অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে মূল্যবৃদ্ধি আজ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আলু ৪০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ৮০ টাকা, অন্যান্য সব্জি ৪০-৫০-৬০ টাকা কেজি। ডাল, তেল সহ সব পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। করোনা সংক্রমণে লকডাউনের কারণে শ্রমজীবী মানুষের বিরাট অংশের যখন কাজ নেই, রোজগার বন্ধ, আরেকটা বড় অংশের বেতন কমে গেছে, তখন নজিরবিহীন এই মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাত সহ্য করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মানুষ মূল্যবৃদ্ধিতে হাসফাঁস করছে। কী করে পরিবার প্রতিপালন করবে, আত্মীয়তা সামাজিকতা রক্ষা করবে ভেবে কুল পাচ্ছে না। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, ওষুধপত্র সহ সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস, ট্রেন, অটো রিক্সা, টোটো সহ সব পরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দিকে রোজগার কমছে। করোনার চিকিৎসা করাতে গিয়ে কত পরিবার যে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে, অনাহারের মুখে পড়ছে তার কোনও শেষ নেই। চাষিরা চাষের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে অতিরিক্ত আক্রমণের শিকার। বীজ আলুর দাম এই মুহূর্তে ৮০-৯০ টাকা কেজি। এমনিতেই ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান উদ্বেগজনক। মূল্যবৃদ্ধির ধাবমান রথ থামাতে না পারলে অর্ধাহারে অনাহারে অপুষ্টিতে মৃত্যুমিছিল বাড়তেই থাকবে।
উদ্বেগজনক হল মোদি সরকারের ভূমিকা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য যখন জরুরি ছিল মজুতদারি কালোবাজারি বন্ধ করা, জরুরি ছিল ভর্তুকি দিয়ে মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখা, জরুরি ছিল পরিবহনের ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা, তখন বিজেপি সরকার উল্টো কাজ করল। অতিমারির সুযোগ নিয়ে এক মারাত্মক কৃষি আইন চালু করল, যার মধ্যে দিয়ে মজুতদারি, কালোবাজারির ফ্লাডগেট খুলেদেওয়া হল। বহু কৃষিপণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। মোদি সরকার ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে পরিবর্তন এনে বলেছে, এখন থেকে খাদ্য শস্য, ডাল, তৈলবীজ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আলু আর অত্যাবশ্যক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকছে না। এর অর্থ হল এগুলো ইচ্ছামতো মজুত করা যাবে। বলা বাহুল্য এই আইন আনার পরেই আলু, পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ফলে মোদি শাসনে বৃহৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের পোয়া বারো। তারা মজুতদারি, কালোবাজারির মধ্য দিয়ে বিরাট মুনাফা করার সুযোগ পেয়ে গেল। তারা মোদির জয়গান গাইছে, বিজেপিকে মদত দিচ্ছে। আর জনগণ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ভাবছে বাঁচার পথ কী?
একদল মেকি বামপন্থী সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিচ্ছে দিদিভাই-মোদিভাই মূল্য বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। কথাটা সত্য। কিন্তু যে নির্মম সত্য তাঁরা বলতে পারছেন না তা হল, বামফ্রন্ট শাসনেও মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সিপিআইএম শাসিত কেরালাতেও মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারে বাম ডান যারাই যাক, তারাই যে পুঁজিপতিদের স্বার্থে মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন দেয়– এই সত্য জনগণের সামনে তারা তুলে ধরছে না। তারা কংগ্রেস, বিজেপির মতোই বলছে মূল্যবৃদ্ধির জন্য অন্য দলের সরকার দায়ী। কেন তাঁরা এভাবে বলছেন? অন্যান্য শাসক দলের মতোই তারা মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ যে পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাকে জনগণের রোষ থেকে আড়াল করতে চায়। সেজন্য ওপর ওপর কিছু প্রতিবাদ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই মূল্যবৃদ্ধি থেকে মানুষকে রেহাই দিতে পারে, সে কথা বলে না।
এই অবস্থায় জনগণের সামনে করণীয় কী? মূল্যবৃদ্ধি রোধে সুনির্দিষ্ট ভাবে দাবি তুলতে হবে– ১) সমস্ত খাদ্য পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকায় আনতে হবে, ২) মজুতদারি বৃদ্ধি আইন বাতিল করতে হবে, ৩) মজুতদারি ত্বরান্বিত করার কৃষি আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে, ৪) কৃষি উপকরণ সার বীজ কীটনাশকে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিতে হবে, ৫) পণ্য পরিবহনের খরচ কমাতে ডিজেলে কেন্দ্র ও রাজ্যের ট্যা’ কমাতে হবে, ৬) পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী রেলকে বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, ৭) খাদ্যপণ্যের খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা সরকারি উদ্যোগে পরিচালনা করতে হবে। এই দাবিগুলো কার্যকর করলে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা মানুষের মুখের গ্রাস নিয়ে মুনাফাবাজি সহজে করতে পারবে না।
কিন্তু সরকার সহজে এই দাবি মানবে না। কারণ জনগণের দাবি শোনার মতো গণতান্ত্রিক মনোভাব এই সরকারগুলির নেই। তাই তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। আশার কথা, এই ধরনের আন্দোলন পরিচালনার জন্য রাজ্যে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে নাগরিক প্রতিরোধ মঞ্চ। তাকে শক্তিশালী করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি এই আন্দোলনের পাশাপাশি এই মুহূর্তের কর্তব্য হল ২৬ নভেম্বরের সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল করা। কারণ এই ধর্মঘট মূল্যবৃদ্ধিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার, মজুতদারি বৃদ্ধির আইন বাতিল করার দাবি তুলে ধরেছে।