মালিকের মুনাফা–লালসা ও সরকারের অবহেলাই দায়ী
কাগজের প্রথম পাতা থেকে ভিতরের পাতায় সরে গেছে খবরটা৷ মানুষের মন থেকেও খানিকটা হারিয়ে গেছে মেঘালয়ের কসান খনির মধ্যে আটকে পড়া ১৬ শ্রমিকের যন্ত্রণার কথা৷ পানীয় জল, খাদ্য, বাতাসহীন অবস্থায় দিনের পর দিন খনির অতল গহ্বরে তাঁদের আত্মরক্ষার লড়াইয়ের কথা৷ আসাম থেকে আসা ও স্থানীয় কিছু শ্রমিক ১৩ ডিসেম্বর থেকে খনিগহ্বরে জলমগ্ন অবস্থায় আটকে পড়েছেন৷ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই অবৈধ খনিতে এক মাসের বেশি তাঁরা কীভাবে রয়েছেন খোঁজ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ৷ ২০১৪ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণার পরেও এই ‘Rat Hole’ খনিগুলি চলছে কীভাবে? উত্তর সহজে মিলবার নয়৷ অবশেষে এক মাস তিন দিন পরে ১৬ জানুয়ারি এক শ্রমিকের দেহাংশের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ তাও নৌসেনার দূরনিয়ন্ত্রিত যানের সঙ্গে লাগানো অত্যাধুনিক ক্যামেরার সাহায্যে৷ বাকিদের মর্মান্তিক পরিণতি নিয়েও আর কোনও সন্দেহ নেই৷
খনিগহ্বরে অসহায় শ্রমিকদের এভাবে মৃত্যুই কি ভবিতব্য? এই সমস্ত খনিতে অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতিতে ও পুরোপুরি নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কয়লা তোলা হয়৷ এভাবে কয়লা উত্তোলনে খরচ অত্যন্ত কম, ফলে মুনাফা হয় বেশি৷ এই বিষয়ে কয়েকটি সমীক্ষক সংস্থা, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল, মেঘালয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ইত্যাদি মাঝে মাঝে কিছু কাগুজে সতর্কবাণী দেয়৷ ভূমিকম্প প্রবণ ও নরম মাটিপূর্ণ মেঘালয়ের পাহাড়ে এই ‘Rat Hole’ খনি যে কী মারাত্মক তা বারবার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন৷ মালিকরা যথারীতি তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করে না৷ পরিবেশ দূষণ এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও তাদের জীবনের বিনিময়ে মালিকরা কেবল লাভের অঙ্কই বাড়িয়ে চলে৷ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এক শ্রমিকের মায়ের কথায় চরম অসহায়তা ফুটে উঠেছে– খনিতে যেতে নিষেধ করেছিলাম৷ কিন্তু আর কোনও কাজ না পেয়ে সংসার চালানোর জন্য ও গেছে৷ খনির কাজে না গেলে অনাহারে মৃত্যু, আর খনিতে গেলে দুর্ঘটনায়, মালিকের দায়িত্বহীনতায় মৃত্যু– আজও কেন এরই যে কোনও একটাকে কেন বেছে নিতে হচ্ছে শ্রমিকদের?
খনিমালিকদের ক্রমবর্ধমান লালসা মেটাতে শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, মালিকের মুনাফা বাড়াতে অহরহ জীবন বলি দিতে হয়৷ খনি গহ্বরে হিমশীতল অন্ধকারে, সংকীর্ণ সুড়ঙ্গের মধ্যে দমবন্ধকর পরিবেশে দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যায় তারা৷ উদ্ধারকারীরা এখন বলছেন, ওই সুড়ঙ্গে একটা মানুষের উবু হয়ে বসার মতো জায়গা নেই৷ দিনের শেষে যখন বাড়ির পথে পাবাড়ায় শ্রান্ত–ক্লান্ত–ক্ষুধার দেহে, তখন পরের দিন কাজ করার মতো অবস্থা থাকে না৷ তবুও অভাবের জ্বালায় আবার তাদের নামতে হয় ওই ইঁদুরের গর্তে৷ নিত্যদিনের গতিপথে শ্রমিকরা মালিকের কাছে এক একটা সংখ্যামাত্র৷ খনি–ধসে শ্রমিক মৃত্যুর বহু ঘটনা সংবাদমাধ্যমে খবরও হয় না৷ কারণ প্রত্যন্ত ও সংকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলের বহু দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকে না কেউ৷ ফলে সেগুলি ধামাচাপা পড়ে যায়৷ মালিকরা দালালের মাধ্যমে খনি শ্রমিকের পরিবারের হাতে নামমাত্র অর্থ গুঁজে দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করে৷ নিরন্ন–সহায় শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয় তা মেনে নিতে, কখনও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷ কিন্তু অসহায়, অসংগঠিত গরিব মানুষ গলা তুলে কথা বলতেও ভয় পায়৷ মালিকের পোষা গুণ্ডাবাহিনী মারধোর করে শায়েস্তা করতে নামে৷ ভয় দেখিয়ে হুমকি দিয়ে অথবা পরিবারের কাউকে খনিতে কাজ দেওয়ার নাম করে একটা মিটমাটের চেষ্টা করে৷ আবার নতুন শ্রমিক খুঁজে আনে মালিকের দালালরা৷
শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ মালিকদের কাছে বেশি লাভজনক৷ ‘ইঁদুরের গর্ত’ এই খনিগুলিতে হামাগুড়ি দিয়ে সহজে ঢুকে শিশুরা কয়লা সংগ্রহ করতে পারে৷ মজুরিও কম দিলে চলে যায়৷ এই হচ্ছে প্রতিটি খনির ইতিহাস৷ মেঘালয়ের জয়ন্তী ও গারো পাহাড়ের খনিগুলিও সেরকমই৷ কর্তৃপক্ষের ১ লাখ ক্ষতিপূরণ হাতে পেয়ে খনিগহ্বরে সন্তান হারানো পিতা রহমানের মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তি– আমার সন্তানের দাম মাত্র ১ লাখ৷ যদিও মৃতদেহ না পাওয়া গেলে কিংবা মৃতের পরিজনরা উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে না পারলে ক্ষতিপূরণটুকুও দেওয়া হয় না৷
পুঁজিবাদী এই সভ্যতা হাজার–লক্ষ টাকায় মানুষের দাম ধার্য করে৷ দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু সংখ্যা মুছে দেয় শ্রমিক–তালিকা থেকে৷ এবার মেঘালয়ে আটকে পড়া স্থানীয় তিন শ্রমিক ফিরে আসায় এবং একসাথে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিখোঁজ হওয়ায় সাড়া পড়েছে কিছুটা৷ ওই শ্রমিকদের বেশিরভাগই আসাম, এমনকী নেপাল থেকেও আসেন পেটের দায়ে৷ মহাজনদের থেকে ধার নিয়ে চাষ করতে গিয়ে মহাজনের পাহাড়প্রমাণ সুদের খপ্পরে পড়ে এদের ঋণগ্রস্ত দশা৷ ফলে চাষ করে কিছু আয় হলেও তা মহাজনের পকেটেই চলে যায়৷ বিকল্প কাজ নেই৷ দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটের মতো দূরবর্তী রাজ্যে পাথরখাদানে কাজ করা কষ্টকর শুধু তাই নয়, পাথরখাদানে কাজ করতে গিয়ে গত বছরে আসামের একটা গ্রাম থেকেই শুধু ২০০ জন যক্ষ্মা ও শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন৷ খনির তুলনায় খাদানে মাইনেও কম৷ ফলে ধার শোধ করতে অভাবি মানুষগুলিকে ছুটতে হয় মেঘালয়ের মৃত্যু গহ্বরের দিকে৷ খনিতে কয়লা প্রায় নিঃশেষ জেনেও মালিকরা নিত্যনতুন ফাঁদ পাতে আর তাতে পা দিয়ে শেষ হয়ে যায় ১২ থেকে ২৫ বছরের অসংখ্য শ্রমিক৷ মেঘালয়ের দুর্ঘটনাগ্রস্ত খনিতেও কয়লা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ অন্য খনিতে কাজ দেওয়ার চুক্তি করে কিংবা বকেয়া পাওনা–গণ্ডা মেটানোর অজুহাত দিয়ে বহু শ্রমিককে জোর করে আটকে রেখেছিল মালিকের ভাড়াটে গুণ্ডারা৷
মেঘালয়ের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে তৎপর হয়ে উঠেছে৷ আসামের বিজেপি সরকারও শ্রমিকদের মৃত্যু গহ্বর থেকে ফিরিয়ে আনার কোনও চেষ্টাই করেনি৷ জল বের করা যাচ্ছে না অজুহাত দিয়ে মেঘালয় সরকার হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে দীর্ঘদিন৷ অন্য কোনও রাজ্যের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প ব্যবহার করে কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায়, মিলিটারি নামিয়ে, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমের সাহায্যে এই মানুষগুলির উদ্ধারে কি এগিয়ে আসতে পারত না সরকার? খনি মালিক জানত খনি বহুদিন থেকে প্লাবিত৷ যে কোনও সময় ভেসে যেতে পারে শ্রমিকরা৷ তাও নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেনি৷ খনি মেরামতে যুক্ত এক ব্যক্তি বলেছেন, ‘খনিতে সারাক্ষণই জল থাকত৷ আমার কাজ ছিল শ্রমিকরা ঢোকার চার–পাঁচ ঘণ্ঢা আগে জল ছেঁচে ফেলা, কিন্তু জল জমা বন্ধে কর্তৃপক্ষ কোনও উদ্যোগ নিত না৷ কারণ আরও ১০০০টি খনি টানেলের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ তা একটা সমুদ্রের রূপ নিয়েছিল৷’ মুনাফায় যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য শ্রমিকদের জীবন চরম বিপদসীমায় রয়েছে জেনেও মালিকদের ঘাঁটায়নি সরকার৷ তার পরিণাম হঠাৎ প্রবল জলস্রোতে ভেসে যাওয়া শ্রমিকদের অসহায় মৃত্যু৷ মালিকরা জানে এই অপরাধমূলক কাজকর্ম করলেও তাদের কোনও শাস্তি হবে না, এমনকী জবাবদিহি করারও প্রয়োজন নেই৷ কারণ তাদের উপর রয়েছে সরকারের আর্শীবাদ৷ কংগ্রেস, বিজেপি থেকে শুরু করে তথাকথিত আঞ্চলিক স্বার্থের ধ্বজাধারী সব ভোটবাজ দলের নেতারা এদের পয়সায় পুষ্ট৷ এই মালিকদের ধরবে কে?
আর এত ‘মন কি বাত’ করেন যে প্রধানমন্ত্রী তিনিও চুপ করে বসে রইলেন৷ এই ঘটনার পর তিনি আসামে গিয়ে ব্রিজ উদ্বোধন করে ছবিতে পোজ দিয়েছেন, কিন্তু পাশের রাজ্য মেঘালয়ে গিয়ে শ্রমিকদের খুঁজে বের করা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি৷ কারণ এই খবরের টিআরপি নেই, যাতে ভোটবাক্স ভরাতে কাজে লাগতে পারে৷ উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে গুজরাটে ২০০ ফুট উঁচু বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি উদ্বোধন হয়ে গেল, কিন্তু ৩০০ ফুট নিচে জলের তলায় খনি শ্রমিকদের কাছে কোনও যন্ত্র পৌঁছনো গেল না একটু অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে ৩০০০ কিমি রেলপথ ২০ ঘন্টায় অতিক্রম করার বুলেট ট্রেন চালু করার জন্য মোদিজিদের ঘুম নেই৷ কিন্তু এই শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন ছিল একটুকরো খাবার, একটু অক্সিজেন যা অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে অনায়াসেই করা যেত৷ তা করা হল না৷ সরকার কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে উদ্ধারের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প আনতে ১৫ দিন পার হয়ে যায়? এই মর্মান্তিক ঘটনা যে সংবাদমাধ্যমে পিছনে চলে যায়, সেখানে প্রতিদিন চলে মোদি–রাহুল তরজা৷ কে কার সঙ্গে আলিঙ্গন করছে, কে কার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছে তাই নিয়ে ঘণ্ঢার পর ঘণ্ঢার ধারাবিবরণী, পাতার পর পাতা লেখা চলছে৷ কিন্তু খনি শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই৷ রাহুল গান্ধীও সত্যি যদি কিছু করতে চাইতেন, মেঘালয়ের কংগ্রেস সরকারকে তিনি হাত গুটিয়ে থাকতে দিলেন কেন? কোনও পদক্ষেপ নিতে পারলেন না কেন?
মালিকরা অবৈধ খনি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে, আর সরকার–প্রশাসন তাদের মদত জোগাচ্ছে৷ শ্রমিকরা মরলেও সরকারের কিছু আসে যায় না৷ কারণ এই খনি মালিকরাই নির্বাচনে টাকা জোগাচ্ছে ক্ষমতাশালী দলগুলিকে৷ ফলে পরস্পরের বোঝাপড়ায় এই অবৈধ খনিগুলি চলছে অবাধে৷ এই দুষ্টচক্রের ফাঁদেই বলি হতে হচ্ছে অসংখ্য শ্রমিককে, মেঘালয়ের খনি শ্রমিকদের মর্মান্তিক পরিণতিও সে কারণেই৷