মূল্যবৃদ্ধিতে প্রাণান্ত অবস্থা সাধারণ মানুষের, বেকারির হার বেড়েই চলেছে। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-রপরিসংখ্যান, শহরাঞ্চলে বেকারির হার বেড়ে আবার ১০ শতাংশের মুখে পৌঁছেছে। বেড়েছে গ্রামাঞ্চলেও। দেশে সার্বিকভাবে তা ৮.৪৩ শতাংশ। গত দু’মাসে দেশের খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্ধারিত সহনসীমার (৬ শতাংশ) উপরে। মে মাসে তা আরও বাড়বে। এতে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার হবে ১৬ মাসে সর্বোচ্চ। মূল্যবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বেকারি। ২০২১-এর ডিসেম্বরের ওই সংস্থার রিপোর্ট বলছে, কাজ খুঁজছেন এমন বেকারের সংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লক্ষ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ কাজ খোঁজা ছেড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া আছেন অসংখ্য কর্মহীন মানুষ, যারা এই তালিকার বাইরে রয়েছেন।
সরকার হিসেব দিচ্ছে কর্মসংস্থান বাড়ছে। গত আট বছরে কয়েক লক্ষ কাজ যদি হয়েও থাকে, ছাঁটাই হয়েছে কতজন? ৭ হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। এর কি জবাব দেবেন নেতারা? আসলে বেকার সমস্যা নিরসনে কেন্দ্র-রাজ্য কোনও সরকারেরই হেলদোল নেই। ‘বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির’ প্রতিশ্রুতি বিলোনো মোদি সরকার কিংবা ‘বছরে ২ লক্ষ কর্মসংস্থানের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাজ্যের তৃণমূল সরকার বেকারির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে টুঁ শব্দটি করছে না। সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
কয়েক বছর ধরে ছাপাখানাতে মেশিন চালানোর কাজ করতেন রমেশ। পানিহাটি থেকে আসতেন মধ্য কলকাতায়। দু’বছর লকডাউনের পর বন্ধ ছাপাখানা খুললেও কয়েক দিন পর থেকেই বেতন অনিয়মিত হতে শুরু করে। তাও মেনে নেন কর্মচারীরা। অবশেষে ব্যবসায় মন্দার অজুহাতে মাইনে কাঁটছাঁট। মালিকের কাছে জবাব চাইতে গিয়েই বাঁধল ফ্যাসাদ। দারোয়ান ও হিসাবরক্ষক বাদ দিয়ে সকলকেই ছাঁটাইয়ের নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হল। রমেশের বাড়িতে বৃদ্ধ-অসুস্থ মা, তিন ভাইবোন। তাঁর রোজগারেই কোনওরকমে সংসার চলত। ছাঁটাইয়ের নোটিশ হাতে নিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি রমেশ। সহকর্মীদেরও এক দশা। এরকমই পরিণতি অসংখ্য রমেশের।
শুধু ছাপাখানা বা ক্ষুদ্র শিল্প নয়, মাঝারি শিল্পও আজ চরম সঙ্কটগ্রস্ত। ছাঁটাই চলছে অবাধে। নামকরা বহুজাতিক সংস্থা কিংবা নানা কোম্পানি কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ ভাবে ছাঁটাই করছে। বহু সংসারে বৃদ্ধ বাবা-মার ওষুধ বন্ধ, ছেলেমেয়ের শিক্ষা বন্ধ, অসুস্থদের পুষ্টিতে কোপ পড়ছে, অবসাদগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য বেকার যুবক-যুবতী।
‘সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের পরিধি বাড়ছে’ বলে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক যতই প্রচার চালাক, সরকারেরই প্রকাশিত ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের রিপোর্ট তার ‘উজ্জ্বল’ ভাবমূর্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ওই সময়ে সারা দেশে বেকারির হার ছিল ৬.১ শতাংশ, যা সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ। এই রিপোর্ট বিজেপি সরকার ধামাচাপা দিতে চাইলেও পারেনি। বর্তমানে রেল, বিমা, ব্যাঙ্ক সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ায় বেকারির হার যে আরও বাড়ছে, সেটা বিজেপি সরকার জানে না তা নয়! সংগঠিত নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হাল কী? উৎপাদন, নির্মাণ, বাণিজ্য, পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে চাকরির কী পরিমাণ সুযোগ রয়েছে তা দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন! সর্বত্র আর্থিক মন্দার অজুহাতে ছাঁটাই, লে-অফ, লকআউট চলছে অবাধে।
মূল্যবৃদ্ধি বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য কতখানি দায়ী? মূল্যবৃদ্ধি হলে চাহিদা কমে, উৎপাদনও কমে। উৎপাদনের সাথে যুক্ত কর্মীরা কাজ হারায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণামে বাজার সংকট, নতুন কলকারখানা না খোলা, সর্বোপরি সরকারের পুঁজিপতি তোষণকারী নীতিই এর জন্য দায়ী। সরকারি সংস্থায় নিয়োগ প্রায় বন্ধ, চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে শূন্য পদ বিলোপ করছে বিজেপি সরকার। রাজ্যের তৃণমূল সরকারও তাই করছে। অন্য দিকে কাঁচামাল, জ্বালানি সহ সমস্ত জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ছোট-মাঝারি বেসরকারি সংস্থাগুলি বড় সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারছে না। ফলে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক। কর্মী ছাঁটাই বাড়ছে। ইস্পাতের দাম বাড়ায় নির্মাণ কাজে ভাটা পড়েছে। ছাঁটাই চলছে, নতুন লোক নিয়োগও বন্ধ। পরিবহণ শিল্প পেট্রোপণ্যের ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রচণ্ড পরিমাণে ধাক্কা খেয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু পরিবহণ শ্রমিক ও কর্মচারী রুজি হারিয়েছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের অবস্থা সব থেকে খারাপ।
কেন্দ্রীয় সরকার উৎপাদন শুল্ক ছেঁটে এবং তেল কোম্পানিগুলির অতি মুনাফার রাশ টেনে তেলের দাম কমানোর ব্যবস্থা করলে মূল্যবৃদ্ধিতে পিষ্ট জনগণ কিছুটা সুরাহা পেত। রাজ্য সরকারও তেলের উপর থেকে ট্যাক্স প্রত্যাহার করলে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি পেত গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা। বেকার যুবকেরা কিছুটা হলেও রেহাই পেত। কিন্তু কোনও সরকারই তা করছে না। এই অবস্থায় বিরাট অংশের মানুষের হাতে টাকাই নেই। ক্রয়ক্ষমতা নেই। একমাত্র রোজগেরে লোকের কাজ চলে যাওয়ায় বহু পরিবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধি-বেকারির এই জোড়া আক্রমণ থেকে রেহাই মিলবে কী করে? পুঁজিবাদী অর্থনীতি কোনও দিশা-ই দেখাতে পারছে না। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের নানা টোটকায় মুমূর্ষু এই সমাজের ক্ষতে সাময়িক প্রলেপ হলেও স্থায়ী মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। এই ব্যবস্থার রক্ষক পুঁজিপতিদের সেবা করছে যে সরকারগুলি, তাদের জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করতে হবে।
পুঁজিপতিদের পছন্দের এ-দল কিংবা ও-দলকে ভোটের মাধ্যমে শুধু বদলালেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। তা সম্ভব একমাত্র এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবলুপ্তি এবং নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তনের মধ্য দিয়ে। যতদিন তা না করা যাচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধি গ্রাস করবেই। সাময়িক স্বস্তি দিতে পারত যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য, এস ইউ সি আই (সি)-র বারবার দাবি সত্ত্বেও কোনও সরকারই তা কার্যকর করেনি।