পশ্চিমবঙ্গ মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীদের জয়কে ছাপিয়ে সামনে এল ব্যাপক জালিয়াতি, সন্ত্রাস, কারচুপি ও অর্ধেকের বেশি নকল ব্যালটে ছাপ্পা ভোটের রমরমা৷
এই নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং ৫০ শতাংশের উপর জাল ব্যালটে ছাপ্পা ভোট পডেছে, যা দেশের সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে পদদলিত করেছে৷ এই নির্বাচন চিকিৎসক সমাজের মান মর্যাদা এবং ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে৷ হাইকোর্টের নির্দেশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, শাসক দলের চাপে, নির্বাচন আধিকারিকরা এই নির্বাচনে তার কোনও নিয়মই মানেননি৷ ফলে নির্বাচন ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই শাসক দলের চিকিৎসকেরা অন্যান্য চিকিৎসকদের উপর ব্যাপক ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে এবং নানাবিধ অরাজকতা সৃষ্টি করেছে৷ যেমন,
১) নির্বাচন আধিকারিক শাসক দলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নমিনেশন জমা দেওয়ার জন্য মাত্র চার দিন সময় দিয়েছিলেন যার মধ্যে শনিবার ও রবিবার ছিল ছুটির দিন৷ নির্বাচনটা রাজ্যভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হল না৷
২) নির্বাচন আধিকারিক পোস্ট অফিস থেকে ফেরত আসা ব্যালটের কোনও হিসাবই রাখেননি৷ কোনও রিসিভিং রেজিস্টারও ছিল না৷ হিসাব বহির্ভূত ফেরত আসা ব্যালটকে কাজে লাগিয়ে শাসকদল ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দিয়েছে৷
৩) ভোট গণনার সময় ব্যাপক সংখ্যক জাল ব্যালট পাওয়া যায়৷ ‘এইচ’ প্যানেলের ক্ষেত্রে মূলত দু’ধরনের জাল ব্যালট পাওয়া গেছে৷ এক ধরনের জাল ব্যালটে প্রার্থী তালিকা থেকে মূল ব্যালটের ১১ নম্বরের নামটি বাদ গেছে এবং এক নম্বরের নামটি দুবার ছাপা হয়েছে৷ চাপে পডে নির্বাচন আধিকারিক জানাতে বাধ্য হন এই ব্যালট কাউন্সিল অফিস থেকে ছাপানো হয়নি৷ তা হলে কোথায় ছাপানো হল? কারা ছাপাল? কারাই বা ভোটের কাজে লাগাল? কাউন্টিং করার সময় দেখা গেল এই জাল ব্যালটগুলিতে শাসকদলের প্রার্থীরাই প্যানেল ভোট পেয়েছে৷ তা হলে কারা এ কাজ করেছে?
এর পাশাপাশি আর এক রকমের জাল ব্যালটও ব্যাপক সংখ্যায় পাওয়া গেছে যেটা মূলত কালার জেরক্স৷ দেখা গেছে এই নকল ব্যালটগুলিতে যে ভোট পডেছে তার সবগুলোই সরকার বিরোধী বলে প্রচারিত জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস–এর প্রার্থীদের প্যানেল ভোট৷
সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম এবং মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের ডাক্তাররা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন৷ ফলে কিছু জাল ব্যালট বাতিল হয়৷ যত জাল ব্যালট বাতিল করা গেছে সেই সংখ্যাটা সামগ্রিক ভোটের অর্ধেকেরও বেশি৷ বলাই বাহুল্য কাউন্টিং হলে সারাক্ষণ ঝামেলা চিৎকার চেঁচামেচি চলতে থাকায় অসংখ্য জাল ব্যালট ধরা সম্ভব হয়নি৷
৪) ভোট গণনা শুরুর পর থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে গণনা হওয়ার পরিবর্তে প্রতিদিন মাত্র কিছু সময়ের জন্য ভোট গণনার কাজ চলেছে৷ যার ফলে কাউন্টিং প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে এবং এইভাবে শাসক দলকে পুনরায় জালিয়াতি এবং দুর্নীতির নতুন নতুন সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে৷
৫) ভোটপর্বে শাসক দল চিকিৎসকদের বদলির ভয় দেখিয়ে এবং প্রোমোশন সহ অন্যান্য প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বিপুল সংখ্যক ব্যালট সংগ্রহ করেছে৷ গণনা চলাকালীন ক্রমাগত বিরোধীদের উপর চডাও হওয়া, ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে৷ নির্বাচন আধিকারিক ও কর্মীদের শাসক দলের হয়ে কাজ করানো এবং নির্বাচন আধিকারিকের শাসক দলের হয়ে নির্লজ্জ দালালি এসবই চলেছে৷
৬) এই সীমাহীন দুর্নীতির প্রতিবাদে গণনা চলতে চলতেই চতুর্থ দিনে এই নির্বাচন বয়কট করে এবং ওয়াক আউট করে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও এসডিএফ৷
৭) এই দুটি সংগঠনের দাবি, সকল জাল ব্যালট ফরেন্সিক ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হবে৷ পাশাপাশি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে এই সকল জাল ব্যালটের উৎস এবং সংশ্লিষ্ট দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে৷ তাদের পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হয় এবং বিচার চেয়ে হাইকোর্টে মামলা করা হয়৷
এই নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়েছে স্বৈরাচার৷ পদদলিত হয়েছে গণতন্ত্র৷ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে চিকিৎসক সমাজ তথা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজের মান মর্যাদা৷ এই নির্বাচনে যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, যারা চুরি বিদ্যার আশ্রয় নিয়েছে, বিরোধী শিবিরের চিকিৎসকদের উপর ছোট বড় নানা কারণে চড়াও হয়েছে তাদের সাথে কোনও ভাডা করা গুণ্ডার পার্থক্য নেই৷ অথচ তারা এই সমাজের উঁচুতলার এবং উচ্চশিক্ষিত বলে মানুষের সমাদর পাওয়া চিকিৎসক সমাজেরই একটা অংশ৷ এ লজ্জা ঢাকা পড়বে কীসের আড়ালে?