গ্রামের শ্রমিকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি– মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টে বছরে ২০০ দিন কাজ দিতে হবে। এই অ্যাক্টে বর্তমানে ১০০ দিন কাজ দেওয়া বাধ্যতামূলক, যদিও কোনও রাজ্যে কোনও সরকারই বছরে ১০০ দিন কাজ দেওয়ার বিষয়টি নিিশ্চত করতে পারেনি। বছরে ২০, ৩০, ৪০, ৫০ দিন পর্যন্ত কাজ দিয়েছে। তা নিয়েও রয়েছে নানা দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। এই স্কিমটিকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য বিজেপির নানা ভূমিকা রয়েছে। মোদি সরকার কখনও এই স্কিমে বরাদ্দ কমিয়েছে, আবার কখনও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে চাপে ফেলার জন্য এই স্কিমের টাকা আটকে দিয়েছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে এই প্রকল্পে কোনও টাকাই দেয়নি। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, সারা ভারতে এই প্রকল্পে মোট ১০ কোটি ৪৩ লক্ষ জব কার্ড বাতিল করা হয়েছে।
জব কার্ড গ্রামীণ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কোনও কারণে এই কার্ড বাতিল করা হলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক হারাবে কাজ পাওয়ার আইনি গ্যারান্টি, যা তার বেঁচে থাকার সামনে প্রতিবন্ধক হিসাবে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই কার্ডগুলি বাতিল করার আগে সরকারের পক্ষ থেকে কানুনি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা জরুরি ছিল সেগুলি বাতিলযোগ্য কিনা, অথবা কী প্রক্রিয়ায় তা বৈধ করা যায় তা বিচার বিবেচনা করা। প্রায় সাড়ে ১০ কোটি কার্ড বাতিল তো আর সামান্য বিষয় নয়! এতগুলি লোকের রোজগার বিপন্ন হওয়ার সময় যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ঠিকঠাক নথিপত্র যাচাই করা হয়েছিল কি?কী কী কারণে জব কার্ড বাতিল হতে পারে? এ বিষয়ে ২০২১-২২ সালের সার্কুলারে বলা হয়েছে—১) যদি কোনও পরিবার স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে যায়, ২) যদি জব কার্ডটি ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়, ৩) যদি প্রমাণিত হয়, যে জব কার্ড দেওয়া হয়েছে তা ভুলভাল নথির ভিত্তিতে দেওয়া, তাহলে তা বাতিলযোগ্য। এ ছাড়া প্রকল্পটির ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নাম বাতিল এবং কার্ড বাতিলের আরও কিছু মাপকাঠি ঠিক করেছে, যেমন ডুপ্লিকেট আবেদনকারী, ভুয়ো আবেদনকারী এবং কাজ করতে না চাওয়া ইত্যাদি।
লোকসভায় কার্ড বাতিল নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ লিখিতভাবে জানান, নাম সংযোজন এবং বিয়োজন একটি রুটিন ওয়ার্ক, যা নিয়মিত করা হয়ে থাকে প্রকল্পটির স্বচ্ছতা এবং যথাযথ পরিচালনার জন্য। প্রশ্ন হল, নাম সংযোজন দারিদ্র্যের কারণে জরুরি হলেও গণহারে নাম বাতিল কী উদ্দেশ্যে?
প্রকল্পটির তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০২১-২২ সালে জব কার্ড বাতিলের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪৯ লক্ষ। ২০২২-২৩ সালে সংখ্যাটা ২৪৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫৩ লক্ষ। গত চার বছরে বাতিলের মোট সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪৩ লক্ষ। লক্ষণীয় বিষয় হল ২০২২-২৩ সালেই আধার কার্ড ভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম বাধ্যতামূলক করা হয়। আর ওই সময়ই কার্ড বাতিল ২৪৭ শতাংশ বেড়ে যায়। তাহলে এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে?
ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখে যে, আধার লিঙ্ক করার সময় নথিপত্র যথাযথ সত্যতা বিচার না করে বহু কার্ড বাতিল করা হয়েছে। পত্রিকাটির সমীক্ষক দল সারা দেশে দশটি রাজ্যে খোঁজ নিয়ে দেখেছে, নাম বাতিলের ক্ষেত্রে গ্রামসভার বক্তব্য শোনা বাধ্যতামূলক হলেও বহু ক্ষেত্রে তা শোনা হয়নি। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের বক্তব্যও শোনা হয়নি।
অনুসন্ধানের জন্য দেশের ২১টি রাজ্যের প্রত্যেকটিতে একটি করে ব্লক অপক্ষপাতমূলকভাবে বেছে নেওয়া হয়। ২১টি ব্লকের ১৯৯৪ টি গ্রামে জব কার্ড বাতিলের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা যায় পাঁচটি রাজ্যে বেশি কার্ড বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে বিহারের ঔরঙ্গাবাদ জেলার মদনপুর ব্লকে বাতিল হয়েছে ৫৩ হাজার, ৩২ হাজারের মতো বাতিল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বর-১ ব্লকে, অন্ধ্রপ্রদেশে একটি ব্লকে বাতিল হয়েছে ৩০ হাজার, ওড়িশায় একটি ব্লকে ২৬ হাজার, গুজরাটে একটি ব্লকে ২৩ হাজার। সমীক্ষক দল আরও দেখেছে, পিশ্চিমবঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য রাজ্যে বাতিল ২ লাখ ৬৭ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৭১ শতাংশ অর্থাৎ ১,৮৯,৫৫৫ জন নাকি জানিয়েছে, তারা কাজ করতে চায় না।
শ্রমিকরা কাজ করতে চায় না এ কথা কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? গ্রামে ফসল বোনা এবং কাটার কয়েক মাস বাদ দিলে সারা বছর সুনির্দিষ্ট কোনও কাজ থাকে না। এই অবস্থায় এই প্রকল্পে নিিশ্চত কাজটুকু তারা করতে চাইবে না কেন? এ বিষয়ে আরটিআই করে জানতে চাওয়া হলে গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে বলা হয়, মন্ত্রক এ বিষয়ে সত্যতা যাচাই করে দেখেনি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সত্যতা যাচাই না করে এতগুলো শ্রমিকের কার্ড বাতিল করেছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান আইন অনুযায়ী এটা গুরুতর অপরাধ।
এসইউসিআই(সি) এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ইচ্ছুক সমস্ত শ্রমিককে জব কার্ড প্রদান, বছরে ২০০ দিন কাজ এবং দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরির দাবিতে ইতিমধ্যে দলের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় প্রচার শুরু হয়েছে। আগামী ২১ জানুয়ারি কলকাতার মহামিছিলে হাজার হাজার মানুষের সাথে গ্রামীণ শ্রমিকরাও শামিল হবেন। আওয়াজ তুলবেন বিজেপি সরকারের এই জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে।(তথ্যসূত্র ঃ দ্য হিন্দু, ২৮ নভেম্বর ২০২৪)