বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষার সিলেবাসে যে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে তাতে কোনও কিছুই আর অবিশ্বাস্য বা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না, তা বিশ্বের মানুষের কাছে যত হাস্যকরই হোক না কেন। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির অনুসরণে তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’কে চিকিৎসা শাস্ত্রে কার্যকরী করার প্রয়াস হিসেবে সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিন’ আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্নাতক স্তরে জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রয়োগের কোর্স চালু করেছে। সংবাদে প্রকাশ এই কোর্সে ইতিমধ্যে ১০০০ জন শিক্ষার্থী পড়ার জন্য আবেদন করেছে।
এই সংবাদ যতই আজগুবি ও হাস্যকর মনে হোক না কেন, ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আয়ুর্বেদ’-এর উপাচার্য ডঃ সঞ্জীব শর্মার মতে, ‘আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের খুবই সাহায্য করবে, কারণ মানুষের জন্ম কুণ্ডলী অনুসারে গ্রহ ও নক্ষত্রের অবস্থানের পরিবর্তন মানুষের শরীর এবং মনের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলে।’ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল সায়েন্সে-এর চেয়ারম্যান ডঃ সুনীল শর্মা একে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বায়ু, পিত্ত ও কফের ভারসাম্যের অভাবে অনেক রোগ হয় যা গ্রহের অবস্থান অধ্যয়ন করে শনাক্ত করা যায়’।
২৫টি ভিডিও লেকচার সহ ১০ মাসের এই কোর্সের প্রণেতারা দাবি করেছেন, পেটের রোগ, জ্বর, হৃদরোগ, যক্ষা সহ অন্যান্য অসংখ্য রোগের কারণ জ্যোতিষী মতে রোগীর গ্রহ ও রাশির অবস্থানের ভিত্তিতে নির্ণয় করে উপযুক্ত নিদান ও ওষুধ প্রদান করা হবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে, বর্তমানে তার প্রভাব আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানেও কিছুটা পড়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রয়োগ কতটা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়?
জ্যোতিষ মতে সূর্য ও চাঁদ উভয়ই গ্রহ
দেখা যাক জ্যোতিষশাস্ত্র এ ব্যাপারে কী বলে। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতে, আকাশে বর্তমান কয়েকটি জ্যোতিষ্ক বিশেষত নয়টি গ্রহ– সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু এবং কেতু– এর প্রভাব মানব দেহ এবং জীবনে বর্তায়। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক, সূর্য এবং চন্দ্র এরা কেউই তো গ্রহ নয়, সূর্য একটি নক্ষত্র, চন্দ্র একটি উপগ্রহ। রাহু এবং কেতু দুটি মহাকাশের কাল্পনিক বিন্দু, বাস্তবে যাদের কোনও অস্তিত্ব নেই, যেখানে সূর্য এবং পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের অবস্থানের ফলে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ হয়। আরও প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ, মানব শরীরে তার প্রভাব যদি থাকে, তবে যে পৃথিবী গ্রহে আমরা বাস করি তার কোনও প্রভাব নেই! এটা কীভাবে সম্ভব? জ্যোতিষশাস্ত্রে তার কোনও উত্তর নেই।
জ্যোতিষ তিনটি গ্রহের অস্তিত্বই মানে না
বাস্তবে যে তিনটি গ্রহ আছে– ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো, জ্যোতিষ শাস্ত্রে এদের কোনও অস্তিত্বই নেই। এছাড়া পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের প্রভাব থাকলেও মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন এদেরও যে উপগ্রহগুলি আছে যাদের মধ্যে কোনও কোনওটা চাঁদের চেয়েও বড, সেগুলির় কোনও প্রভাব নেই কেন? জ্যোতিষশাস্ত্র এর কোনও জবাব দিতে পারবে না। কারণ, জ্যোতিষ শাস্ত্র যারা লিখেছিলেন (ফলিত জ্যোতিষের প্রথম নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হল বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, যা লেখা হয়েছিল সপ্তম/অষ্টম শতকে) বা ব্যাখ্যা করেছিলেন, তখন ওই তিনটি গ্রহ এবং অন্যান্য উপগ্রহগুলি খালি চোখে দেখা যেত না। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে টেলিস্কোপের সাহায্যে এদের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। খালি চোখে আকাশে প্রায় সাড়ে চার হাজার তারা বা নক্ষত্র দেখা যায় অথচ জ্যোতিষশাস্ত্রে মাত্র ১০৮টি নক্ষত্রের উল্লেখ আছে এবং তাদের প্রভাব আছে। বাকি হাজার হাজার নক্ষত্রের মানব মননে ও জীবনে কোনও প্রভাব নেই কেন? জ্যোতিষশাস্ত্রে এর কোনও জবাব নেই।
জ্যোতিষ শাস্ত্র কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ধারণার বিরোধী
আসলে দেড় হাজার বছর আগে লিখিত জ্যোতিষ শাস্ত্র সেদিনের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে (ভূ-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা) মহাকাশে বিভিন্ন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের গতিবিধি লক্ষ করে এই শাস্ত্রকাররা যা কল্পনা করেছিল আজও জ্যোতিষীরা প্রায় তাই মেনে চলেছেন। কোপার্নিকাস কর্তৃক আবিষ্কৃত সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা অনুযায়ী আধুনিক বিজ্ঞান মহাকাশ এবং মহাজাগতিক জ্যোতিষ্ক সম্পর্কে যে নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে তা তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। আজকের দিনে স্কুল-ছাত্ররাও সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা জানলেও জ্যোতিষীরা কিন্তু পৃথিবী-কেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্ব মেনে চলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের চেম্বারে আধুনিক কম্পিউটর ব্যবহার করেন। কিন্তু তাতেই বিষয়টা আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিদ্যার অনুসারী হয়ে যায় না। কারণ কম্পিউটার একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র মাত্র, তাতে যে ‘ডাটা এন্ট্রি’ করে দেওয়া হবে তার ভিত্তিতেই সেটা পরিচালিত হবে। কম্পিউটার দেখে এবং অধিকাংশ জ্যোতিষীর বুজরুকি কথাবার্তা শুনে অনেকেই সরল বা অন্ধবিশ্বাসে মনে করেন বোধহয় জ্যোতিষশাস্ত্রটা আজকাল বৈজ্ঞানিক রীতিনীতি মেনেই কাজ করছে।
মানব দেহ-মনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই
দেখা যাক গ্রহ নক্ষত্র ও রাশিগুলির প্রভাব মানবদেহ ও মনে কাজ করতে পারে কি না? স্কুলপাঠ্য বিজ্ঞানও যাঁরা অল্পবিস্তর পড়েছেন, তাঁরা জানেন, চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়, এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। এটা যদি সত্য হয় তাহলে পূর্ণিমা এবং অমাবস্যায় বাতের ব্যথা বাড়বে না কেন? অথবা মানসিক রোগে চাঁদের একটা বড় ভূমিকা আছে। এটাই বহুল প্রচলিত ধারণা। দেখা যাক এটা কতটা যুক্তিসম্মত? জ্যোতিষী মতে পূর্বে উল্লেখিত লক্ষ কোটি মাইল দূরে মহাকাশে অবস্থিত গ্রহ নক্ষত্র ও জ্যোতিষ্কগুলির থেকে অজ্ঞাত এক শক্তিশালী বল নির্গত হয়, যার প্রভাব জন্মলগ্নে মানুষের দেহে এবং মনে পড়ে। বাতের মতো বহু রোগের কারণ এটাই। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে কোনও শক্তিশালী ‘বল’ নয়, মহাকাশে একটি মাত্র বল কাজ করে তা হচ্ছে ‘মহাকর্ষীয় বল’ যা অত্যন্ত দুর্বল এবং তা মানুষ সহ প্রতিটি বস্তুর উপরে একইভাবে কাজ করে। জ্যোতিষীরা যদি বলেন, না ‘মহাকর্ষ বল’ নয় এটা অন্য কোনও ‘বল’! তাহলে সেটা কী ও কোনও পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়েছে এবং তা কীভাবে মানুষের শরীরে ও মনে ক্রিয়া করে সেটা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে হবে। কার্য-কারণ সম্পর্ক দেখাতে হবে। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রে এর কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই।
মানবজীবনে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের রেনেসাঁস আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, তার ‘ফলিত জ্যোতিষ’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘চন্দে্রর আকর্ষণে জোয়ার হয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বাড়ে ইত্যাদি যুক্তি, কুযুক্তি। কালকার ঝড়ে আমার বাগানে কাঁঠাল ভাঙিয়াছে, অতএব হরিচরণের কলেরা কেন না হইবে এরূপ যুক্তির অবতারণায় বিশেষ লাভ নাই। গ্রহগুলো কি অকারণে এ রাশি ও রাশি ছুটিয়া বেড়াইতেছে যদি উহাদের গতিবিধির সহিত আমার শুভাশুভর কোনও সম্পর্কই না থাকিবে, এরূপ যুক্তিও কুযুক্তি’। একটি বাক্যের মাঝখানে কারণ এবং অতএব লিখে দিলেই তার দ্বারা কিছু প্রমাণ হয় না। কার্যকারণ সম্পর্কের দ্বারা দুটো ঘটনাকেই সম্পর্কিত হতে হবে।
চাঁদের প্রভাবে মানসিক রোগ– জ্যোতিষ শাস্ত্রের এই বক্তব্য ভ্রান্ত
দেখা যাক, চাঁদের সঙ্গে মানসিক রোগের কী সম্পর্ক আছে? প্রাচীনকালে মানুষ যখন মহাকাশের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি জগৎ সম্পর্কে ধারণা করার চেষ্টা করেছে তখন থেকেই মানুষের মনে চাঁদের প্রভাব আছে। মহাকাশে চাঁদের আকৃতির এবং প্রাত্যহিক গতির দ্রুত পরিবর্তন নানা ধরনের ধারণার জন্ম দিয়েছে– তার মধ্যে বেশ কিছু আজগুবি, অবাস্তব কল্পনা। প্রাচীনকালে মানুষ জ্ঞান ও চিন্তার সীমাবদ্ধতার জন্য চাঁদের গতি প্রকৃতির দ্রুত পরিবর্তনের কার্যকারণ সম্পর্ক ধরতে পারেনি। তারা প্রকৃতির বাহ্যিক সাদৃশ্য থেকে নানা সিদ্ধান্ত করেছে যার বেশিরভাগটাই ছিল ভ্রান্ত। জ্যোতিষের প্রবক্তারা চাঁদের এই অদ্ভুত গতিপ্রকৃতির সাথে মানসিক রোগীর অদ্ভুত আচার-আচরণ বা রোগের সাদৃশ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন যা ছিল ভ্রান্ত।
বহুদিন আগেই বিজ্ঞান বিশেষত মনোবিজ্ঞান মানসিক রোগের কারণগুলি সুনির্দিষ্ট ভাবে বের করেছে এবং তার চিকিৎসাও আবিষ্কৃত হয়েছে। চাঁদের প্রভাবেই যদি মানসিক রোগের সম্ভাবনা থাকতো তাহলে যত মহাকাশচারী চাঁদে পদার্পণ বা তার কাছাকাছি গেছেন তাদের প্রত্যেকেরই (লুনাটিক) মানসিক রোগী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেউ তা হননি। যদিও প্রাচীন কালের এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই মানসিক সমস্যা শব্দটি এসেছে, লুনা অর্থাৎ চাঁদ থেকে। আজও জ্যোতিষীরা দেড় হাজার বছরের ওই পুরনো ধারণা নিয়েই চলছে।
বাতের ব্যথার আবর্তন অমাবস্যা-পূর্ণিমা অনুযায়ী হয় না
এখন দেখা যাক, মানুষের শরীরে বাতের ব্যথা বাড়া কমার প্রশ্নে চাঁদের ভূমিকা কী? প্রচলিত ধারণা হল অমাবস্যা পূর্ণিমায় তা বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে আমরা জানি বাতের ব্যথার একটা নিজস্ব চক্র আছে এবং সেটা প্রতিটি বাতের রোগীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করেছে বাতের এই চক্র চাঁদের মাসিক গতিচক্র ২৯ দিন মেনে হয় না। এটা নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা ও রোগের প্রকোপের উপর, তাই প্রতি পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় যদি বাতের ব্যথা প্রবল হত তাহলে ওই সময় ডাক্তারের চেম্বারে লাইন পড়ে যেত অথবা ওষুধের দোকানে ব্যথার ওষুধের জন্য চাহিদা বাড়ত, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না।
এই চাঁদ সম্পর্কে দীর্ঘ দিনের লালিত বিশ্বাস ও অম্যাবস্যা পুর্ণিমার দিনে বাতের রোগীর উপর মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। যাতে প্রকৃত ব্যথা না হলেও তিনি ব্যথা ভাবতে পারেন। উপরোক্ত ঘটনাগুলি নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণ করে জ্যোতিষ শাস্ত্রের বুজরুকি ও অন্ধবিশ্বাস ভিত্তিক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লোক ঠকানো যেতে পারে, কিন্তু মানুষের ব্যাধির কোনও চিকিৎসা সম্ভব নয়।
যুক্তি নয়, বিশ্বাসনির্ভর শিক্ষাই কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য
তাহলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আসল উদ্দেশ্য কী? নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর থেকেই এই সরকার অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে একে কার্যকরী করতে চলেছে। ইতিমধ্যেই তারা ‘ভারতীয় নয়া নলেজ সিস্টেম নামে একটি ‘সোনার পাথরবাটি’ আবিষ্কার করেছেন (সংঘ পরিবারের মতে, এতদিন যাবৎ আমরা ইউরোপীয় পাশ্চাত্য নলেজ সিস্টেম অনুসরণ করতাম!)। এর মাধ্যমে তারা তথাকথিত সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের আদলে শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে চাইছেন। যার সার কথা হলা, বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহু দূর। অন্যদিকে ডিজিটাল এডুকেশন, ডিজিটাল ইকনমি ও আধুনিক শিল্পের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ শিল্প ও অর্থনীতিতে আধুনিক কারিগরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রয়োগ কর, আর শিক্ষা এবং চিন্তাভাবনার প্রশ্নে উগ্র জাতীয়তা, অন্ধতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতাকে প্রশ্রয় দাও! তাই গণেশের হাতির মাথাতে প্লাস্টিক সার্জারির অনুপম নমুনা দেখা যাচ্ছে! গান্ধারীর শত পুত্রের ক্ষেত্রে স্টেমসেল থিওরির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে! মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট টেলিভিশন পাওয়া যাচ্ছে! পুষ্পক রথে নয় হাজার বছর আগে এরোপ্লেন, এমনকি কোয়ান্টাম থিওরির সাথে অনুলোম বিলোমের মিল দেখানো হচ্ছে!
এ সবই দেশের মানুষকে বিনা তর্কে মেনে নিতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে। না করলে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হতে পারে। তবে এভাবে চললে আগামী দিনে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্র বুজরুকি শাস্ত্রে পরিণত হবে এবং লক্ষ লক্ষ রোগীর জীবন বিপন্ন হবে।
আয়ুর্বেদের প্রবক্তা চরক, সুশ্রুত প্রমাণ ও যুক্তিনির্ভরতার কথা বলেছেন
কেন্দ্রীয় সরকারের এই দূরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আয়ুর্বেদ জগতের লোকেরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। ‘আইআইএসসি’ ব্যাঙ্গালোরের ‘হোমি ভাবা ফেলো’ ও প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ডাক্তার জি এল কৃষ্ণের মতে, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্যোতিষ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তি একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ। এর দ্বারা প্রমাণভিত্তিক যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানের পরিবর্তে বিশ্বাসভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্যোতিষের প্রয়োগ এই চিকিৎসা শাস্ত্রের পদ্ধতিকেই দুর্বল করবে।
ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বিএইচইউ-এর ‘ফিজিওলজি’র প্রখ্যাত প্রফেসর কিশোর পটবর্ধন এর বক্তব্য, আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রণয়ন একটি ক্ষতিকারক দৃষ্টিভঙ্গি। এটা ছাত্রদের মধ্যে কুসংস্কার বাড়াতে সাহায্য করবে এবং তাদের রোগ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ থেকে বিচ্যুত করবে। বিএইচইউ-এর বিশিষ্ট প্রফেসর সুভাষ লাখোটিয়ার অভিমত হল, প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও জ্যোতির্বিজ্ঞানের (জ্যোতিষ শাস্ত্র নয়) উল্লেখ থাকলেও, আধুনিক কালে অন্ধভাবে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতো অন্ধবিশ্বাসভিত্তিক পদ্ধতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনুসরণ করা নিদারুণ ক্ষতিকারক হবে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রবক্তা চরক ও সুশ্রুত ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’, ‘সৈদ্ধান্তিক অনুমান’ ও ‘যুক্তি তর্ক’-কে অনুসরণ করতে বলেছেন। অথচ তার বিপরীতে গিয়ে আজ জ্যোতিষের মতো অন্ধবিশ্বাসকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। এর দ্বারা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ও রোগী উভয়ের ক্ষেত্রেই পরিণাম অত্যন্ত সর্বনাশা হবে। তিনি আরও বলেন, এই কোর্সের প্রথম পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে কোনও রোগীর ক্ষেত্রে জন্মলগ্নে মঙ্গলের বিশেষ অবস্থান তার অস্থি মজ্জাকে দূষিত করবে। এমন শিক্ষার দ্বারা আয়ুর্বেদ ছাত্ররা ‘চালিয়াতি’ ছাড়া আর কী শিখবে?
দেশ জুড়ে প্রতিবাদ
তবে আশার কথা, শুধু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রখ্যাত চিকিৎসক গবেষকরাই নন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন সর্বভারতীয় বিজ্ঞান সংগঠন ‘ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি’, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার’, সর্বস্তরের শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতীদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি’ সহ বিভিন্ন গণসংগঠন ও অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। এরা জনসাধারণের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি ভারতীয় শিক্ষার এই নিম্নগামিতা আমাদের জাতিকে অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা নাগরিকদের এই প্রহসনের নীরব দর্শক হয়ে না থেকে আমাদের দেশে শিক্ষা রক্ষার জন্য প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই’।
(তথ্যসূত্রঃ ‘জ্যোতিষ শাস্ত্র কি বিজ্ঞান’, ব্রেকথ্রু প্রকাশনা, টাইমস অফ ইন্ডিয়া– ২২-০২-২৩, দ্য হিন্দু– ২২-০২-২৩, দ্য টেলিগ্রাফ– ১২-০১-২৩, আজকাল ২২.০২.২৩)