হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল মিছিল ১৯ অক্টোবর আছড়ে পড়ল মেক্সিকো–গুয়াতেমালা সীমান্তে৷ হন্ডুরাস থেকে আসা ঘরছাড়াদের এই স্রোতে রয়েছেন সকল বয়সের মানুষ, এমনকী শিশু কোলে মা–বাবারাও৷ মেক্সিকোর মধ্য দিয়ে এঁরা পৌঁছতে চান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কাজের খোঁজে, জীবনের খোঁজে৷ কিন্তু সীমান্তে পৌঁছেই বাধা পড়েছে চলায়৷ মেক্সিকোর সীমান্তরক্ষী বাহিনী কাঁদানে গ্যাস আর লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে তাঁদের৷ কিন্তু আটকানো যায়নি মরিয়া মানুষগুলিকে৷ ২২ অক্টোবরের খবর অনুযায়ী আমেরিকার দিকে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা৷
বেশ কয়েক বছর ধরেই মধ্য আমেরিকার নর্দার্ন ট্র্যাঙ্গল নামে পরিচিত তিনটি দেশ গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদর থেকে প্রায়ই অভিবাসীদের স্রোত ধেয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কোন বাধ্যতায় নিজের ঘরবাড়ি–পরিজন ছেড়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও আমেরিকায় চলে যেতে চাইছেন? চূড়ান্ত অর্থাভাব ও সন্ত্রাসের অসহনীয় পরিবেশই তাঁদের বাধ্য করেছে দেশ ছাড়তে৷ সন্তানদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাবার নেই, চিকিৎসা করাবার পয়সা নেই, এমনকী গাড়িভাড়াটুকু জোগাড় করারও সামর্থ্য নেই আজ হন্ডুরাসের সাধারণ মানুষের৷ ব্যাপক সন্ত্রাসের পরিবেশ ছারখার করে দিচ্ছে তাঁদের জীবন৷
মধ্য আমেরিকায় দেশগুলোর এমন হাল কেন? এখানে বছরের পর বছর ধরে রাজত্ব করছে গৃহযুদ্ধ আর মিলিটারির দাপট, যার পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মুনাফা লুটের স্বার্থ৷ নিজের দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে এই অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে চলেছে ক্ষমতাসীন সরকারগুলি৷ প্রতিবাদে যখনই জোট বাঁধার চেষ্টা করেছে শ্রমিক–চাষির দল, মার্কিন মদতপুষ্ট এইসব সরকার চরম দমন–পীড়ন চালিয়ে সে আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে৷
ম্যানুয়েল জেলায়ার নেতৃত্বে হন্ডুরাসে একসময় প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একটি সরকার ক্ষমতায় ছিল৷ ২০০৯ সালে মার্কিন মদতপুষ্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে জেলায়া সরকারের পতন ঘটে৷ এর পর থেকেই হন্ডুরাসে সরকার গঠন করে আসছে দক্ষিণপন্থীরা, যাদের পিছনে সমর্থন জোগাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশ জুড়ে চলছে প্রতিবাদী মানুষ ও সাংবাদিকদের উপর দমন–পীড়ন এমনকী হত্যা৷ গত বছর বর্তমান প্রেসিডেন্ট জুয়ান অর্লান্ডো হার্নান্ডেজ ব্যাপক দুর্নীতি করে ফের ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসেন৷ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশের মানুষ৷ শুরু হয় চরম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস৷ সেই সন্ত্রাস আজও চলছে৷ হন্ডুরাসের বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে যোগসাজশে নিজের দেশের কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এতে মদত দিয়ে চলেছে৷ সৃষ্টি হয়েছে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থা৷ ফলে দলে দলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে হন্ডুরাসের মানুষ৷
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কারণে এই মানুষগুলি ঘর ছাড়তে বাধ্য হলেও এঁদের নিজের দেশে জায়গা দিতে কিন্তু রাজি নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ মেক্সিকো সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকা আদেশ জারি করেছে এদের যেন মেক্সিকোয় ঢুকতে দেওয়া না হয়৷ যদিও মেক্সিকো পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করেও অভিবাসীদের আটকাতে পারেনি৷ পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকা–মেক্সিকো সীমান্তে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ফলে আরও এক দফা আক্রমণ–ত্যাচারের সামনে পড়তে চলেছেন ঘরছাড়া অসহায় মানুষগুলি৷ এর আগে শরণার্থীর ঢল আটকাতে মেক্সিকো সীমান্তে শিশু সন্তানদের মা–বাবার কাছ থেকে আলাদা করে দিতেও হাত কাঁপেনি ট্রাম্প প্রশাসনের, যার বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল৷
(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)