ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে আলোচনায় বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা দেশের গরিব এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রসঙ্গ সাধারণত উত্থাপনই করেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অংশের ক্রয়ক্ষমতা এত কম যে, অর্থনৈতিক আলোচনায় এঁরা ব্রাত্যই থেকে যান। তাঁদের আলোচনায় উঠে আসে মূলত মধ্যবিত্তের প্রসঙ্গ। সেই মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক অবস্থা কী?
সমীক্ষা দেখাচ্ছে সেই মধ্যবিত্ত এখন প্রতিদিনকার সংসার খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। কাটছাঁট করছেন পড়াশোনার খরচেও। শেষ বয়সের কথা ভেবে বা জরুরি প্রয়োজনে খরচের জন্য যে সঞ্চয় তাঁরা করেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, সেখানে সঞ্চয়ের পরিমাণও কমছে। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের (এন এস ও)-র সমীক্ষায় ২০১৭-‘১৮ সালে মধ্যবিত্তের এই অর্থনৈতিক দুর্দশা সামনে এসেছে। সমীক্ষায় ২০১৭-‘১৮ সালের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। সাধারণ মানুষ কেন খরচ কমাচ্ছেন? কারণ মানুষের আয় কমে গেছে অথবা অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির সাপেক্ষে আনুপাতিক হারে আয় বাড়েনি।
সমীক্ষা অনুযায়ী মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগের বছর পারিবারিক সঞ্চয়ের হার ছিল ২৩ শতাংশের কোটায়। মোদি শাসনে ২০১৭-‘১৮-তে তা নেমে এসেছে ১৭ শতাংশে। তা হলে প্রধানমন্ত্রী যে আচ্ছে দিনের ঢোল বাজিয়ে গেলেন কয়েক বছর ধরে কোথায় সেই ‘আচ্ছে দিন’?
গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মিলে ধরে নেওয়া যায় জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ বা তার বেশি। এঁরা আজ প্রবল সংকটে। বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সরকারের জনবিরোধী নীতি মিলে জনগণের এই অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর করে তুলেছে।
সমাধান হিসাবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১০০ লক্ষ কোটি টাকা জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কীভাবে তুলে দেওয়া হবে? কোন জনগণ সেটা পাবেন? এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ কর বিধি সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ হল আয়কর কমিয়ে দেওয়া হবে। বর্তমানে ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয়ে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ তা ১০ শতাংশ করা। তা হলে সুবিধাটা কার ঘরে যাচ্ছে? এই সুবিধা তাঁরাই পাচ্ছেন যাঁদের প্রচুর আয়। সাধারণ মানুষের ঘরে এর ছিটেফোঁটাও পৌঁছবে না। ধনীদের আরও সুবিধা করে দিতে সরকার আয়করের উপর ধার্য বর্তমান ৪ শতাংশ শিক্ষা সেস পুরোপুরি তুলে দেওয়ার কথা বলেছে। এটা করা হলে উচ্চ আয়ের মুষ্টিমেয় মানুষ সুবিধা পাবে । কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের শিক্ষার খরচ আরও বাড়বে। তা হলে মোদি সরকার আমজনতাকে কী দিল? তেল তো দিচ্ছে তেলা মাথাতেই।
তা ছাড়াকৃত্রিমভাবে পুঁজিপতিদের রাজকোষের কোটি কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ দিয়ে এই অর্থনীতিকে কত দিন সচল রাখা যাবে? অর্থনীতি যদি স্বাভাবিক বিকাশের পথ হারিয়ে ফেলে স্থবিরতায় আটকে যায়, তা হলে ভেন্টিলেশন দিয়ে তাকে তো বাঁচানো যাবে না। ভেন্টিলেশন রোগীর আয়ুষ্কাল সাময়িক বৃদ্ধি করে মাত্র।
এই সংকটগ্রস্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর নামে মোদি সরকার বিগত ৬ মাসে দফায় দফায় কোটি কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ দিয়েছে। তার স্বাভাবিক পরিণামে জনকল্যাণ খাতে বরাদ্দ কমেছে। আবার সরকার চালানোর জন্য যে টাকা দরকার সেটা তুলতে জনগণের উপরই মূল্য বৃদ্ধি, কর বৃদ্ধির বোঝা চাপিয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ সৃষ্ট সব আর্থিক সংকটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরাতে বিভেদমূলক এনআরসি আনা হলেও সংকটকে আড়াল করতে পারছে না। এই পুঁজিবাদী অর্থনীতি যে আজ আর জনগণকে সংকট ছাড়া কিছু দিতে পারে না, আবার পুঁজিবাদী সরকারের নীতিও যে জনগণের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে রচিত হয় না, মানুষের চোখে তা নগ্ন হয়ে ধরা পড়ছে।