এ বারের ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ভারতে পালিত হয়ে গেল অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের আবহে। এই নির্বাচনে শ্রমিক শ্রেণির কর্তব্য কী, তাদের জীবনের সমস্যাগুলি এই নির্বাচন, সরকার গঠন, সরকারের পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সমাধান হবে কি না বা সমাজের জন্য অন্য কোনও বিপ্লবী শক্তিকে খোঁজা জরুরি কি না– এগুলিই মূল বিচার্য বিষয়। শ্রমিক শ্রেণির সামনে এখন প্রধান সমস্যা কী? ভারতের শ্রমজীবী মানুষের সামনে মারাত্মক বিপদ হিসাবে এসেছে কেন্দ্রের মোদি সরকারের ‘শ্রম কোড’।
ভারতের মালিক শ্রেণি তাদের স্বার্থে বহুদিন ধরেই প্রচলিত শ্রম আইনগুলির পরিবর্তন দাবি করে আসছিল। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটরবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কংগ্রেস নেতা বিজয় ভার্মার নেতৃত্বে দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন গঠন করে। এই শ্রম কমিশন ২০০২ সালে দেশের সমস্ত শ্রম আইনগুলিকে কোডে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব পেশ করে। সেই প্রস্তাবে মালিক শ্রেণির স্বার্থে শ্রমিকদের অধিকার হরণের বিষয়গুলি উল্লেখিত ছিল। মোদি সরকার ২০২০ সালে করোনা অতিমারির সুযোগে পার্লামেন্টে কোনও আলোচনার সুযোগ না দিযে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শ্রম কোড পাশ করিয়ে নেয়।
কেন্দ্রীয় সরকার ৪৪টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রম কোড এনেছে। এই শ্রম কোড কেন চূড়ান্ত শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী? কারণ এর মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের প্রায় সব অধিকার হরণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কোডের ৭৭(১), ৭৮, ৭৯, ৮০ ধারা অনুযায়ী ২৯৯ জন পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করে এমন কারখানায় লে-অফ, ছাঁটাই এবং ক্লোজার করার জন্য মালিকদের সরকারের কাছ থেকে উপযুক্ত অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ তারা ইচ্ছে করলেই ছাঁটাই করতে পারবে। আগে শিল্পবিরোধ আইনে ১০০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করে এমন কারখানায় শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ওই সব পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি ছিল বাধ্যতামূলক।
নতুন শ্রম কোডে ফ্যাক্টরির সংজ্ঞাও বদলে দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনে ফ্যাক্টরির সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ চালিত কারখানায় ১০ জন ও বিদ্যুৎ হীন কারখানায় ২০ জন শ্রমিক থাকলে ফ্যাক্টরি বলে চিহ্নিত হবে এবং শ্রমিকরা ফ্যাক্টরি আইনের সকল সুযোগ পাবে। শ্রম কোডে মোদি সরকার তা পাল্টে দিয়েছে। বিদ্যুৎ-নির্ভর কারখানায় ২০ জন ও বিদ্যুৎহীন কারখানায় ৪০ জন শ্রমিক থাকলে তা কারখানা বলে পরিগণিত হবে। এর ফলে বহু মালিক যথাক্রমে ১৯ জন বা ৩৯ জন শ্রমিক দিয়ে কারখানা চালিয়ে শ্রমিকদের সমস্ত আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে। ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ জন করা হয়েছে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৫ জন থেকে বাড়িয়ে ১০ জন করা হয়েছে। এর ফলে শ্রমিকরা ব্যাপকহারে কাজ হারাবে। হারাবে আইনের সুরক্ষা ও অধিকার। মালিকরা পাবে ছাঁটাই ও শোষণ-বঞ্চনার অবাধ স্বাধীনতা।
আগে মজুরি ছিল তিন প্রকারের। (ক) মিনিমাম ওয়েজ (ন্যূনতম মজুরি)–যার কম মজুরি দিলে কোনও শ্রমিক পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। (খ) ফেয়ার ওয়েজ–কোনও মতে বাঁচার মতো মজুরি। (গ) লিভিং ওয়েজ–বাঁচার মতো মজুরি। এখন মোদি সরকার শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে এনেছে ফ্লোর ওয়েজ ব্যবস্থা। এই ‘ফ্লোর ওয়েজ’ প্রচলিত ন্যূনতম মজুরির থেকে কম। শ্রমিকরা জানেন ১৯৫৭ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকদের দেওয়া আইনত বাধ্যতামূলক। যে মালিক ন্যূনতম মজুরির কম মজুরি দেবেন তিনি আইনভঙ্গকারী হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। এই শাস্তির হাত থেকে মালিকদের বাঁচানোর জন্য এবং আরও কম মজুরি শ্রমিকদের দেওয়াকে আইনসম্মত করার জন্যই ফ্লোর ওয়েজের বিষয়টি কোডে এসেছে। চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে ন্যূনতম মজুরির থেকে কম মজুরি দেওয়ার অর্থই হল শ্রমিকদেরকে নিশ্চিত অর্ধাহার, অনাহরের দিকে ঠেলে দেওয়া। মোদি সরকার এই কাজটি করল।
নতুন শ্রম কোডে আনা হয়েছে ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’ তথা চুক্তিভিত্তিক কাজ। এর ফলে মালিকরা কিছু শর্তসাপেক্ষে শ্রমিক নিয়োগ করে। শর্তটা স্থায়ী কিন্তু কাজটা স্থায়ী নয়। এই চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের থাকবে না কাজের কোনও স্থায়িত্ব। মেয়াদ পূরণের আগে, চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা থাকবে শঙ্কিত। এই কারণে মালিকদের কোনও বঞ্চনার় প্রতিবাদও করতে পারবে না। স্থায়ী কাজে স্থায়ী কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা, যা এতদিন বলবৎ ছিল তা ধ্বংস করা হল এই কোডের মাধ্যমে। ফলে মালিকদের শোষণ অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
শ্রম কোডে বলা হয়েছে, কোনও শিল্প বা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট করতে হলে ১৪ দিন আগে শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে। বর্তমান আইনে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ক্ষেত্র বাদ দিয়ে আর কোথাও ধর্মঘট করার জন্য নোটিস দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে সেই অধিকার খর্ব করা হল। শুধু তাই নয়, শিল্প বিরোধ বিষয়ে সরকারের শ্রম দপ্তরের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু করা হলে–যতদিন আলোচনা চলবে ততদিন ধর্মঘট করার কোনও অধিকার শ্রমিকদের থাকবে না। মালিকপক্ষ ও তার তল্পিবাহক সরকার এই সুযোগে আলোচনা বিলম্বিত করতে থাকবে। ফলে শ্রমিকরা আইনসম্মত ভাবে ধর্মঘটে যেতে পারবেন না। আরও বলা হয়েছে যে, অর্ধেকের বেশি শ্রমিক একযোগে ছুটি নিলে তা ধর্মঘট হিসেবে বিবেচিত হবে এবং মালিক এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বর্তমান শ্রম কোড ব্যাপক ভাবে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করার সিংহদরজা খুলে দিয়েছে। পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত কোডে এই স্থায়ী কাজের ধারণাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই কোডে কোর অ্যাক্টিভিটিতেও ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করার অধিকার মালিকদের দেওয়া হয়েছে যা বর্তমান আইনের পরিপন্থী। পরিষেবা ক্ষেত্রেও যেমন ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স ইত্যাদিতে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ঢালাও অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর ঠিকা শ্রমিক মানেই হল তার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না এবং মজুরিও কমে যাবে।
শ্রম কোডে পিএফ এবং পেনশন কমানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কোড অনুযায়ী প্রফিডেন্ট ফান্ডে কর্মচারী এবং নিয়োগকর্তার উভয়ের প্রদেয় মজুরির অংশ মূল বেতনের ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কর্মচারীর পিএফ অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৪ শতাংশ করে কম টাকা জমা পড়বে। এর ফলে অবসরের সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রাপ্য টাকা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। কমে যাবে পেনশনের টাকাও। ইএসআই-এর গুরুত্ব নানা ভাবে লঘু করা হয়েছে।
শুধু কেন্দ্রের বিজেপি নয়, রাজ্যের তৃণমূল সরকারও শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নীতি নিয়ে চলছে। এই পশ্চিমবঙ্গে চলছে বিজি প্রেস সহ নানা ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া, ছাঁটাই, স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে ব্যাপক হারে চুক্তিতে নিয়োগ, পিএফ এবং গ্র্যাচুইটির টাকা আত্মসাৎ ও স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ। সরকারি ক্ষেত্রে বহু শূন্যপদ পড়ে আছে, কিন্তু নিয়োগ হচ্ছে না। শিক্ষক, নার্স ও সরকারি কর্মচারী সহ যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, তাতেও ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ শিল্প চটকলে এবং চা শিল্পে চলছে ভয়ঙ্কর শোষণ ও বঞ্চনা। বহু চটকল বন্ধ। চা শিল্পে এখনও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। নেই বন্ধ চা বাগানগুলি খোলার উদ্যোগ। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের আত্মহত্যা আজ নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায় সত্ত্বেও সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক সহ অন্যান্য কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ দিচ্ছে না।
দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা আজ মোট শ্রমিক সংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি। তাঁদের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। তাঁদের জন্য নেই বাঁচার মতো মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের প্রতি সরকারের কোনও দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে বলে সরকার মনে করে না। সমাজের জন্য উৎপাদনে এঁদের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ পুঁজিবাদী সমাজে এঁরা ভীষণভাবে শোষিত ও উপেক্ষিত।
এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির কর্তব্য হল চূড়ান্ত শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যে যে সরকারগুলি চলছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। একই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি, পুঁজিপতিদের অপর জোট ইন্ডিয়ার শরিক দলগুলিও কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে যে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ভূমিকা নিয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ করা।
ঐতিহাসিক মে দিবস শ্রমের সময় ৮ ঘণ্টায় রাখার এবং শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শপথে ভাস্বর। সমাজতন্তে্রর সাময়িক বিপর্যয় এবং শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদী শাসন ও পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন মে দিবসের অর্জনকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। আরারও শুরু হয়েছে ১০-১২ ঘণ্টা করে কাজ করানোর প্রক্রিয়া। পুঁজির শোষণ যে হারে বেড়ে চলেছে সরকার যেভাবে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ভূমিকা নিয়ে চলছে তার বিরুদ্ধে আবারও শ্রমিক বিক্ষোভ অনিবার্যভাবে ফেটে পড়বে।
সেই বিক্ষোভ সঠিক দলের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেই তা পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে। যথার্থ শ্রমিক শ্রেণির পার্টি ছাড়া শ্রমিকদের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারে না। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে নির্বাচনেও শ্রমিক শ্রেণি শক্তিশালী করবে তার শ্রেণি দলকে।