দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির খবরটি প্রকাশ্যে এসেছে। এবিজি শিপইয়ার্ড নামের একটি সংস্থা ব্যাঙ্ক থেকে ২২,৮৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা লোপাট করে দিয়েছে। এসবিআই সহ সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিল সংস্থাটি। সংস্থার তিন ডিরেক্টরের অন্যতম ঋষি আগরওয়াল প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলে প্রকাশ পেয়েছে। গুজরাটের এই সংস্থাটির উত্থান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে। সেই সময়েই সরকারের থেকে নানা সুবিধা পেতে থাকে সংস্থাটি। ঋষি আগরওয়ালকে তখন মোদিজির ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ শিল্প সম্মেলনে দেখা যেত। মুখ্যমন্ত্রীর দক্ষিণ কোরিয়া সফরেরও তিনি সঙ্গী ছিলেন। এই মুহূর্তে তাঁর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ২০০ কোটি টাকা বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই রকম একটি সংস্থা এত বিপুল পরিমাণ ঋণ গায়েব করার সাহস পেল কী করে? এত বিরাট জালিয়াতি এতদিন ধরা পড়ল না কেন? স্টেট ব্যাঙ্ক এতদিন চুপচাপ থাকল কেন? রিজার্ভ ব্যাঙ্কই বা চোখ বন্ধ করে থাকল কী করে? তবে কি এই ধরনের জালিয়াতি ধরার কোনও ব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে নেই? বাস্তবে সমস্ত ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রক রয়েছে, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক রয়েছে, আর্থিক অপরাধ তদন্তকারী এসএফআইও রয়েছে, রয়েছে ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজ্যান্স ইউনিট, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট প্রভৃতি অনেক সংস্থা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলি সংস্থার এমন অদ্ভূত মিলিত নীরবতা কি কোনও সমাপতন নাকি এর পিছনে কোনও বিশেষ কারণ রয়েছে?
দেশে প্রতি বছর কত জন কৃষক আত্মহত্যা করেন? সরকারি হিসেবেও সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। বলা বাহুল্য এই আত্মহত্যার একটা বড় অংশই ঘটে ফসলের লাভজনক দাম না পেয়ে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাঙ্ক তথা পুলিশের আতঙ্কে। কারণ এই ঋণ শোধ করতে না পারলে ব্যাঙ্ক তাঁর জমি, বাড়ি সহ সব সম্পত্তি ক্রোক করবে। গোটা পরিবার পথে বসবে। নিরুপায় কৃষক বাঁচার কোনও পথ না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মাত্র কয়েক দিন আগেই উত্তরপ্রদেশের এক ছোট ব্যবসায়ী রাজীব তোমর দেনায় তলিয়ে গিয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন এবং মৃত্যুর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে গেছেন। সরকারি হিসেবেই ২০১৮ থেকে ২০২০- এই তিন বছরে বেকারত্ব, দেনার দায় বা দেউলিয়া হয়ে পড়ার কারণে প্রতিদিন গড়ে ২৩ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যদিও বাস্তব হল, এমন একান্ত নিরুপায় না হলে কৃষক কিংবা ছোট ব্যবসায়ী সকলেই ঋণ শোধ করে দেন। কিন্তু ঋণের পরিমাণটা যখন এমন হাজার হাজার কোটি টাকা হয়? তখন কিন্তু কোনও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ-প্রশাসন সেই ঋণখেলাপিকে হাতকড়া পরিয়ে লকআপে নিয়ে গিয়ে ভরে দেয় না। ভরে যে দেয় না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ঋষি আগরওয়াল বা অন্য দুই ডিরেক্টর সন্থানাম মুথুস্বামী এবং অশ্বিনী কুমার কেউই এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি। আসলে এমন বিপুল পরিমাণ ঋণ যাঁরা নেন, সব সময়ই সরকার তথা প্রশাসনের উঁচু মহলে তাঁদের দহরম-মহরম থাকে, যোজসাজশ থাকে। সেই খুঁটির জোরেই পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের টিকিটিও ছোঁয় না।
সরকারি সূত্রেই জানা যাচ্ছে, এবিজি শিপইয়ার্ডের ঋণকে অনাদায়ী বা এনপিএ বলে তালিকাভুক্ত করা হয় ২০১৬-তে। ফরেন্সিক অডিটের ভিত্তিতে ২০১৯-এর জুনে এই ঋণকে ‘প্রতারণা’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অথচ সিবিআই সংস্থার বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সিবিআই তদন্ত শুরু করতে এত দেরি করল কেন? যেখানে কয়েক হাজার টাকার ঋণখেলাপিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ এতটুকু দেরি করে না, সেখানে এত বড় বড় জালিয়াতরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারল কী করে?
মোদি জমানায় ঋষি আগরওয়ালই যে এমন জালিয়াতি প্রথম করলেন তা তো নয়। বিজয় মাল্য কিংবা ললিত মোদির জালিয়াতির কথা নিশ্চয়ই বেশির ভাগ মানুষের মনে আছে। আর প্রধানমন্ত্রীর ‘হমারে মেহুল ভাই’ মেহুল চোক্সির কথা তো ভোলার নয়। আর আছে যতীন মেহতা, নীতিন সন্দসেরার মতো জালিয়াতরাও। শুধু মোদি জমানাতেই এই জালিয়াতির পরিমাণটা ৫ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
যে ক্ষেত্রে এমন জালিয়াতিও থাকে না, সে ক্ষেত্রগুলিতেও দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ই এই বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ করে না, কখনও করলেও আংশিক পরিমাণ শোধ করে বাকিটার জন্য হাত তুলে দেন। ঋণের সেই অংশটা কিছু দিন পড়ে থাকার পর ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাকে ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’ (এনপিএ) নাম দিয়ে আরও কিছু দিন ফেলে রাখার পর ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেয়, যাকে বলে ‘রাইট অফ’ করে দেওয়া। তারপর সরকার জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে সেই টাকা দিয়ে দেয়। এর জন্য প্রতি বছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়। অথচ এই সব জালিয়াতরা যে টাকা লুট করে তা যেমন জনগণের কষ্টার্জিত টাকা, তেমনই ব্যাঙ্কগুলিকে সরকার যে টাকা দিচ্ছে, তা-ও জনগণেরই টাকা। জনগণের বেশির ভাগ অংশই যখন চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তখন তাদেরই টাকা নিয়ে এমন জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছে এক দল জালিয়াত। আর সরকারের মদত সেখানে স্পষ্ট। তাই দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি নিয়ে এত হইচই হলেও প্রধানমন্ত্রী এখনও চুপ করেই রয়েছেন।
২০১৪ তে ক্ষমতায় বসার আগে নরেন্দ্র মোদির দেওয়া অজস্র প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই মানুষ ভুলে গেলেও এই প্রতিশ্রুতিটি নিশ্চয় ভোলেনি–‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। কংগ্রেস শাসনে দুর্নীতি যখন লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল তখন দেশের অন্তত কিছু মানুষ ভেবেছিল, বিজেপি শাসনে বোধহয় তার অবসান হবে। বাস্তবে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর অন্য প্রতিশ্রুতিগুলির মতো এটিরও যথারীতি একই পরিণতি ঘটেছে। অবশ্য বিজেপি নেতারা বলবেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বলেই তো আর তা সত্যি হয়ে যায় না। ভোটের আগে এমন কথা বলতে হয়। অমিত শাহের ভাষায়, এ-সবই ‘জুমলা’ মাত্র। প্রধানমন্ত্রী পদটিকে বিজেপি আজ এমন স্তরেই নামিয়ে এনেছে।
আসলে পুঁজিবাদের সঙ্গে দুর্নীতি বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এটা অনেক বড় পণ্ডিতও ধরতে পারেন না। তাঁরা বুঝতেই চান না, পুঁজিবাদ যে মুনাফাকে উৎপাদন ও ব্যবসার মুখ্য উদ্দেশ্য করেছে তা শোষণ-বঞ্চনা-প্রতারণা ছাড়া হয় না। দুর্নীতির উৎসই হল পুঁজিবাদী অর্থনীতি। প্রতারণাই এই ব্যবস্থার ভিত্তি। এই শোষণমূলক আর্থিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসাবে গড়ে ওঠা সরকার, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে এমনকি সব তদন্ত সংস্থাগুলিও তাই এই দুর্নীতি-প্রতারণাকে চাপা দিতেই ব্যস্ত থাকে। প্রবল গণআন্দোলন তথা গণপ্রতিরোধ না হলে, প্রবল সমালোচনার সামনে না পড়লে এ নিয়ে তদন্তের ভড়ংটুকুও হয় না। যদিও বা তদন্ত হয়, রিপোর্ট প্রকাশ হয় না, শাস্তি তো দূরস্থান!
স্বাধীন ভারতে শুরুর দিকে এই প্রতারণার পরিমাণ কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকলেও যত দিন যাচ্ছে ততই তা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠছে। আর বিজেপি শাসনে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের যে ভাবে আইনি-বেআইনি উপায়ে লুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তা নজিরবিহীন। রাষ্ট্রের সম্পদ-সম্পত্তি, কল-কারখানা অবাধে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বিনিময়ে পুঁজিপতিদের আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে বিজেপি দল এবং তার নেতা-মন্ত্রীদের উপর। তাই মাত্র ৭ বছরে বিজেপির ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিপরীতে জনগণের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।
২০১৪ তে দেশের পুঁজিপতিরা শাসন ক্ষমতায় যে বিজেপিকে বেছে নিয়েছিল তা এই শর্তেই যে বিজেপি তাদের অবাধ লুটতরাজের সুযোগ করে দেবে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে, আইনি-প্রশাসনিক কোনও ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে না। প্রয়োজনে সরকার পুরনো আইন বদলে দেবে, নতুন আইন নিয়ে আসবে। পুঁজিপতিদের শোষণ-লুণ্ঠনের বিরদ্ধে গণবিক্ষোভকে দমন করবে। বাস্তবে ঠিক তেমনটিই ঘটছে। সেই জন্যেই নতুন কৃষি আইন, সেই জন্যেই নতুন শ্রম আইন। সেই জন্যেই ইউএপিএ-র কড়াকড়ি। বিনিময়ে পুঁজিপতিরা তাদের ক্ষমতায় বসার এবং টিকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে, ভোটের খরচ জুগিয়ে চলেছে, নেতা-মন্ত্রীদের বিলাস-ব্যসনের ব্যবস্থা করে চলেছে। তা না হলে ঋষি আগরওয়ালরা, ললিত মোদিরা, বিজয় মাল্য, মেহুল চোক্সিরা এমন অবাধে লুঠতরাজ চালাতে পারত না, আম্বানি, আদানিরা রাষ্ট্রায়ত্ত তথা জনগণের সম্পত্তিকে এমন অবাধে আত্মসাৎ করতে পারত না। দেশের জনগণকে আজ এই সত্যটি পরিষ্কার করে বুঝতে হবে যে, পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি পুঁজিপতিদের দেখার জন্যই, এবং তা জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে। এই ব্যবস্থা যত দিন টিকে থাকবে জনগণের দুর্গতি তত দিনবাড়তেই থাকবে।