
অপেক্ষা, শুধু এক বুক অপেক্ষা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন বিমান দুর্ঘটনায় মৃতের পরিজনরা। ১০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও (লেখা তৈরি হওয়া পর্যন্ত) আমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনায় সব মৃতদেহ শনাক্তকরণ হল না। ভাঙা হাত, পায়ের টুকরো বা কোনও প্রমাণচিহ্ন পৌঁছল না পরিজনদের কাছে।
১২ জুন গুজরাটের আমেদাবাদের মেঘানিনগরে ভেঙে পড়া এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডনগামী বিমানের ২৪১ জন যাত্রী সহ মেডিকেল হোস্টেল ও স্থানীয় মানুষ ধরে প্রায় ৩০০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। মৃতদের পরিজনেরা ডিএনএ বা অন্য প্রমাণ দিলেও তা মিলিয়ে মৃতদেহ শনাক্তকরণের কাজ চলছে ঢিমেতালে। আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালের চিকিৎসক ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিজনদের নিশ্চিন্ত করার জন্য গুজরাট সরকারের কি উদ্যোগী হয়ে প্রয়োজনে বাইরের রাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ এনে কাজটা দ্রুত সম্পূর্ণ করা দরকার ছিল না? শোকবিহ্বল অবস্থায় নিহতদের পরিজনেরা একবার হাসপাতাল একবার মর্গে ছুটে বেড়াচ্ছেন, কবে কখন মৃতদেহ পাওয়া যাবে তা জানতে পারছে না অনেকে। স্থানীয় যাঁরা নিখোঁজ বা মারা গিয়েছেন, তাদের পরিজনদের অবস্থা তো আরও কঠিন। কারণ, বিমান যাত্রীর মতো তাদের তো আর কোনও নামের তালিকা নেই। ফলে থানা-পুলিশ-মর্গ করেই তাদের দিন চলে যাচ্ছে, খোঁজ মিলছে না। মৃতদেহ পরিবহণে গাড়ি ও কফিনের অভাব– সর্বত্র একটা অব্যবস্থা, অগোছালো ভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
দুর্ঘটনার তদন্ত এবং তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে যেগুলি কোনওটাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়! অথচ সরকার কিংবা টাটা পরিচালিত এয়ার ইন্ডিয়া এগুলোতে কর্ণপাতই করছে না। তদন্ত চাপা দিতেই কি এই আচরণ?
এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটার হাতে বেচে দেওয়ার সময় পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নের নানা গল্প শোনানো হয়েছিল। অনেকে আবার বলে থাকেন, বেসরকারি হলেই পরিষেবা উন্নত হয়। আর টাটা কোম্পানির নামে তো একদল একেবারে গদগদ হয়ে পড়েন। অথচ টাটার হাতে গিয়ে পরিকাঠামোর হাল কি তা সাম্প্রতিক ঘটনায় বোঝা যায়। নিরাপত্তায় গাফিলতির অভিযোগে ইতিমধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়ার তিন উচ্চপদস্থ আধিকারিককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে ভারতের বিমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ। এই তিন আধিকারিকের বিরুদ্ধে বিমান ও বিমানকর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়ক একাধিক গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক লাইসেন্স ছাড়াই কাউকে বিমানে কাজের দায়িত্ব দেওয়া, টানা কাজের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম না দিয়ে পরবর্তী বিমানের দায়িত্বে পাঠানোর মতো গাফিলতি।
দুর্ঘটনার পর উঠে আসছে নানা তথ্য। প্রয়োজনের তুলনায় বিমানকর্মীর সংখ্যা কম, নেই বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড কর্মী। বিমান ওড়ার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা বিমানচালকের সংখ্যায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। নিরাপত্তায় গলদ রয়েছে যথেষ্ট। সংস্থার মুনাফা দিন দিন বাড়লেও যাত্রীদের নিরাপত্তাজনিত খাতে ব্যয়ের পরিমাণ অত্যন্ত কম। বেসরকারি কোম্পানি টাটার, কিন্তু সরকারের বিমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি তার দায় এড়াতে পারে? ডিজিসিএ কার নির্দেশে চোখ বুজে থেকেছে। এতগুলি মানুষের মৃত্যু না হলে কি তারা আদৌ কোনও পদক্ষেপ করত!
দুর্ঘটনার পর এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। যদিও এই টাকার অনেক বেশি তারা বিমা কোম্পানির থেকে পেয়ে যাবে। তা ছাড়া ক্ষতিপূরণ দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? যদি আবারও আর্থিক কারণ দেখিয়ে কিংবা কর্মী সংখ্যা কমের অজুহাতে যাত্রী নিরাপত্তার সাথে আপস করা হয়, তবে আবারও একই ঘটনা ঘটবে। সরকারের দায়ওএতে এতটুক কমে না। বিশ্বে বিমান পরিবহণে যাত্রী সংখ্যার নিরিখে তৃতীয় ভারত। এর থেকে ভালই লাভের কড়ি ঘরে আসে বেসরকারি সংস্থাগুলির। সরকারও বহু কোটি টাকা রাজস্ব পায় বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলি থেকে। তা হলে সেগুলির নজরদারিতে সরকারের ভূমিকায় এত অবহেলা কেন? প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি তুললেই কি তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
মুনাফার স্বার্থে মালিকরা মানুষের জীবনকে কতটা বিপদে ঠেলে দিতে পারে তা আজ বিমান, রেল, বাস, জাহাজ পরিবহণ, হাসপাতাল পরিষেবা সহ সব ক্ষেত্রে প্রকট হচ্ছে। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ভীত সন্ত্রস্ত পর্যটকদের লুঠ করতে কোনও বিমান কোম্পানি পিছিয়ে ছিল না। টাটারাও কিছু কম যায়নি এই লুঠের কারবারে। ফলে তারা মুনাফা তুলতে যাত্রীদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা করে না, এ তো দেখাই যাচ্ছে। কর্মী সংখ্যার অভাবে অনেক সময়ই অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয় বেসরকারি ক্ষেত্রে (আইএলও-র নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে), তা তো সরকারের অজানা নয়। বারবার অভিযোগ উঠছে, সরকারি হাতে থাকার সময় এয়ার ইন্ডিয়ার দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি গ্রাউন্ড স্টাফদের বদলে এখন টাটারা ভরসা করছে চুক্তিভিত্তিক অদক্ষ কর্মীদের ওপর, যাদের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে সামান্য কারণে বিমান চলাচলে দেরি এখন খুব সাধারণ ঘটনা।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলটির ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’ এর আগেও আলোচনায় এসেছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে একাধিকবার এই মডেলের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তারপর এই মডেলকে বেশ কিছুদিন বসিয়ে দিয়েছিল মার্কিন বেসরকারি বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফএএ। তা সত্ত্বেও ডিজিসিএ সেগুলি চালানোর অনুমতি দিল কেন? বিমান পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যদি মানুষের প্রাণের থেকে মুনাফার মূল্য বেশি হয়ে ওঠে, তখন তার মাশুল চোকাতে হয় অনেক গুণ বেশি। যতদিন রেল-বিমানের মতো পরিষেবা পুঁজিবাদী বাজারের লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, ততদিন এর মাশুল গুনতে হবে অসহায় যাত্রী ও তাদের পরিজনদেরই।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত