দুই সাবালক নর–নারীর বিবাহের সিদ্ধান্ত তাঁদের মনমতো না হলে সেই বিয়ে গায়ের জোরে তাঁরা ভণ্ডুল করেন৷ তাঁদের চোখ এড়িয়ে বিবাহের ঘটনা ঘটলে গুন্ডা লাগিয়ে পাত্র–পাত্রী উভয়কেই হত্যা করার নিদান দেন৷ মেয়েদের পোশাক–আসাক, শিক্ষা–দীক্ষা কেমন হবে সে ব্যাপারেও ফতোয়া জারি করেন এঁরা৷ আর, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই গা–জোয়ারি কার্যকলাপে লাগাম পরানোর চেষ্টা করলে তাঁরা মেয়েদের জন্ম দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন, এমনই সর্বশক্তিমান তাঁরা!
তাঁরা খাপ পঞ্চায়েতের নেতা৷ হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলির গ্রামীণ সমাজজীবনে এদের ব্যাপক আধিপত্য এবং দাপট৷ পরিবারের সম্মান রক্ষার মিথ্যা এবং অন্ধ আবেগপ্রসূত ধারণা থেকে নবদম্পতি খুনের ঘটনায় খাপ পঞ্চায়েতের ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত৷ এ হেন খাপ পঞ্চায়েত নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে৷ সেই মামলাতেই শীর্ষ আদালত সম্প্রতি জানিয়েছে, সাবালক নারী–পুরুষের বিয়ের সিদ্ধান্তে খাপ হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷ ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা এবং মূল্যবোধ থাকলে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাবেন যে কোনও মানুষই৷ কিন্তু খাপ কর্তারা তা মানতে নারাজ৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই রায়ে ঘি পড়েছে আগুনে! তোমর খাপের নেতা চৌধুরি সুরেন্দ্র সিংহ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে বলেছেন– ‘ওদের কথা কে শোনে!’ বালন খাপের প্রধান নরেশ টিকায়েত আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে হুমকি দিয়েছেন– ‘আদালত এই ধরনের রায় দিলে আমরা মেয়েদের জন্ম দেওয়াই বন্ধ করে দেব৷ কিংবা তাদের এতদূর লেখাপড়া শেখাব না যাতে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে’৷
কী ভয়ানক স্পর্ধা সামন্তী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কী ভয়ঙ্কর প্রকাশ শুধু তো ভারতের একাংশের গ্রামজীবন নয়, গোটা দেশ জুড়েই আজ পেশি ফোলাচ্ছে কদর্য পুরুষতন্ত্র, এমনকী রুচি–সংস্কৃতিতে উন্নত বলে পরিচিত এই পশ্চিমবাংলাতেও৷ খাপের নিদান নিয়ে খবরের কাগজে যখন রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে ঠিক তখনই এই কলকাতার বাঁশদ্রোণীতে অটোচালকের হাতে হেনস্থা হতে হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাকে৷ এই কলকাতার বুকেই, একটু রাত বেড়ে গেলে, কর্মস্থান থেকে ঘরে ফেরার পথে পিছু ধাওয়া করা মত্ত যুবকদের থাবা থেকে বাঁচতে আশ্রয়ের খোঁজে পড়িমরি ছুটতে হচ্ছে তরুণীকে৷ এ কি সভ্য দেশ, নাকি হিংস্র অরণ্য!
গোটা দেশে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নারীলাঞ্ছনার অজস্র ঘটনা৷ শিশু থেকে বৃদ্ধা, রেহাই মিলছে না কারওর৷ একটি মেয়েকে স্বাধীন সত্তার অধিকারী একজন পূর্ণ মানুষ মনে না করা, তাকে পুরুষের সম্পূর্ণ অধীন মনে করা, শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী হিসাবে, একটি নারী শরীর হিসাবে দেখার মানসিকতা ক্রমবর্ধমান৷ এই চিন্তারই আরও ব্যপ্ত রূপ খাপ পঞ্চায়েত কর্তাদের ভাষণ৷ মেয়েদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া শিখতে পারা না–পারা, এমনকী পৃথিবীতে জন্মাবার অধিকার পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণের অধীন বলে মনে করছেন খাপ নেতারা!
এই সাহস এরা পাচ্ছে কোথা থেকে দেশের আইনকানুন, নীতিনৈতিকতা সবকিছু অগ্রাহ্য করে এমনকী সর্বোচ্চ বিচারালয়কেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার স্পর্ধা তাদের জোগাচ্ছে কারা? দণ্ডনীয় অপরাধ জেনেও সদম্ভে কন্যাভ্রূণ হত্যার কথা খোলা গলায় ঘোষণা করতে পারছে কী করে এইসব স্বঘোষিত সমাজপতিরা? আসলে এদের মাথার উপরে রয়েছে শাসক রাজনৈতিক দলের অভয় হস্ত৷ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে বহুল প্রশংসিত এই দেশের প্রান্তে প্রত্যন্তে, গলিতে মহল্লায় মানুষের চেতনার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে সামন্তী ভাবনা–ধারণা, মনন, যার সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে এসেও গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও চিন্তা–চেতনার স্পর্শ পাওয়ার সুযোগবঞ্চিত বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে খাপ পঞ্চায়েতের আদেশ–নির্দেশ অলংঘনীয়৷ সেই খাপের বিরুদ্ধতা করলে এদের অসন্তোষের কোপে পড়ার আশঙ্কা থাকে, ভোটে যার প্রভাব পড়ে৷ তাই ভোটের স্বার্থে রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিয়ে চলে খাপ পঞ্চায়েতের মতো ‘পিছন দিকে এগিয়ে চলা’ সংগঠনগুলিকে৷ ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর স্বয়ং মন্তব্য করেছিলেন– ‘খাপের মতো সংগঠন সমাজের পক্ষে উপযোগী’৷ তাই খাপ কর্তারা যখন ক্রমবর্ধমান ধর্ষণে লাগাম পরানোর দাওয়াই হিসাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার নিদান দেন– যেন ধর্ষণের জন্য দায়ী মেয়েরাই– তখন সে কথার বিরোধিতা করে না এইসব ভোটবাজ দলগুলি৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রকাশ্যে কন্যাভ্রূণ হত্যার কথা বুক বাজিয়ে বলা সত্ত্বেও খাপ নেতাদের উপরে কেন নেমে আসে না পুলিশ–প্রশাসনের শাস্তির খাঁড়া৷ এবার দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখাল খাপ পঞ্চায়েত৷ অথচ সরকার এদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কথা ভাবতেও পারছে না৷ কারণ, বিজেপি এবং তাদের আদর্শগত পরিচালক আর এস এস এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তারই ধারক বাহক৷ এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে খুব মিল ইসলামিক স্টেট, তালিবানের মতো মুসলিম মৌলবাদীদের৷ আসলে এরা সকলে একই ঘরানার৷ এদেরই প্রশ্রয়েই নির্ভয়ে মেয়েদের পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছে খাপ–কর্তারা৷ অবশ্য কংগ্রেস কিংবা অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলির চিন্তার ধাঁচাও একই৷ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধার এরা কেউই ধারে না৷ বিজেপি সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে খাপকে সন্তুষ্ট করে অন্ধ ধর্মান্ধতার আফিমে মানুষকে বুঁদ করে রাখতে চাইছে৷
প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও সমাজে মেয়েদের স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার, চলাফেরা, জীবনযাপনের অধিকার এমন করে পুরুষতন্ত্রের মুঠোর মধ্যে থাকতে পারে কী করে? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সরিয়ে জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি যে সময়ে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করে, তার আগেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার স্তরে পৌঁছে গেছে৷ ফলে এ দেশে সামন্তী মানসিকতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, পিছিয়ে পড়া চিন্তাভাবনা সমাজমনন থেকে সমূলে উৎখাত করার চেষ্টা তেমন করে করেননি এ দেশের রাষ্ট্রনায়করা৷ আজ যখন সংকটে জেরবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেছে, তখন বাঁচার উপায় হিসাবে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের আজ্ঞাবহ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের কায়েমি স্বার্থে এইসব প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতেচাইছে৷দারিদ্র, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার এ দেশের যুবসমাজকে মাদক ও যৌনতার নেশায় ডুবিয়ে রাখতে চাইছে যাতে এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে৷ তাই সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপন, পত্রপত্রিকা সহ সর্বত্র চলছে নারীদেহকে পণ্য করে তোলার প্রতিযোগিতা৷ সঙ্গে চলছে মদ–ড্রাগের ঢালাও প্রসার৷
পরিস্থিতি আজ এমন ভয়াবহ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে দুষ্কৃতীরা কোনও কিছুরই পরোয়া করছে না৷ আট মাসের শিশু থেকে শুরু করে ছেলের সঙ্গে রাস্তায় বেরনো মধ্যবয়স্কা মা–কে দেখেও তাদের পাশবিক লালসা জেগে উঠছে৷
এই নরকই কায়েম রাখতে চায় অন্যায় শোষণের উপর ভর করে কোনওক্রমে টিকে থাকা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষকরা৷
গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ কি এই পরিস্থিতি মেনে নেবে?