মুম্বাইয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ধারাবি বস্তির উন্নয়নের জন্য গ্লোবাল টেন্ডারে আদানি রিয়েলটি ৫০৬৯ কোটি টাকায় বরাত পেয়েছে ২৯ নভেম্বর ২০২২৷ এই প্রকল্পের আওতায় বস্তির বাসিন্দাদের জন্য ৩০০ বর্গ ফুট ফ্ল্যাটের অনেকগুলি আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন তৈরি হবে৷ প্রতিশ্রুতি– প্রত্যেক ফ্ল্যাটে পর্যাপ্ত জল, বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাসের পাইপলাইন সংযোগ, শৌচাগার ও সুষ্ঠু পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা থাকবে৷ বৈধ বাসিন্দাদের ৩০০ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাট বিনামূল্যে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ সংবাদে প্রকাশ, সমস্ত প্রকল্পটিতে খরচ হবে ২০ হাজার কোটি টাকা৷
ধারাবির ৬০০ একর জুড়ে এই প্রকল্পের কাজ হবে, যেখানে ১ লক্ষ ২০ হাজার ঝুপড়িতে ১০-১২ লক্ষ লোক বসবাস করে৷ এই জনসংখ্যা থেকেই অনুমান করা যায় যে এখানে মানুষ কীভাবে গাদাগাদি করে বসবাস করে৷ একটি মাত্র ছোট ঘরে পরিবারের ৪-৫ জন থাকে ও কোনও রকমে মেঝেতে ঘুমাতে পারে৷ কোনও পরিবারের নিজস্ব শৌচাগার নেই, কমিউনিটি শৌচাগারই ভরসা৷ পানীয় জলের সংকট তীব্র ও পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থাও খুব খারাপ৷ ডায়েরিয়া সহ জলবাহিত রোগের প্রকোপ খুবই বেশি৷ ইলেকট্রিক তার গোটা বস্তি জুড়ে জট পাকিয়ে আছে, ফলে শর্ট সার্কিট থেকে মাঝে মধ্যেই আগুন লাগে৷
এখানকার মানুষ ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে দাবি করে আসছে বস্তির যথাযথ উন্নয়নের৷ কিন্তু তারা নানা পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পায়নি৷ নতুন এই ধারাবি রি-ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের দিকে তারা বহু আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন৷ আবার আশঙ্কাও তাদের কম নেই৷ এই বস্তিতে প্রায় ১৫ হাজার ম্যানুফ্যাকচারিং ইডনিট আছে৷ এমব্রয়ডারি, রেডিমেড পোশাক, চামড়ার দ্রব্যাদি তৈরি করে এখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন৷ মুম্বাইয়ের ৮০ শতাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক এখানেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়৷ এখানে চর্মশিল্প ও মৃৎশিল্পে প্রচুর সংখ্যক মানুষ নিযুক্ত রয়েছে৷ ছোট ছোট ব্যবসা ও উৎপাদনের মাধ্যমে বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ের অর্থনীতিতে ধারাবি বস্তি বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকার অধিক মূল্য যোগ করে৷ কিন্তু সরকার এই বস্তির উন্নয়নে কী করেছে?
আদানিদের রি–ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে এই উৎপাদন শিল্পগুলির জন্য নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা মানুষের তা জানা নেই৷ ৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে মানুষের জীবিকার উপায়গুলি বন্ধ হয়ে যাবে৷ কারণ যে জিনিসগুলি উৎপাদনের সঙ্গে এখানকার মানুষ যুক্ত, ওই আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটগুলিতে তার কাঁচামাল ও উৎপাদিত দ্রব্য নিয়ে যাওয়া ও নিচে নিয়ে আসা দুরূহ ব্যাপার৷ দ্বিতীয়ত মৃৎশিল্পের মাটির জিনিসপত্র রোদে শুকাতে পারে ও পোড়ানোর জন্য প্রয়োজন অনেকটা খোলা আকাশ, দরকার চিমনি সহ চুল্লির, যা ওই ফ্ল্যাটে অসম্ভব৷ আশঙ্কা চর্মশিল্পকেও পাততাড়ি গোটাতে হবে৷
ধারাবি বস্তির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর উত্তরে বিমানবন্দর, এক পাশ দিয়ে কেন্দ্রীয় শহরতলি রেললাইন ও অন্য পাশ দিয়ে পশ্চিম শহরতলি রেললাইন চলে গেছে৷ এর আশেপাশে ৪-৫টি রেলওয়ে স্টেশন৷ গণপরিবহণের এই সহজলভ্যতা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রের সংলগ্নতা ধারাবিকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও প্রোমোটারদের কাছে লোভনীয় করে তুলেছে৷ তাই তাদের দৃষ্টি পড়েছে এই বস্তির ৬০০ একর জমির ডপর৷ দীর্ঘদিন ধরে এখানকার মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে যে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা মেনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাটে ডঠে যান, না হলে তাদের বস্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে৷ সরকার, প্রোমোটার বাহিনী ও তার শিল্প বাহকদের এই হুমকিতে পরিষ্কার, বস্তির বিশাল পরিমাণ জমি দখল করতে চায় এ দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা৷ তাদের মূল লক্ষ্য বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই জমি দখল করা৷ শোনা যাচ্ছে ৪৭ শতাংশ জমিতে বস্তিবাসীদের জন্য বহুতল বাড়ি তৈরি হবে৷ বাকি ৫৩ শতাংশ জমি আদানির হাতে চলে যাবে৷ এই জমিতে তারা পাঁচ কোটি বর্গফুটের ফ্ল্যাট তৈরি করে বিপুল মুনাফা লাভ করবে৷