দেশজুড়ে মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ জনজীবনে নামিয়ে এনেছে ভয়াবহ সংকট৷ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাফিয়ে বাড়ছে৷ হেলদোল নেই কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকারের৷ যেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা যত অবাধ লুঠতরাজই চালাক, তা জনজীবনকে যতই দুর্বিষহ করে তুলুক, সরকারের তা আটকানোর কোনও দায়িত্ব নেই৷ প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না৷ স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, পাকিস্তান কি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে?
সরকারগুলি যখন চরম নিষ্ক্রিয়, তখন মানুষের আশা ছিল, প্রতিবারের মতো এবার শীতের মরশুমে সবজির দাম অন্তত কিছুটা কমবে৷ বাস্তবে ৩০–৪০ টাকা কেজির নিচে কোনও সবজি নেই৷ তাই কিনতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ৷ সংসার চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তারা, প্রয়োজনীয় পরিমাণটুকুও কিনতে পারছে না৷ চাষিরা দাম না পেলেও খাদ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ী, মজুতদার–আড়তদার কারসাজিতেই জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য, সাধারণ মানুষও জানে, সরকারও জানে৷ কিন্তু সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না৷
যথেচ্ছ দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ্য সরকার যে টাস্ক ফোর্স তৈরি করেছিল, অদৃশ্য কারণে তা এখন নিজেই হিমঘরে চলে গিয়েছে৷ বাজারে একদিন টহলদারি চালিয়ে টাস্ক্ ফোর্স যে জিনিসের দাম কমাতে পারবে না, তা কর্তারা ভালই জানেন৷ ফলে এটা শুধু মানুষকে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া কিছু নয় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷শুধু সবজি নয়, ডাল, তেল, চাল, আটা, দুধ সহ সব খাদ্যপণ্যেরই দাম যথেচ্ছ বেড়ে চলেছে৷ ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস (এনএসও)–র তথ্য অনুসারে গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৫.১১ শতাংশ বেড়ে নভেম্বর মাসে ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক হয়েছে ৭.৮৯ শতাংশ৷
সবজির দাম বেড়েছে গত বছরের তুলনায় ২৬.১০ শতাংশ৷ ডালের দাম ১১.৭২ শতাংশ, মাছ–মাংসের দাম ৯.৭৫ শতাংশ৷ ১ জানুয়ারি নতুন বছরের শুরুতে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ২১.৫০ টাকা৷ তার আগে গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে৷ কেন্দ্রের রেলমন্ত্রক দূরপাল্লার সমস্ত ট্রেনের টিকিটের দাম বাড়িয়েছে৷ কয়েক সপ্তাহ আগে কলকাতা মেট্রোতে প্রতি স্টেজে যাত্রীভাড়া ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে৷ একজন নিত্যযাত্রীর শুধু মেট্রোভাড়াই বেড়ে গেছে মাসে প্রায় ৩০০ টাকা৷ গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক জিএসটি বাড়িয়েছে৷ যে সমস্ত পণ্য জিএসটি–র বাইরে ছিল, তাদের অনেকগুলির উপরেই জিএসটি চাপানো হয়েছে৷ যে সমস্ত পণ্যে ৫ শতাংশ কর ছিল, সেখানে ১২ শতাংশ এবং যেখানে ১২ শতাংশ কর ছিল, সেখানে ১৮ শতাংশ কর চাপানো হয়েছে৷ কিছু পণ্যের উপর কর ১৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ করা হয়েছে৷ ডিসেম্বরের শুরুতে এয়ারটেল–ভোডাফোন–আ প্রত্যেকেই মোবাইলের মাশুল বাড়িয়েছে৷ ডিজেল–পেট্রলের দামও দফায় দফায় বেড়ে চলেছে৷ কেন্দ্র ও রাজ্যের কর–সেস ডিজেল–পেট্রলকে করে তুলেছে অগ্নিমূল্য৷
একদিকে সরকারি নীতিতে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে, অন্য দিকে বেকারি, ছাঁটাই লে–ফে মানুষের আয় ক্রমাগত কমছে৷ কেনার ক্ষমতা দ্রুত নেমে যাচ্ছে৷ অর্থনীতির উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ বাজার সংকুচিত হচ্ছে৷ উৎপাদন কমাচ্ছে মালিকরা৷ আর মালিকদের তাঁবেদার সরকার তাদের লাভের ঘাটতি মিটিয়ে দিতে সংকট–জর্জরিত জনগণের পকেট কেটেই দফায় দফায় মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার ত্রাণ–প্যাকেজ দিচ্ছে৷ সাধারণ মানুষ যে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথাই নেই৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং রাজ্যে রাজ্যে নানা রঙের সরকারগুলি ফাটকাবাজদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে৷ জনসেবার নামে এই ভণ্ডামিই চলছে৷
ফলে জনগণের মধ্যে সরকার বিরোধী ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে৷ সেই ক্ষোভকে চাপা দিতে মোদি–মিত শাহরা ধূর্ত কৌশলে কখনও পাকিস্তানবিরোধী জিগির তুলে, কখনও উগ্র হিন্দুত্বের ভাবাবেগ জাগিয়ে, আবার কখনও এনআরসি কিংবা সিএএ–র চক্করে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে৷ কিন্তু ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি মানুষের বেঁচে থাকাকেই যেখানে অসম্ভব করে তুলছে, সেখানে বিজেপির তৈরি কোনও অপপ্রচারই মানুষকে শেষ পর্যন্ত ভোলাতে পারছে না৷
মূল্যবৃদ্ধি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম পরিণাম৷ কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না– এমন নয়৷ পঞ্চাশের দশক থেকে এস ইউ সি আই (সি) মূল্যবৃদ্ধি বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে৷ এই ব্যবস্থায় সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ন্যায্য দামে কিনবে এবং জনগণকে ন্যায্য দামে বিক্রি করবে৷ মাঝে ফড়েদের কোনও ভূমিকা থাকবে না৷ কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূর্বতন কংগ্রেস, সিপিএম কোনও সরকার কার্যকর করেনি৷ তৃণমূল সরকারও করছে না৷
এই অবস্থায় প্রবল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারগুলিকে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালুর ব্যবস্থা নিতে, কালোবাজারি মজুতদারদের গ্রেপ্তার করে বা শাস্তি দিতে বাধ্য করতে হবে৷ এছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই৷ এস ইউ সি আই (সি) মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মানুষকে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে৷ বাজারগুলিতে মিছিল করছে, বিক্ষোভ দেখাচ্ছে৷ ৮ জানুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটে মূল্যবৃদ্ধিকে অন্যতম দাবি হিসাবে যুক্ত করেছে৷ এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে আজ সব স্তরের সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে৷