সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে একটি ভিডিও– ‘ভক্ত কা চশমা’৷ এই চশমা চোখে থাকলে দারিদ্র, বেকারি, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কিছুই চোখে পড়ে না৷ সর্বত্র শুধু স্বাচ্ছন্দ্য, উন্নয়নই চোখে পড়ে৷ ফসলের দাম না পাওয়া চাষির শুধু নুন আর লঙ্কা দিয়ে শুকনো ভাত খাওয়ার দৃশ্য এই চশমা দিয়ে দেখলেই রকমারি দামি দামি সুস্বাদু খাবারে ভরে ওঠে থালা৷ দারিদ্র জর্জরিত বস্তি মুহূর্তে ঝাঁ চকচকে বহুতলে পরিণত হয়৷ এমন চশমাই দেশের মানুষকে পরাতে চান ভোটবাজ দলগুলির নেতারা৷ দেখাতে চান নিজেদের রাজত্বে সর্বত্র কত উন্নয়ন তাঁরা করেছেন৷ চশমার আড়ালে ঢেকে রাখতে চান আসল ভারতকে– দারিদ্র, বেকারত্বে জর্জরিত বুভুক্ষু ভারতকে৷ এ ব্যাপারে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে শাসক বিজেপি৷ কারণ শাসন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে প্রচারযন্ত্র তাদের কবজায়৷ তাই চশমার মালিকও তারাই৷
ঠিক এ জিনিসই দেশের মানুষ দেখল বারাণসীতে৷ ক’দিন আগে সেখানে ছিল প্রধানমন্ত্রীর রোড শো৷ প্রধানমন্ত্রীর রোড শো বলে কথা৷ তা যদি ফ্লপ করে তবে তো দেশজুড়ে কর্মীদের নার্ভ ফেল করে যাবে৷ যত টাকা লাগে ঢালো৷ দেবে তো গৌরী সেনেরা৷ এল কোটি টাকা৷ ফলে লোকও হল দেদার৷ প্রধানমন্ত্রীর সভাগুলি সফল করতে সর্বত্রই কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে৷ তার জন্য বহু আগে থেকে ব্যাপক প্রচার, লোক জোটানোর খরচ, তাদের আনার জন্য গাড়ি, তাদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা, সব মিলিয়ে এলাহি ব্যপার৷ স্বাভাবিক ভাবেই রোড শো কিংবা সভা ভরাতে লোকের অভাব ঘটছে না৷ সংবাদমাধ্যমের খবর, বারাণসীতে শুধু গোলাপের পাপড়িই কেনা হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকার৷ অর্থাৎ দেশের মানুষ যেন প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচিকে ‘ভক্তের চশমা’ দিয়ে দেখেন৷ কিন্তু গত পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী সাংসদ হিসেবে কী করেছেন বারাণসীর সাধারণ মানুষের জন্য সেই হিসেবটা এই ভিড়ের মাঝে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে৷
বারাণসী থেকে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি৷ জেতার আগে দেদার প্রতিশ্রুতি দিতে তিনি যে কোনও কসুর করেননি, এ তো না বললেও সবাই জানেন৷ কিন্তু কী অবস্থা সেই প্রতিশ্রুগুলির? প্রচারের আলো থেকে একটু দূরে গেলেই সেখানকার সাধারণ মানুষ কিন্তু এই প্রশ্নই তুলছেন৷
বারাণসীর জন্য গত পাঁচ বছরে সরকার টাকা কম বরাদ্দ করেনি৷ কিন্তু তা খরচ হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্র হিসাবে শহরটাকে ঝাঁ–চকচকে করে তুলতে৷ সরকারি তথ্য বলছে, শহরের পরিকাঠামো বদলাতে ২০১৪–১৫ সাল থেকে ২১,৮৬২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে৷ কীসে খরচ হয়েছে এই বিপুল পরিমাণ টাকা? এয়ারপোর্টের আধুনিকীকরণ হয়েছে৷ বানানো হয়েছে চার লেনের হাইওয়ে৷ শহরে ঢুকতে বানানো হয়েছে বিশাল বিশাল ওভারব্রিজ৷ ১৭ কিলোমিটার রিং রোড৷ টাটার সাথে যৌথ ভাবে গড়ে ওঠা ক্যান্সার সেন্টারে সরকারি টাকা ঢালা হয়েছে৷ দীনদয়ালের নামে হস্তশিল্পের প্রদর্শনী এবং বিক্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে৷ যদিও ক্রেতার সংখ্যা সেখানে খুবই কম বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা৷ পাশেই ২৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তাঁত এবং বস্ত্রশিল্পের তিন তলা বিশাল মিউজিয়াম তৈরি হলেও ক্রেতা তেমন একটা থাকে না৷ দোকানদার গুলজার আনসারি জানিয়েছেন, এখানকার বিখ্যাত কাড়োয়া শাড়ি মাসে ৩–৪টের বেশি বিক্রি হয় না৷ বারাণসীর মাণ্ডুয়াধি রেলস্টেশনটি একেবারে বিমানবন্দরের ধাঁচে ঝাঁ চকচকে করে তোলা হয়েছে৷ কিন্তু ভেতরের ক্যান্টিনের অবস্থা আগের মতোই৷
শহরের গঙ্গার ঘাটগুলি আলোয় আলোয় ভরে দেওয়া হয়েছে৷ ফলে দশাশ্বমেধ থেকে অসসি পর্যন্ত দেদার নৌকাবিহার করছেন পর্যটকরা৷ আর এই ‘উন্নয়ন’ দেখাতেই প্রধানমন্ত্রী এমনকী জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাক্রঁকে এনে হাজির করেছিলেন৷ কিন্তু গঙ্গার ঘাটগুলি আলোয় ঝলমল করলেও ‘স্বচ্ছ গঙ্গার’ কী হয়েছে? এ কথা কারও অজনা নয়, ‘নমামি গঙ্গা’ প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকা গঙ্গার জলেই গেছে৷ বিজেপি নেতারা আর কন্ট্রাক্টররা মিলে সেই টাকা সাফ করে দিলেও গঙ্গা সাফ করা বা দু’ পারের সংস্কারের কাজ প্রায় কিছুই হয়নি৷ ১৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সুসংহত ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার গড়ে তোলা হলেও শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা একই রকমের বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই থেকে গেছে৷ শহর জুড়ে চলছে অজস্র খোঁড়াখুড়ি৷ এখানেই নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের অংশ ভেঙে পড়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল গত মে মাসে৷ নিকাশি সমস্যা একইরকম থেকে গেছে৷ যদিও ব্যবস্থার উন্নতির নামে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে৷
কেমন আছেন বারাণসীর সাধারণ মানুষ? গঙ্গার ঘাটের মতো তাঁদের জীবনও স্বাচ্ছন্দ্যে উজ্জ্বল হয়েছে কি? তাঁদের কর্মসংস্থানের কী ব্যবস্থা করেছে মোদি সরকার? শিল্পের কী দশা বিখ্যাত এই শহরের? বারাণসীর ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আর কে চৌধুরী বলেছেন, শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলেও শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় শূন্য৷ প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগই নেননি৷ কর্মহীন মানুষের সমস্যা গুরুতর আকার নিয়েছে৷ শহরের আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে তাকে ‘বিশ্ব মানে’ পৌঁছে দিতে বিপুল সংখ্যক গরিব, সাধারণ মানুষকে উচ্ছেদ করেছে সরকার৷ কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের আশপাশের সরু গলিগুলিকে মণিকর্নিকা, ললিতা এবং জলসেন ঘাট পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ মিটার পর্যন্ত চওড়া করা হয়েছে৷ উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলিকে শহর ছাড়তে হয়েছে৷ সরকারের তরফে তাঁদের হাতে যা দেওয়া হয়েছে, কাজের জন্য সেই শহরেই প্রতিদিন যাতায়াত করতে করতে তার কতটুকু কতদিন হাতে থাকবে সেই চিন্তা অনেককেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ এঁদের কেউ গঙ্গার ঘাটে নৌকা চালান, কেউ পরিচারিকার কাজ করেন, কেউ অন্য পেশায় যুক্ত৷ এখন তাঁদের হয় অন্যত্র কাজ খুঁজতে হচ্ছে, না হয় অনেক টাকা খরচ করে প্রতিদিন শহরে আসতে হচ্ছে৷ বেনারস আইআইটির অধ্যাপক, সঙ্কটমোচন মন্দিরের মহন্ত বিশ্বম্ভর নাথ মিশ্র বলেছেন, যেভাবে শহর জুড়ে ভাঙচুর চলছে, তাতে ভ্রান্ত চিন্তার ছাপ স্পষ্ট৷ এর দ্বারা শহরের মূল চরিত্রকেই বদলে দেওয়া হচ্ছে৷ যাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তারাই এখানকার আদি বাসিন্দা৷ বেনারস শিবের শহর বলে পরিচিত৷ অথচ একে বিশেষ একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে তোলা হচ্ছে৷
একসময় বেনারসে প্রায় ৫ লক্ষ তাঁত শিল্পীর বাস ছিল৷ এখন তা অনেকখানি কমে গেছে৷ বিশ্বায়নের ধাক্কা এসে লেগেছে এই শিল্পে৷ বহু মানুষ পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ বেশিরভাগ তাঁতশিল্পী দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন৷ তাঁরা চান সরকার তাঁদের পরিচয়পত্র দিক এবং তার ভিত্তিতে তাঁদের সহায়তা দিক৷ একসময়কার তাঁত শিল্পীদের কলোনিগুলো, যেমন মদনপুরা, এখন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে৷ ক্ষমতাশালী এবং ধনীরা টাকার জোরে তাঁদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছে৷
জিএসটি তাঁত শিল্পেও মারাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে৷ উৎপাদন কমেছে, বিক্রিও কমেছে৷ জিএসটি ব্যবসার ধরনটাই বদলে দিয়েছে৷ মহম্মদ আসিফ, যাঁর অধীনে দৈনিক ১২ জন লোক কাজ করে তিনি বলেছেন, আগে যা চলত অনেকখানি মুখের কথায়, বিশ্বাসের উপর, এখন সেখানে চালু হয়েছে ‘রিসিট বই’ পদ্ধতি৷ যা ব্যবসার বিরাট ক্ষতি করেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃণতায়, সাফল্যের তালিকায় সাধারণ মানুষের জীবনের এই সব সমস্যাগুলি নেই৷ বরং হাইওয়ে, ওভারব্রিজ, চওড়া রাস্তা আর চীনা আলোর ঝলকানিতে জীবনের মূল সমস্যাগুলিকে ঢেকে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি ও তাঁর দলের নেতারা৷ তাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় এবার ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’, ‘কালো টাকা উদ্ধার’, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, কর্মসংস্থান প্রভৃতি কথাগুলি, এমনকী ‘নোট বাতিলের’ কথাও একেবারে উধাও৷ পরিবর্তে এসেছে, বালাকোট, পাকিস্তান, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি কথাগুলি৷ স্বাভাবিক ভাবেই মহম্মদ আসিফের উদ্বেগও বেড়েছে৷ তিনি বলেন, পুলওয়ামা ঘটনার পর হিন্দুত্ববাদী গুন্ডাদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে৷ তারা যখন তখন শোনাচ্ছে, ‘পাকিস্তানে কবে যাবে?’ আর এক ব্যবসায়ী পারভেজ আখতার বলেন, মোদি ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে একটা বিভাজনের রেখা সবারই চোখে পড়ছে৷ যদিও তাঁর আশা, বারাণসীর ঐতিহ্য বদলাবে না৷ কারণ দূর অতীত থেকেই এখানকার দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন এবং জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে৷ কিন্তু এই ঐতিহ্যের মূল্য বোঝেন কি ‘ঐতিহ্যবাদী’ বিজেপি দলের নেতারা বা প্রধানমন্ত্রী নিজে? তাঁদের তো একটিই লক্ষ্য– ক্ষমতায় বসে পুঁজিপতি শ্রেণির লুটপাটের ব্যবস্থা করা এবং তার উচ্ছিষ্ট পাওয়া৷ তার জন্য সাধারণ মানুষকে বলি দিতে তাঁরা পিছপা নন৷
তথ্যসূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া (আপডেটস) ২৬ এপ্রিল ২০১৯