পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে ভারত বিভাজনের আগে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার ভয়াবহতায় বহু মানুষকে ভিটেমাটি ছেড়ে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল। সেই অসহায় মানুষদের পাশে কোনও রাষ্ট্রই দাঁড়ায়নি। আবার স্বাধীনতার পর ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থবাহী রাষ্ট্র উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে মানুষকে উচ্ছেদ করে চলেছে। যারাই এর বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলন করছে, তাদের মিথ্যা মামলায় জেলে ভরছে। বিভিন্ন রাজ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকার খনিজ ও বনজ সম্পদ কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আদিবাসী, জনজাতি, উপজাতিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নদীর গতিপথ রোধ করে তৈরি বিশালাকার ড্যাম, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তার আশেপাশে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র গড়ার সময় স্থানীয় বহু আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, যাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের কোনও দায়িত্ব সরকার নেয়নি। জলবিদ্যুৎ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ পর্যটন কেন্দ্রগুলিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। পর্যটনে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতিরা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে। আর বিদ্যুতের রোশনাই থেকে দূরের কোনও অন্ধকার জায়গায় দিন কাটে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের। নদীর গতিপথে ড্যাম তৈরিতে চীন, আমেরিকার পর ভারত এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে, ৪,৭১১টি ছোটবড় ড্যাম ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে, নতুন করে ৩৯০টির কাজ চলছে। প্রতিটি ড্যামের পেছনে রয়েছে নদীর জল সংরক্ষণের বিশালাকার জলাধার এবং গড়ে ওঠা নতুন শহর। এই বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্না এই ডামাডোলে চাপা পড়ে যায়। শহরে গ্রামে সর্বত্র গড়ে উঠছে চার-ছয় লেনের রাস্তা, শহরের দুই প্রান্ত জুড়ে দিচ্ছে কয়েক কিলোমিটার দৈর্ঘের উড়ালপুল। কারণ বড় পুঁজির চাই উন্নত পরিবহণ। এজন্য সড়ক তৈরির জন্যও উচ্ছেদ হয়ে চলেছে কয়েক লক্ষ দারিদ্রপীড়িত মানুষ। গড়ে উঠছে নিত্যনতুন সিটিকমপ্লে’, উপনগরী। এখানেও উচ্ছেদের কান্না। দিল্লিতে অবস্থিত Housing and Land Rights Network (HLRN) নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বার্ষিক সমীক্ষা অনুযায়ী এদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ১০৮টি বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, এর ফলে ৫১৯ জন মানুষ প্রতিদিন উচ্ছেদ হচ্ছে, ২২ জন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় ঘরছাড়া হচ্ছে। করোনা ভাইরাস অতিমারি মোকাবিলা করার জন্য যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীরা এবং বিভিন্ন সরকারগুলির প্রচার হল, ‘স্টে অ্যাট হোম’, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সেখানে Forced eviction in India, An Unrelenting National Crisis প্রচারিত এক বয়ানে HLRN লিখেছে, কোভিড মহামারীর মধ্যে (১৬ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই) জোর করে উচ্ছেদ হয়েছে অন্তত ২০ হাজার মানুষ, ৪৫টি ক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্ট, বম্বে হাইকোর্ট, তেলেঙ্গানা হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করেই লকডাউনের মধ্যে ঘর ভেঙে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। অনেক ক্ষেত্রে ঘর ভাঙার নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তেলেঙ্গানার সিদ্দিপেট গ্রামে দলিত কৃষকদের ৩০টি বাড়ি রাতের অন্ধকারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওড়িশার স্কন্ধ আদিবাসীদের ৩২টি বাড়ি, ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে দেয় কালাহান্ডির বন দফতর। মধ্যপ্রদেশের রেওয়ায় একটি পুকুরের সৌন্দর্য্যায়ন করার জন্য ২০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ছত্তিশগড়ের অর্পা নদীর পার সৌন্দর্য্যায়নের জন্য ১৬০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, এদেশে ২০১৭-১৯ এই তিন বছরে বাড়ি ভাঙা হয়েছে ১,১৭,৭৭০টি, এবং ওই তিন বছরে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার জনকে। সংগঠনটির এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর শিবানী চৌধুরী বলছেন, দেশে নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক মানুষদের উচ্ছেদ করার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কাছে নাকি এই নিয়ে সুস্পষ্ট কোনও তথ্য নেই। আসলে তথ্য রাখলে তাদের ধরা পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই তথ্য না-রাখাটাই শ্রেয় বলেপুঁজিপতিশ্রেণির রক্ষক, সেবক, পাহারাদার সরকারগুলি তা লুকিয়ে ফেলছে।
সুরজিত দেবরায়
হুগলি