৫ আগস্ট, সর্বহারার মহান নেতা, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর রচনা থেকে মূল্যবান কিছু শিক্ষা এখানে তুলে ধরা হল – সম্পাদক, গণদাবী
‘‘আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, প্রথম যখন এই দল শুরু হয় তখন কী ছিল আমাদের? আমাদের কিছুই ছিল না। টাকা নেই, পয়সা নেই, লোকজন নেই, থাকার জায়গা নেই, কেউ চেনে না, জানে না। আর আমাদেরও বয়স বা তখন কত? আমি তখন পুরোপুরি যুবক, অল্প বয়সের একটি যুবক। সে বলছে ভারতবর্ষে সত্যিকারের কোনও বিপ্লবী দল নেই, এই দল গঠন করতে হবে। অনেকেই যুক্তি-টুক্তি শুনে বলছে, হ্যাঁ, এটা তো করা উচিত, যুক্তিগুলো তো ভালই। কিন্তু এ একটা পাগলের মতো কথা। একটা দল করা কি সোজা কথা নাকি? এতগুলো বড় বড় দল রয়েছে, তারাই সব ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে, কত কী কাণ্ড হচ্ছে। আর যাদের কেউ চেনে না, জানে না, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক নেই, নাম করা নেতা নেই, প্রেস পাবলিসিটি নেই তারা কী করে করবে? কিছু বললেই লোকে ঠাট্টা করত, হাসতো– এ অসম্ভব ব্যাপার! এ হতে পারে না। এসব অবাস্তব কল্পনা, ও সব হবে না। আমিও বেশি তর্ক করিনি। আমি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছি। তর্কের মধ্যে না গিয়ে একেবারে সোজা মেনে নিলাম, হ্যাঁ কিছু হবে না বুঝলাম, কিছু করতে পারব না। তা হলে, কী করতে হবে বলুন। গোলামি করব? দালালি করতে হবে? বিবেক বিক্রি করতে হবে? যা বুঝেছি তা না করে অন্য রকম আচরণ করতে হবে? আমি পারব না। আমার কথা ছিল, তোমরা যারা আমার সঙ্গে থেকে লড়াই করতে পারবে তারা আমার সঙ্গে থাক, আর যারা পারবে না তারা সরে পড়। অনাহারে যদি আমাকে রাস্তাতেই মরতে হয়, আমি মরব, কিন্তু মর্যাদা নিয়ে মরব, মাথা উচু রেখেই মরব। আমি যেদিন রাস্তায় না খেয়ে মরব, সেদিনও আমি যে-কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারব। অন্যায় কাজের জন্য যে-কোনও মানুষের গালে দরকার হলে চড় বসিয়ে দিতে পারব, আমার হাত কাঁপবে না। কারণ আমাকে গুলি করে মারা যাবে, কিন্তু আমাকে কেনা যাবে না। এ ছাড়া বলুন আমি আর কী করতে পারি? আমি তো দালালি করতে পারব না। আমার এত সব বুঝেই তো বিপদ হয়ে গেছে। আমার ঠাকুরমার কোনওই অসুবিধা ছিল না। আমার বাবারও কোনও অসুবিধা ছিল না, মারও অসুবিধা ছিল না। কারণ তাঁরা ঘর সংসার করেছে, পুজো-আচ্চা করেছে, কালীবাড়ি গিয়েছে, সেখানে বারবার মাথা ঠুকে প্রণাম করেছে, বাবা সবসময় ভাবছেন, এই বুঝি স্বর্গের রথ সুর সুর করে নেমে এল এবং তিনি স্বর্গে গিয়ে আমাদের জন্য বসে থাকবেন। এ তাঁর পক্ষে কত সুবিধে। কিন্তু আমার পক্ষে অসম্ভব, কারণ আমি বুঝে ফেলেছি যে মানুষ কথাটার মানে কী, মানুষের মূল্যবোধ কী, সত্যিকারের মর্যাদা কী। আর এই দেশে জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে সেই মানুষ হিসাবে আমার কর্তব্য কী? আমি তো জেনেছি যে, ভারতবর্ষের এই সমাজটার পরিবর্তন না হলে আমরা কেউ বাঁচব না। আমি বাঁচব না, আমার বিবেক বাঁচবে না, নীতিনৈতিকতা বাঁচবে না, সংস্কৃতি বাঁচবে না, চরিত্র বাঁচবে না, কোনও কিছু বাঁচবে না। আমি যদি একটা সুখের সংসার গড়বার চেষ্টা করি সেই পরিবারের ভিতরেই দুষ্টশক্তি ঢুকে আমার স্নেহের সন্তানটিকে নষ্ট করে দেবে। সেটি বড় বড় ফিল্মস্টারদের ফ্যান কিংবা চ্যালা হবে, নাকি ওয়াগন ব্রেকারের দলে নাম লেখাবে– এই সব বিষয়ে আজ নিশ্চিত করে কে বলতে পারে? প্রাণ দিয়ে ভালবেসে যাকে গড়ে তুলব সে বিট্রে করে চলে যাবে, এটাই বাস্তব স্থিতি। বাস্তব পরিস্থিতি এমনই যে, পয়সার জন্য সে কোনও কিছুই পরোয়া করবে না। আজকের সমাজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে যদি ভালবাসাকে বাঁচাতে হয়, নীতিনৈতিকতাকে বাঁচাতে হয়, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধকে বাঁচাতে হয়, মানুষকে বড় করতে হয়, নিজেকেও যদি বড় হতে হয়, আমার স্নেহের পাত্রপাত্রীগুলিকে যদি বড় করে গড়ে তুলতে হয় তা হলে তাদের সামনে সঠিক রাস্তা খুলে দিতে হবে। আর লড়াই করা ছাড়া কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই। এটা আমি বুঝে ফেলেছি। আমি কেন এরকম বুঝলাম তা নিয়ে রাগ করব কার ওপর? এ নিয়ে তো কারও সাথে তর্ক করা যায় না যে, তুমি বোঝোনি, আমি বুঝলাম কেন? আর বুঝলাম বলেই তো আমার বিপদ হয়ে গিয়েছে।
এখন আমার সামনে দু’টি রাস্তা খোলা আছে। হয় সব জেনে-শুনে, বুঝেও নিজেকে অধঃপতিত করা, নিজের বিবেক বিক্রি করা, আর না হয় লড়াই করা। এই লড়াইয়ে আমি জিতব কি হারব, সে ইতিহাস বলবে। কিন্তু আমি যা সত্য বলে মনে করি– ভারতবর্ষে নতুন করে একটা বিপ্লবী দল গড়ে তুলতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তা ভুল পথে গিয়ে হাজার মানুষ কোরবানি করুক কিংবা লক্ষ লক্ষ ছেলে রক্ত ঢেলে দিক, সব বিফল হয়ে যাবে। তাই যথার্থ আদর্শ চাই, যথার্থ বিপ্লবী দল চাই। ”
(১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরের অপ্রকাশিত আলোচনা থেকে)