করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিধ্বস্ত দেশ। এই লেখা তৈরির সময়ে দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে করোনা আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক ভারতের বাসিন্দা এবং মোট মৃতের ২৫ শতাংশই এ দেশের।
সর্বত্রই এখন রোগের ব্যাপক সংক্রমণ, মৃত্যুর হাহাকার আর রোগীর প্রাণ বাঁচাতে পরিজনদের মরিয়া প্রচেষ্টা নজরে পড়ছে। গোটা দেশ আজ অতিমারির তাণ্ডবে বিপর্যস্ত। কখন অসুস্থ হওয়ার পালা আসে আতঙ্কিত মানুষ। প্রয়োজনীয়। সংখ্যক হাসপাতাল না থাকায় বেড মিলছে না মুমুর্য রোগীদের। মিলছে না ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুও। ওষুধ নিয়ে চলছে কালোবাজারি। শ্মশানে, কবরস্থানে মৃতদেহের সারি। জ্বলছে গণচিতা। গাদাগাদি করে মৃতদেহ বয়ে আনছে অ্যাম্বুলেন্স। শবদেহ ছিড়ে খাচ্ছে রাস্তার কুকুর। শুধু সাধারণ মানুষ নন, মারা যাচ্ছেন চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরাও। দ্রুত রোগের প্রকোপ কমাতে প্রয়োজন ছিল যে ব্যাপক টিকাকরণের, সেই কাজও চলছে নিতান্তই খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে, প্রায় না-চলার মতো করে।
কেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি? এমন যে হতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের তা জানা ছিল না, এমন তো নয়। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আসতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারি প্রশাসনের উচুতলার অফিসাররা জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকেই সংক্রমণ বাড়ছে বলে সরকারকে সতর্ক করার কাজ তারা শুরু করে দিয়েছিলেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সে কথায় আদৌ গুরুত্ব দেয়নি। এই অবস্থায় প্রয়োজন ছিল জরুরিকালীন ভিত্তিতে দ্রুত হাসপাতালগুলির বেড বাড়ানো অস্থায়ী কোভিড হাসপাতাল তৈরি করা, পর্যাপ্ত সংখ্যায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা, প্রয়োজনীয় পরিমাণ ওষুধ মজুত রাখার ব্যবস্থা করা এবং দ্রুতগতিতে টিকাকরণের ব্যবস্থা করা। এই কাজগুলি গুরুত্ব দিয়ে করা দুরের কথা, করোনার প্রথম ঢেউ একটু থিতিয়ে আসতে না-আসতেই মোদি সরকারকে ‘অতিমারি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে বলে প্রায় উদ্বাহু নৃত্য শুরু করতে দেখা গেল। এমনই তাদের দায়িত্বশীলতা যে, ২৮ জানুয়ারি দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সভায় নরেন্দ্র মোদি বুক ফুলিয়ে সে কথা ঘোষণাও করে দিলেন! এই পরিস্থিতিতে মানুষ ভেবেছিল, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার জরুরি ভিত্তিতে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করবে, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করবে এবং বিনামুল্যে দেশের সমস্ত মানুষকে টিকার আওতায় আনার ব্যবস্থা করবে। বাস্তবে দেখা গেল, দেশের কতটা প্রয়োজন সে হিসাবের ধার না ধেরে মোদি সরকার ব্যক্ত অন্য দেশে টিকা রপ্তানি করে নিজেদের দাপট দেখানোর প্রচেষ্টায়। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যখন টিকার জন্য হাহাকার শুরু হল, তখন দেখা গেল দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা তো নেই-ই, উপরন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নিজে কোনও উদ্যোগ না নিয়ে একটিমাত্র বেসরকারি কোম্পানির ওপর নির্ভর করে বসে রয়েছে এবং ১৮ বছরের ওপরে সকলের টিকাকরণের সম্পূর্ণ দায় চাপিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলির ওপরে। অথচ রোগ ছড়াবার প্রথম দিকে রাজ্যগুলি যখন নিজেদের প্রয়োজনীয় টিকা নিজেরাই কিনে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে বারবার কেন্দ্রের দ্বারস্থ হচ্ছিল, তখন কিন্তু মোদি সরকার তাদের সেই অনুমতি দেয়নি। হাসপাতাল তৈরি কিংবা চিকিৎসক সংখ্যা বাড়ানো দূর অস্ত, মোদি সরকার করোনা রোগীদের নিতান্ত প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুর ব্যবস্থা করার প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করেনি। আসন্ন দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়লে কী পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন হবে এবং তা জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, সেই হিসাবটুকুও না করে অপদার্থ মোদি সরকার গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের জানুয়ারির মধ্যে অক্সিজেন রফতানি অবলীলায় ৭০০ শতাংশেরও বেশি বাড়তে দিয়েছে। ফলে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরছে মানুষ। হাসপাতালের পথে দম বন্ধ হয়ে এলে স্বামীর মুখে ফু দিয়ে স্ত্রীর অক্সিজেন জোগানোর মরিয়া চেষ্টার গা-শিতরানো ছবি ভাইরাল হয়েছে। অতিমারি-আক্রান্ত নাগরিকদের সম্বন্ধে দেশের সরকারের এই উদাসীনতা ও ক্রিমিনালসুলভ অবহেলা— এ অপরাধ তো ক্ষমার অযোগ্য।
এর ওপর অতিরির এই ভয়াবহ পরিস্থিত্রি মধ্যেই চুড়ান্ত অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পাঁচটি রাজ্যে হয়ে গেল বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে তা অনুষ্ঠিত হল একটি-দুটি নয়, আটটি দফায়। সরকারি গদি দখলে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির তাবড় নেতারা প্রায় প্রতিদিন রাজ্যে অসংখ্য সভা-সমাবেশ, রোড শো, জমায়েত করে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দিয়ে গেলেন। এ নিয়ে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, একে পর এক হাইকোর্টের বিচারপতিরা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দিলি হাইকোর্টের এক বিচারপতি কেন্দ্রীয় সরকারকে ধিক্কার জানিয়ে মন্তব্য করেছেন, “দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা চান, মানুষ মরে যাক” (আনন্দবাজার, ২৮ এপ্রিল, ২১)। বিদেশের খ্যামা সংবাদমাধ্যমগুলিতে পর্যন্ত মোদি সরকারের এই অবিবেচক ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে করোনা অতিরির দ্বিতীয় ঢেউ কেন্দ্রের মোদি সরকারের চুড়ান্ত অপদার্থতা ও দেশ চালানোর অযোগ্যতা প্রকট করে দিয়ে গেল। দেখিয়ে দিয়ে গেল দেশবাসীর প্রাণের কোনও মুল্যই বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা তার সহযোগীদের কাছে নেই। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোটবাক্স ভরাতে তারা যতখানি উদ্যোগী-উৎসাহী, রোগগ্রস্ত, বিপদাপন্ন, অসহায় দেশবাসীর চরম বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে ততখানিই অনীহা তাদের। এই অবস্থায় গোটা দেশ জুড়ে বিপন্ন মানুষ আওয়াজ তুলছে অবিলম্বে অসরি অবস্থার ভিত্তিতে অতিমারি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। যেমন করে হোক অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ওষুধ, অক্সিজেন ও টিকার বন্দোবস্ত করতে হবে। তা না হলে অবিলম্বে পদত্যাগ করুক অপদার্থ এই মোদি সরকার।