Breaking News

মে দিবসে দেশে দেশে তুমুল বিক্ষোভ, মুক্তি আকাঙ্ক্ষাই পথে নামিয়েছে শ্রমিকদের

১ মে। শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল গোটা বিশ্ব। দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি এ দিন যে ভাবে সংগঠিত বিক্ষোভে পথে নেমেছেন, সাম্প্রতিক কালে তা নজিরবিহীন। উল্লেখযোগ্য হল, এ মিছিল বিশ্বজুড়ে কোনও সংগঠিত শক্তির ডাকে হয়নি। মালিক শ্রেণির শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ থেকেই কোথাও বামপন্থী দলের ডাকে, কোথাও শ্রমিক সংগঠনের ডাকে শ্রমিক শ্রেণি নিজস্ব উদ্যোগেই এ দিন পথে নেমেছে। সর্বত্রই বিশাল বিশাল জমায়েত হয়েছে শ্রমিকদের।

বিশ্বের সর্বত্র ছাঁটাই, বেকারি, অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছাঁটাই, মানবাধিকার হরণ করে চলেছে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি। শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার আজ পদে পদে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। এর বিরুদ্ধেই পথে নেমেছেন শ্রমিকরা, পুলিশের সাথে ব্যারিকেড ফাইট করেছে।

১ মে বার্লিনে শ্রমিকদের বিশাল মিছিল হয়। প্যারিসে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং লড়াকু জমায়েত হয়েছে ওই দিন। পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ সংঘর্ষ হয়েছে শ্রমিকদের। পুলিশের বীভৎস মারে আহত হয়েছেন বহু শ্রমিক। ফিলিপিন্সের ম্যানিলাতে হাজার হাজার শ্রমিক মিছিল করেছেন। সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন শ্রমিকরা। পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় মজুরি বৃদ্ধি এবং ঠিকা শ্রমিক ও পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তার দাবিতে প্রায় দু’লক্ষ মানুষ মিছিলে পা মেলান। তুরস্কের ইস্তানবুল, আঙ্কারা সহ ৩০টি প্রদেশে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছেন কমিউনিস্ট পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের আহ্বানে। গ্রেফতার হয়েছেন শ্রমিক নেতারা। সর্বত্রই শ্রমিকদের মুখে ছিল পুঁজিবাদবিরোধী স্লোগান, সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ ধ্বনি। সর্বত্র স্থায়ী নিয়োগ এবং স্থায়ী বেতন ও ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করানোর স্লোগান তুলেছেন তারা। প্যারিসের মতোই টোকিও-র মিছিল থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন নীতি রূপায়ণের় বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে। স্পেনের বার্সেলোনা, মাদ্রিদ সহ সব বড় শহরে বিরাট বিরাট মিছিল হয়েছে।

গ্রিসের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার শ্রমিকের মিছিল হয়েছে। কিউবার রাজধানী হাভানায় পা মিলিয়েছেন প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ। শ্রীলঙ্কার সরকারি বামপন্থীরা এক লক্ষের বেশি মানুষের জমায়েত করেছিল, তেমনই সরকার ও আইএমএফ-বিরোধী ফ্রন্টলাইন সোসালিস্টদের জমায়েতও ছিল বিরাট। বাগদাদেও বিরাট মিছিল হয়েছে মে দিবসে। প্যালেস্টাইন থেকে মে দিবসের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছে মার্ক্সবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট। লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা, চিলি, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলিতেও হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে নেমেছেন। আমেরিকার শিকাগো, লস এঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন সহ নানা শহরে ৬০০টি-র বেশি বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।

কলকাতায় শহিদ মিনারের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এআইইউটিইউসি-র সর্বভারতীয় সহসভাপতি কমরেড স্বপন ঘোষ। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস, সর্বভারতীয় কমিটির সদস্য কমরেড শান্তি ঘোষ। আগামী ২০ মে শ্রমিক সংগঠনগুলি সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মে দিবস উপলক্ষে ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি সহ ১০টি শ্রমিক সংগঠনের আহ্বানে রাজ্যে রাজ্যে দিনটি পালিত হয়। কলকাতায় শহিদ মিনার ময়দানে কেন্দ্রীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিজেপি সরকারের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রম কোড, ব্যাপক হারে ছাঁটাই, কর্পোরেট মালিকের তীব্র শোষণের বিরুদ্ধে ও কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবিতে সোচ্চার ছিল এই সমাবেশ।

জার্মানির বার্লিনে মে দিবসের মিছিল

দেশে দেশে মিছিল, জমায়েত, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ প্রমাণ করে সব দেশেই গরিব-খেটেখাওয়া মানুষের দুর্দশা আজ কী প্রবল আকার নিয়েছে। এ বারের মে দিবস দেখিয়ে দিল বিশ্বের সর্বত্র তীব্র পুঁজিবাদী সংকটে হাঁসফাঁস করা শ্রমিকরা প্রতিরোধ চাইছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনসাধারণ বুঝতে পারছে, লড়াই ছাড়া বাঁচার অন্য কোনও পথ নেই। পুঁজিপতি শ্রেণি শত চেষ্টা করেও এই ব্যবস্থার সংকটকে আর চেপে রাখতে পারছে না। দাবিয়ে রাখতে পারছে না শ্রমিক বিক্ষোভকেও। কিন্তু বিক্ষোভ যতই তীব্র হোক, বারে বারে তা ব্যর্থ হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সঠিক নেতৃত্বে এবং সঠিক নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠবে। আরব বসন্ত, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আছড়ে পড়েছিল জনসাধারণের বিক্ষোভের ঢেউ। সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী হলেও সঠিক পরিণতিতে পৌঁছতে পারেনি। কারণ বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বদলানোর লক্ষ্য ছাড়া জনগণের বিক্ষোভ যত তীব্র যত বিশাল আকারেই হোক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক শ্রমিক শ্রেণির দলের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের জোয়ার এবং সেই আন্দোলনগুলিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের পরিপূরক করে গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে, পুঁজিপতি শ্রেণি তথা মালিক শ্রেণি অত্যন্ত সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ। এর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে লড়তে হলে সুসংবদ্ধ, সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। না হলে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

সমাজ জুড়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের আকুতি আজ তীব্র, সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রয়োজনও উপলব্ধি করছেন শ্রমিকরা। প্রয়োজন সঠিক শ্রমিক শ্রেণির দলের নেতৃত্বে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই।