Breaking News

যক্ষ্মার ওষুধের জোগান বন্ধ করেছে মোদি সরকার লক্ষ লক্ষ রোগীর জীবন বিপন্ন

বিগত প্রায় ছ-মাস দেশের কম করে আটাশ লক্ষ যক্ষ্মা রোগী ও তার পরিবার একটু ওষুধ পাওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন জেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কখনও রাজ্য জুড়ে। তাতেও অনেক সময় শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ওষুধ যোগাড় করতে না পারার ফলে অজান্তেই উক্ত ওষুধের বিরুদ্ধে টিবি রোগের জীবাণু রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর হিমশীতল হাওয়া দোলা দিয়ে যাচ্ছে তাদের গায়ে। পরিবারের আশঙ্কা উৎকণ্ঠার অন্ত থাকছে না।

বিষয়টি কী এবং কেন? টিবি এমন একটি ছোঁয়াচে রোগ যে একজন রোগী প্রায় আঠারো জন নতুন রোগী তৈরি করে। অর্থাৎ চিকিৎসা না হলে, এই ভাবে যদি রোগ ছড়াতে থাকে, তা হলে তো একদিন দেশে টিবি রোগী ছাড়া আর কোনও মানুষই থাকবে না! একদিন রোগের ওষুধ যখন আবিষ্কার হয়নি, তখন তো ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’ এই প্রবাদ বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন মারা গেছে এই রোগে। সমাজের মধ্যে আতঙ্কে ভয়ে নানা কুসংস্কার এবং ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রতিকারের জন্য বৈজ্ঞানিকদের চেষ্টারও অন্ত ছিল না। তখনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই ক্ষয় রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী চিকিৎসক ডাঃ নর্মান বেথুন। নিউমোথোরাক্সের মতো নানা জটিল অপারেশনের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে তিনি সুস্থ করে তুলেছিলেন। যদিও এই রোগ নিয়ে কাজ করতে করতেই তিনি নিজেও আক্রান্ত হন এই রোগে। নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, লড়াই করার একাগ্রতায় সেই যুগেও তিনি টিবির সাথে যুদ্ধ করে, বলা যায় আশ্চর্যজনক ভাবেই সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং পৃথিবী থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করার দায়িত্ব নিলেন।

কিন্তু দেখা গেল যত জনকে তিনি সুস্থ করে তুলছেন, তাঁর কাছে আরও হাজার গুণ রোগী আসছে চিকিৎসার জন্য। তিনি কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে খুঁজে পেলেন দারিদ্রই হল এই রোগের উৎস। অর্থাৎ যে সব মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে থাকে, ঘিঞ্জি বস্তিতে অপুষ্ট যে সব মানুষ একসাথে অনেকে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে, তারাই এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সে কথা প্রমাণিত সত্য। সাম্প্রতিক টিবি রোগের রিপোর্ট দেখলে সে কথাই প্রমাণিত হয়। ২০২৪ সালে টিবি রোগীর সংখ্যা প্রায় আটাশ লক্ষ। এর মধ্যে অপুষ্ট রোগীর সংখ্যা আট লক্ষের উপরে। এবং বেশিরভাগ রোগীরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। এর উপরে জুটেছে আরেক উপদ্রব। এইচ আই ভি পজিটিভ রোগী। প্রায় এক লক্ষ রোগীই হল এইচ আই ভি সংক্রমিত। এক লক্ষের উপরে টিবি রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের দেহে খুব সহজেই ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি তৈরি হয়। বর্তমানে অনিয়মিত ওষুধ সেবনের ফলে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি, এমনকি এক্স ডি আরের মতো প্রায় চিকিৎসাহীন টিবি তৈরি হয়। বতর্মানে দেশে ৬৩৮০১ জন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগী রয়েছেন। যাদের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় একশ শতাংশই। এই সব রোগীর থেকে যারা সংক্রমিত হন, তাদেরও মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিই হয়। বিষয়টি কতটা ভয়াবহ, সহজেই অনুমেয়।

৬০-এর দশকের শেষের দিক থেকে টিবির ওষুধ হিসেবে রিফামপিসিনের ব্যবহার শুরু হলেও, তখন এই চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়ভার সরকার নিত না। অনিয়মিত এবং পরীক্ষামূলক বিভিন্ন কম্বিনেশন ব্যবহারের ফলে এই ওষুধের বিরুদ্ধে বহু ক্ষেত্রে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে শুরু করে। ১৯৯৭ সাল থেকে টিবি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশে চালু হয়, আরএনটিসিপি অর্থাৎ রিভাইসড ন্যাশনাল টিউবারকুলোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম। শুরু হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত পুরোপুরি সরকারি উদ্যোগে ওষুধ সরবরাহের প্রক্রিয়া। মানুষকে তখন স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতিতেই ওষুধ খাওয়ানো হতে থাকে। এই প্রোগ্রাম চলে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে টিবির ওষুধ সম্পূর্ণরূপে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। খোলা বাজারে এই ওষুধ প্রায় অমিল হয়ে পড়ে। যদিও এই প্রোগ্রামেরও কিছু কুফল দেখা দেয়, যেমন একদিন বাদে একদিন ওষুধ সেবনের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। ফলে ২০২০ সালে ঘোষিত হয় এনটিইপি অর্থাৎ ন্যাশনাল টিবি এলিমিনেশন প্রোগ্র্রাম। শুরু হয় প্রতিদিন ওষুধ সেবনের প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামের রাশ থাকে সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। সারা বিশ্ব যখন ২০৩০ সালের মধ্যে টিবি মুক্ত বিশ্বের আহ্বান জানায় মোদিজি একধাপ এগিয়ে ভোটের চমক দিতে ঘোষণা করে ২০২৫ এর মধ্যে টিবি মুক্ত ভারতের।

আর আজ সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মার্চ মাসেই মোদি সরকার ঘোষণা করেছে এখন থেকে আর কোনও টিবির ওষুধ সরবরাহ করা হবে না। তা হলে কি বতর্মানে ভারত টিবি মুক্ত হয়ে গেছে? তথ্য কী বলছে? না আজও ভারতেই পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টিবি রোগী রয়েছে। এক লক্ষের কাছাকাছি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে ১৪০০ টিবি রোগী। সাধারণ টিবিতে এখনও মারা যাচ্ছে ১২ শতাংশের উপর মানুষ। যেখানে বিশ্বে উক্ত রোগে গড়ে ৫.৮ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তা হলে কেন এ ভাবে আগাম কোনও নোটিস না দিয়ে এবং বিকল্প কোনও পরিকল্পনা না করেই এভাবে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল। যখন কোম্পানিগুলি আর টিবির ওষুধ তৈরি করছে না। বাজারেও অমিল। তখন ভিক্ষার মতো কিছু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে কি দায় এড়ানো যায়! এই পরিস্থিতিতে যাদের হাতে টাকা আছে, তারাও তো ওষুধ কিনতে পারছে না। সেখানে যৎসামান্য টাকা দিয়ে মানুষ ওষুধ জোগাড় করবে কোথা থেকে? আর অনিয়মিত ওষুধ খেলে যে রেজিস্ট্যান্স টিবি তৈরি হয় সে কথা কি স্বাস্থ্যদপ্তর জানে না?

আজ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যদপ্তর কখনও বলছে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আসছে না তাই ওষুধ তৈরি হচ্ছে না। তা হলে দেশীয় কোম্পানিগুলি, যেখান থেকে টিবির ওষুধের কাঁচামাল তৈরি হত এবং কিছু পরিমাণ ওষুধও তৈরি হত, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? কেন আজ সমগ্র ওষুধের বাজার বেসরকারি করা হল? যখন ওষুধ কোম্পানিগুলিই নির্ধারণ করছে ওষুধের দাম কী হবে এবং কোন কোন ওষুধ তারা তৈরি করবে। একদিন, বিশেষত ৯০-এর দশক পর্যন্ত তো এই নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই ছিল। তা হলে আজ কেন তা নেই? ওষুধ কি কেবল উচ্চ মুনাফারই সামগ্রী? যাকে কেন্দ্র করে হাজার শতাংশের বেশি মুনাফা ঢুকবে কোম্পানির ঘরে। আর নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢুকবে ভোটসর্বস্ব শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর ঘরে? এই অসাধু চক্রের কারসাজিতেই সমাজে আজ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতে ছেয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ। আর মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

২০২২-এর পর থেকে যত টিবি রোগী বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসা করান, তা মোট রোগীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশি এবং সেই সংখ্যাটা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। ওষুধ সরবরাহের দায়িত্বও বিভিন্ন রাজ্যে এনজিওগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ভাবে চলতে থাকলে সমগ্র কর্মপ্রকল্পই তো বেসরকারি হাতে চলে যাবে! সাধারণ মানুষ পারবে তো খরচ বহন করে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে?

সরকার এবং মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা তৈরির উদগ্র বাসনা সমাজকে আজ কোথায় ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে টাকা আর শুধু টাকা। ভোটের এত ঢক্কানিনাদের মধ্যে ভোটসর্বস্ব দলগুলোর ভোট প্রচারে আজ এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ঠাঁই পায়নি। অথচ এই মানুষগুলোর ভোটেই তো এরা কেউ না কেউ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে। ভেবে দেখুন, সরকার এ ভাবে মাঝ রাস্তায় হাত গুটিয়ে নিলে অচিরেই তো সমাজ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতে ছেয়ে যাবে। মহামারী সৃষ্টি হবে। একে কি জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত যুদ্ধ বললে কিছু অত্যুক্তি হবে? যে যুদ্ধ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধের থেকেও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবে। একদিন ডাঃ নর্মান বেথুন সারা বিশ্বের অত্যাচারী অর্থলোলুপ মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘হত্যা ও ব্যাভিচারে ভরা এই পৃথিবীতে প্রতিবাদহীন কণ্ঠে আমি বেঁচে থাকতে চাই না।’ স্বাস্থ্য নিয়ে আজ সবাই মিলে প্রতিবাদ করার সময় উপস্থিত।