস্ত্র উৎপাদনকারী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের। তাই যুদ্ধের প্রতিটি দিন তাদের কাছে যেন উৎসবের খুশি বয়ে আনছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের মজুত খালি করে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে থাকে। মজুত ভাণ্ডার একটু খালি হতেই অস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে আবার নতুন অস্ত্র উৎপাদনের চুক্তি করছে তারা। ইউরোপের দেশগুলিকে ছাপিয়ে আমেরিকাই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রি করেছে ইউক্রেনে। ২০২২-এর নভেম্বরের মধ্যে ১৮.৫ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়েছে তারা। পরের মাসেই তারা আরও ১.৮৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম দেওয়ার ঘোষণা করে, যার মধ্যে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থা (টাইমস অব ইন্ডিয়া-১৫ জানুয়ারি)। সম্প্রতি ব্রিটেনের সাথে যুক্ত হয়ে ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ডও ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে। জার্মানি ও স্পেন বিধ্বংসী লেপার্ড-২ ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে। এর কোনওটাই বিনা পয়সায় নয়, সরাসরি বা ঘুরপথে এর জন্য বিপুল অর্থ ইউক্রেনের ঘাড় ধরেই আদায় করবে তারা। ইউরোপ এবং আমেরিকা ইউক্রেনে নিত্যনতুন সমরাস্ত্র পাঠানোর ফলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেট এ বছর সমস্ত পুরনো রেকর্ড ভেঙে দাঁড়াতে চলেছে ৮৫৮ বিলিয়ন ডলারে। ডলারের এই বিপুল অঙ্ক সুইজারল্যান্ড দেশটির জাতীয় আয়ের চেয়েও বেশি। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০০ মিলিয়ন ডলার শুধু ইউক্রেনকে সামরিক অস্ত্র জোগাতে চলে যাবে (টাইমস অব ইন্ডিয়া-১৫ জানুয়ারি, ‘২৩)। প্রতিরক্ষা-বিল থেকে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার অস্ত্র কোম্পানি লকহিড মার্টিন এবং জেনারেল ডায়নামিকস থেকে কেনা অস্ত্র ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ডনেৎস্কে যে মার্কিন হিমারস রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেছে সেগুলি লকহিড মার্টিন কোম্পানিতে তৈরি। ফলে এ কথা পরিষ্কার যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির সময় ভাল যাচ্ছে। লকহিড মার্টিন কোম্পানির শেয়ারের দাম গত বছরের থেকে ১১ শতাংশ বেড়েছে, নর্থরপ গ্রুমান-এর বেড়েছে ২৩ শতাংশ এবং এয়ারো ভায়রনমেন্ট-এর ২১ শতাংশ।
এই যুদ্ধের ফলে শুধু অস্ত্র ব্যবসায় বিপুল লাভ হচ্ছে তাই নয়। দেখা যাচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে এই টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রীরাও নানা ভাবে লুট চালিয়েছেন, দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। সেই দুর্নীতি এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, সম্প্রতি ইউক্রেনের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্তা ও মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ– যুদ্ধের টাকায় বিলাসবহুল জীবন যাপনের। আবার কেউ যুদ্ধ-পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে খাবার মজুত রেখে চড়া দামে তা বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ।
আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি সহ বিশ্বের সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশই আজ ব্যাপক অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছে। উৎপাদনের পরিমাণে ঘাটতি না থাকলেও কেনার ক্ষমতা নেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। দেশে দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি আজ মন্দার ধাক্কায় টালমাটাল। এই অবস্থায় ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করতে অস্ত্র-ব্যবসাই পুঁজিবাদী দেশগুলির শাসকদের একমাত্র ভরসা। তাই যুদ্ধ বাধানো এবং তা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য একান্ত জরুরি। যুদ্ধের সময় সরকারের কাছ থেকে বিপুল অস্ত্রের বরাত পায় অস্ত্র কোম্পানিগুলি। অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল, আনুষঙ্গিক পণ্যের কেনাবেচা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়। অস্ত্র-ব্যবসায়ীদেরও চাহিদার সঙ্কটে ভুগতে হয় না। কারণ তাদের উৎপাদিত অস্ত্রের সবচেয়ে বড় খদ্দের খোদ দেশের সরকার। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভ কমাতে তাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেও যুদ্ধের জুড়ি নেই। আবার এই যুদ্ধই দেশের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সামনে লুটপাটের বিপুল সুযোগ খুলে দেয়।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এইসব সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের শাসক কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে বিরাট সুযোগ হিসাবে দেখা দিয়েছে। মরতে বসা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখার অক্সিজেন হিসাবে এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে তারা। তাই আমেরিকাই হোক বা ইউরোপের নানা দেশ– কোনও দেশের সরকারেরই এই যুদ্ধ বন্ধের কোনও সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে বেকারত্বের যন্ত্রণায় দীর্ণ হচ্ছেন বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তাঁদের বাঁচানোর কোনও চেষ্টা না থাকলেও মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বাঁচাতে মরিয়া আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির যুদ্ধ-ব্যবসায়ী শাসকরা তাই আপাতত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শরণ নিয়েছে। এমনকি ভারতের মতো দেশও মুখে শান্তির কথা বলতে বলতেই কার্যত যুদ্ধের সুযোগটিকে দেশীয় কর্পোরেট পুঁজির মুনাফালুটের স্বার্থে নানা ভাবে ব্যবহার করছে। এই অবস্থায় দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে যুদ্ধের সমস্ত আঘাত বয়ে চলা শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষকেই।