সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ভারতের ১০ লক্ষ আশাকর্মীকে ‘গ্লোবাল হেলথ লিডার্স’ সম্মানে ভূষিত করেছেন। কারণ তাঁরা করোনা অতিমারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে রোগীদের সেবা করে গেছেন। বিষয়টা সত্যিই গর্বের এবং আনন্দের। কিন্তু এই সম্মান, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় এঁদের জীবনে সরকারি বঞ্চনার দীর্ঘ বহর দেখলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
বাস্তবে দেশের সরকার আশাকর্মীদের কাজের কানাকড়ি মূল্যও দিচ্ছে না। প্রসূতি মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এঁদের ভূমিকা বিরাট। কার্যত গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যের পুরো দায়িত্বটাই ন্যস্ত আশাকর্মীদের উপরে। অথচ তাদের সরকার স্বীকৃত ন্যূনতম মজুরিও দেওয়া হয় না। ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের আমল থেকে এই প্রকল্প চলছে। বর্তমানে রাজ্যে ৫৬ হাজারেরও বেশি আশাকর্মী কাজ করছেন। সম্প্রতি আরও ২৫০০ জনের নিয়োগ অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু তাঁদের ভবিষ্যৎ কী?
গর্ভবতী মাকে দিনে-রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, সুগার প্রেসার হার্টের রোগী শনাক্ত করা, টিবি রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো, করোনা অতিমারিতে নানা ধরনের পরিষেবা দেওয়া, নুন পরীক্ষা, জল পরীক্ষা, সরকারের খেলা মেলা পরীক্ষার সেন্টারে ডিউটি ইত্যাদি নানা কাজে ২৪ ঘন্টা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন আশাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, বহু প্রকল্পের কাজ এবং দপ্তর বহির্ভূত বহু কাজ বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ বেগার খাটানো হয়।
এ নিয়ে প্রশ্ন করলেই আধিকারিকরা বাস্তবে হুমকি দিয়ে কাজ ছেড়ে দিতে বলেন। এদের বঞ্চনা বহু রকম। বিভিন্ন আইটেমের টাকাও কেটে নেওয়া হয় নানা অজুহাতে। কাজের বিনিময়ে ইন্সেন্টিভ-এর প্রাপ্য সাজানো থাকে লটারির মতো। ৯৯ ভাগ কাজ করেও কোনও কারণে যদি কেউ এক ভাগ কাজ করতে না পারেন তা হলে তাঁর পুরো পারিশ্রমিকই কাটা যায়। এমনই নির্মম কাজের প্রকৃতি। আশাকর্মীদের কোনও প্রকারে ন্যায্য পাওনা না দেওয়ার জন্যই যেন এই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। এগুলি কি কোনও সভ্য শাসনের নমুনা? কংগ্রেস থেকে বিজেপি, সিপিএম থেকে তৃণমূল– সব শাসনেই চলছে সীমাহীন এই বঞ্চনা।
কেন্দ্রীয় সরকার মাসিক ইন্সেন্টিভ ২০০০ টাকা এবং রাজ্য সরকার মাসিক অনারারিয়াম ৪৫০০ টাকা দিয়ে ‘স্বেচ্ছাসেবিকা’ স্ট্যাম্প মেরে আশাকর্মীদের দিয়ে ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ করিয়ে নিচ্ছে। এই ভিক্ষাতুল্য টাকায় সংসার যে চলে না, এটুকু বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান মন্ত্রীদের নেই, এ কথা মানা যায় কি?
অর্ধাহার, অপুষ্টিতে ধুঁকতে থাকা আশাকর্মীরা স্বাস্থ্যকর্মীর স্বীকৃতির আশা নিয়ে ২৪ ঘন্টা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। সপ্তাহের শেষে অন্য কর্মীদের ছুটি থাকে, কাজের মাঝে বিশ্রাম থাকে, আশাকর্মীদের তা নেই। অসুস্থ হলে সামান্য সাম্মানিক ভাতাটুকুও অমানবিক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছর জুলাই মাস থেকে এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত কেন্দ্রের দেয় মাসিক উৎসাহ ভাতা এখনও ঠিকমতো পাচ্ছেন না কর্মীরা। সাত-আট মাস পর্যন্ত বাকি থাকছে। বিভিন্ন খাতের টাকা আটটি ভাগে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। কোন আইটেমের কত টাকা কর্মীরা পাচ্ছেন তা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না তাঁরা। ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন কি না তাও বুঝতে পারছেন না–এমনই নৈরাজ্যের মধ্যে আশাকর্মীরা দিন কাটাচ্ছেন। এই মূল সমস্যার সমাধান না করে বিভিন্ন আধিকারিকরা আশাকর্মীদের প্রশংসাসূচক কিছু কথা বলে দায় এড়িয়ে যান। অথচ সরকারের মন্ত্রী-আমলারা কত শত কোটি টাকা খেলা-মেলা আরাম-আয়েসে নষ্ট করছে।
বহু দিন ধরে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় করেছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। সে অধিকার থেকেও বঞ্চিত আশাকর্মীরা। তাঁদের ২৪ ঘন্টা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের নেত্রী ইসমত আরা খাতুন বলেন, ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার সহ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে স্থায়ী পদে নিয়োগ করে সরকারি স্বীকৃতি ও ন্যূনতম ২১ হাজার টাকা বেতন, কোনও ইন্সেন্টিভ কিংবা অনারারিয়াম নয় ফিক্সড কাজ এবং ফিক্সড বেতন বরাদ্দ করা সহ পেনশন, পিএফ, বোনাস, গ্র্যাচুইটি, মেডিকেল লিভ, মেটারনিটি লিভ এবং সমস্ত ধরনের সামাজিক সুরক্ষা আদায় করার দাবিতে আশাকর্মীরা ধারাবাহিক আন্দোলন জারি রেখেছেন।