ম্যানহোলে শ্রমিক মৃত্যু, এই ক্ষতি পূরণ হবে কী দিয়ে?

‘আমরা গরিব বলেই কি আমার ছেলের প্রাণের দাম নেই’– সাংবাদিকদের সামনে বলছিলেন বানতলায় ম্যানহোলের বিষাক্ত গ্যাসে মৃত এক শ্রমিকের মা। সন্তান হারিয়ে আর এক শ্রমিকের পিতার আর্ত জিজ্ঞাসা– ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? সন্তানহারা আর এক মায়ের হাহাকার– আমাদের ক্ষতি পূরণ হবে কী দিয়ে? ঠিক কার দোষে তিনটি প্রাণ অকালে ঝরে গেল, গত কয়েক দিন ধরে তা নিয়ে চলছে দায় অস্বীকার করার পালা।

দরিদ্র পরিবারগুলির যে যুবকেরা অন্য কাজ না পেয়ে নালা পরিষ্কারে নেমেছিলেন, তারা হয়ত ভাবতেও পারেননি তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হবে না। কলকাতা পুরসভার অধীনে ঠিকাকর্মী হিসাবে কাজ করতে তারা গিয়েছিলেন কলকাতার অদূরে বানতলার চর্মনগরীতে। সেখানকার দূষিত বর্জ্যপদার্থ যে ওই নালা দিয়ে পরিবাহিত হয়, তা প্রশাসনের সব স্তরের কর্তারাই জানতেন। তা সত্ত্বেও ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে ওই শ্রমিকদের নর্দমা সাফাইয়ে নামানো কি মারাত্মক অবহেলা নয়? জানা গেছে, সাফাই-শ্রমিকদের সাথে ছিল না বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে নেমে কাজ করার উপযুক্ত সরঞ্জাম– গামবুট, দস্তানা, পোশাক, মাস্ক, অক্সিজেন কোনও কিছুই। শ্রমিকদের ছিল না কোনও প্রশিক্ষণ। পরীক্ষা করে দেখাও হয়নি ওই ম্যানহোলে কোনও বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে কি না। শুধুমাত্র দড়ি ও বালতি সম্বল করে পূতিগন্ধময় পাঁকের গভীর অন্ধকারে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়। বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তারা।

ঘটনার পর যথারীতি হম্বিতম্বি, দু-একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। পুরমন্ত্রী ও আধিকারিকরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, মৃতদের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের। মুখ্যমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, এমন ঘটনা বরদাস্ত করা যায় না। কিন্তু অতঃপর! এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোখার পদক্ষেপ? এসব যথারীতি অনুপস্থিত। ২০২১ সালে কুঁদঘাটে সাত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল নর্দমা সাফাই করতে গিয়ে। সে ঘটনার থেকে আদৌ কিছু শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা সরকার করেছে কি? করলে এই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটতে পারত না। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ঠিকাদারেরই দায়িত্ব ছিল শ্রমিক-সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তা হলেও প্রশ্ন ওঠে, ওই ঠিকাদার কলকাতা পুরসভার অধীনেই তো কাজ করতেন। তা হলে পুরসভা শ্রমিক-নিরাপত্তা নিয়ে ঠিকাদারদের উপর নজরদারি করেনি কেন? তার জবাব না দিয়ে পুরমন্ত্রী শ্রমিকদের মৃত্যুর দায় কার্যত তাদের উপরেই চাপিয়েছেন। পুরমন্ত্রীর এই বক্তব্য অত্যন্ত অসংবেদনশীল ও নিন্দনীয়।

বর্তমানে উচ্চপ্রযুক্তি নির্ভর সাফাই-কাজের নানা যন্ত্র রয়েছে পুরসভাগুলিতে। এতে এক বা দুজন কর্মী দিয়ে একেকটা অঞ্চলের সাফাই-কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। তা সত্ত্বেও অসহায় মানুষগুলিকে মৃত্যুকূপে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? কম খরচে চটজলদি বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্যই কি অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে এই গরিব মানুষদের নর্দমা-সাফাইয়ে নামানো হচ্ছে, না কি দায়িত্ব অস্বীকার করা অত্যন্ত সহজ বলেই এই অমানবিক কাজ বারবার হচ্ছে? আসলে এই দরিদ্র, অসহায় যুবকদের মানুষ বলেই মনে করে না সরকার। সে জন্য অভাবগ্রস্ত বেকার যুবকদের কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়াই এই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। আবারও বলি হওয়া তিনটি প্রাণ প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়, এই নির্মমতা কি চলতেই থাকবে?

খাতায়-কলমে ভারতে ১৯৯৩ সাল থেকে নিকাশি নালায় মানুষ নামিয়ে কাজ করানো বেআইনি। ২০১৩ সালে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে বলা রয়েছে– ম্যানহোল সাফাই, মলমূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কোনও মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে ম্যানহোলে নামাতে হলে সেই সাফাইকর্মীর জীবন এবং স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কিন্তু ১১ বছর আগের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে সাফাই কাজ। পরিণামে সাফাই কর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। সংসদে ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্যে জানা গেছে, শুধু ২০১৮-২৩ সালের মধ্যেই ভারতে ৪০০ জন সাফাইকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। যদিও গোটা দেশের সাফাইকর্মীদের মৃত্যুর ভয়াবহ পরিসংখ্যানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায় এতটুকুও কমে না।

ম্যানহোলে নামার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নানা নির্দেশিকা রয়েছে। এমনকি বানতলার ঘটনা ঘটার মাত্র চার দিন আগে কলকাতা সহ দেশের ছয় শহরকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার। ২০২৩ সালে এই সংক্রান্ত একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে কোনও সাফাইকর্মীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেই সরকার দায়িত্ব সেরেছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা সন্তান হারানো বাবা-মায়ের ক্ষতে এতটুকুও প্রলেপ দিতে পারবে না। তা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ নিয়ে টালবাহানা এবং আগের বহু দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার ঘটনায় সরকারের দায়বদ্ধতা প্রশ্নের মুখেই পড়ে।

শ্রমিক-মৃত্যুর ঘটনায় ঠিকাদার দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু সরকারের বকলমে পুরসভার এই যে সীমাহীন অপরাধ, বারে বারে যার বলি হতে হচ্ছে অসহায় শ্রমিকদের, সেই অপরাধে সরকারি কর্তারা কি দোষী সাব্যস্ত হবেন না? যে দরিদ্র-অসহায় পরিবারের বাবা-মায়ের কোল খালি করে তাদের সন্তানরা চিরতরে হারিয়ে গেল, তার দায় কি নিতে হবে না নেতা-মন্ত্রীদের? শুধু শুকনো কাগুজে বিবৃতি দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের হাতে হাতকড়া না পড়লেও, জনতার আদালতে তাদের জন্য শাস্তি তোলা থাকবে, তা যেন ভুলে না যান তারা।