মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ৯ জুলাই ঘোষণা করেছেন, রাজ্যে কর্মরত প্রাথমিকের পার্শ্বশিক্ষকদের বেতন ৫,৯৫৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করবেন৷ উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন করবেন ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩ হাজার টাকা৷ প্রতিশ্রুতি এখানেই শেষ নয়, বলেছেন, টেট পরীক্ষায় পার্শ্ব শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষণ ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করবেন৷
প্রায় দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও পার্শ্ব শিক্ষকদের অনেকে আশঙ্কিত৷ তাঁদের বক্তব্য, বেতন বৃদ্ধির এই প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রী আগেও দিয়েছিলেন৷ ৪ মাস আগে নজরুল মঞ্চের সভা থেকে ঘোষণা করেছিলেন বেতন বৃদ্ধির৷ কিন্তু মৌখিক ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করতে হলে লিখিতভাবে সরকারি নির্দেশনামা জারি করতে হয়৷ সেটা কোথায়? দ্বিতীয়ত, বেতন বৃদ্ধির চমকের আড়ালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নিয়মিত প্রাপ্য ইনক্রিমেন্ট৷ শিক্ষকরা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না৷ তাঁদের বক্তব্য যা তাঁরা পাচ্ছিলেন তা হরণ করে এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, যা কবে কার্যকর হবে কেউ জানে না৷
মুখ্যমন্ত্রী পার্শ্বশিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে আছি৷ বিশ্বাস রাখবেন, ভরসা রাখবেন৷ এখন এই মুহূর্তে হাতে টাকা নেই’ (আনন্দবাজার পত্রিকা : ১০ জুলাই, ’১৮)৷ হাতে টাকা নেই বলার দ্বারা মুখ্যমন্ত্রী কী বোঝাতে চাইলেন? তবে কি এই মুহূর্তে প্রতিশ্রুতির বেতন দেওয়ার টাকা নেই? মুখ্যমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন রাজ্যের দেনা শোধ হয়ে গেলে বা ‘সুযোগ এলে’ তিনি পার্শ্বশিক্ষকদের দিকটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন৷ রাজ্যের দেনা কবে শোধ হবে? তৃণমূল সরকারের উপর পূর্বতন সিপিএম সরকার বিপুল ঋণের বোঝা চাপিয়েছে৷ তার উপর তৃণমূল সরকার প্রতি বছর বিপুল ঋণ করেই চলেছে৷ ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে৷ এই ঋণ থেকে মুক্তির প্রায় কোনও সম্ভাবনাই নেই৷ মুখ্যমন্ত্রীই বা বাড়তি টাকা কীভাবে জোগাড় করবেন এখনও তা প্রকাশ্যে বলেননি৷ এ অবস্থায় এই বেতন বৃদ্ধি যেন স্বপ্নের পোলাও!
পার্শ্বশিক্ষকদের পাশে সত্যিই কি সরকার আছে? থাকলে তাঁদের স্থায়ীকরণের দাবি পূরণ করছে না কেন? শিক্ষকদের নামের আগে ‘পার্শ্ব’, ‘আংশিক’, ‘চুক্তিভিত্তিক’ ইত্যাদি নানা বিশেষণ সরকার আনল কী উদ্দেশ্যে? কেন শিক্ষকে–শিক্ষকে এই বিভাজন তারা তৈরি করল? এই শিক্ষকদের তো স্থায়ী শিক্ষক হিসাবেই নিয়োগ করা যেত সরকার তা করল না কেন? স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ না করার মূল ঊদ্দেশ্য হল বেতন কম দেওয়া, কম টাকায় শিক্ষকদের বেগার খাটিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পারিচালনা করা৷ এই যাদের উদ্দেশ্য, তারা নানা বাহানা খুঁজবেই যাতে বেতন কম দিতে হয়৷
একজন স্থায়ী শিক্ষকের তুলনায় এই অস্থায়ী শিক্ষকদের বেতন অনেক কম৷ এঁরা আন্দোলনের চাপে সরকারের কাছ থেকে ছিঁটেফোঁটা কিছু আদায় করার চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু আন্দোলন না থাকলে তাও জুটবে না৷ প্রাথমিক থেকে কলেজ সর্বত্রই এখন অস্থায়ী শিক্ষকের রমরমা৷ স্বাস্থ্যক্ষেত্র সহ সমস্ত সরকারি দপ্তরেই আজ ক্যাজুয়াল কর্মীদের ভিড়৷ বেসরকারি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা৷ পুঁজিপতিরা মুনাফা অত্যধিক করতে স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে অস্থায়ী চাকরিতে জোর দিচ্ছে, যাতে বেতন কম দিতে হয় এবং অন্যান্য প্রাপ্য না দিতে হয়৷ সরকারও একই পথের পথিক৷ ফলে এইসব অস্থায়ী কর্মীদের জীবনে স্থায়ী কেবল বঞ্চনা৷ ভোট এলে এদের প্রতি সরকারের দরদ উথলে ওঠে৷ ভোট গেলেই সরকার আর ফিরেও তাকায় না৷
সরকারি অবহেলার অন্যতম শিকার রাজ্যের বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা৷ বর্তমানে রাজ্যে ২৭০০টি বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেন্দ্র চালু আছে৷ প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক–প্রশিক্ষক–কর্মচারী এই বিভাগে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকরা মাসে যথাক্রমে ৯ হাজার ও ৭ হাজার টাকা বেতন পেলেও সর্বাধিক সংখ্যায় নিয়োজিত আংশিক সময়ের শিক্ষক ও প্রশিক্ষকরা ক্লাস পিছু যথাক্রমে ১৬০ টাকা ও ১১০ টাকা পান৷ এই সমস্ত শিক্ষকদের পেটের ভাত জোগাড় করতে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য পেশা খুঁজতে হয়৷ এঁরা পড়ানোর গুণগত মান বাড়ানোর কথা ভাববেন কখন? নিজেদের আরও ভাল করে তৈরি করবেনই বা কীভাবে?
এ ছাড়া রয়েছে এস এস কে, এম এস কে এবং শিক্ষাবন্ধু কর্মীরা৷ তাঁরাও তীব্র বঞ্চনা এবং বৈষম্যের স্বীকার৷ তাঁদেরও ন্যায্য দাবি – বাঁচার মতো মজুরি চাই৷ সরকার এঁদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে কোনও ঘোষণা করেনি৷
রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি পালন সম্পর্কে আরেকটি নৈরাশ্যজনক চিত্র সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায়ে সামনে এল৷ ২০১৩ সালে তৃণমূল সরকার রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তৈরি হওয়া ২৩৪টি মাদ্রাসাকে অনুমোদন দিয়েছিল৷ ওই বছরই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকার বলেছিল ওই মাদ্রাসাগুলিকে বিভিন্ন তহবিল থেকে যাবতীয় সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হবে৷ কিন্তু সেই নির্দেশ কার্যকর না হওয়ায় মামলা হয় হাইকোর্টে৷ হাইকোর্ট সম্প্রতি এই মামলার রায়ে বলেছে, পাঁচ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার মাদ্রাসাগুলির পড়ুয়াদের যাবতীয় প্রাপ্য সুবিধা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে৷ এই ঘটনা দেখাচ্ছে প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর৷ তথ্য আরও দেখাচ্ছে, সংখ্যালঘু স্কুল বলে মাদ্রাসাগুলি কোনও বাড়তি সুযোগ পায়নি৷ এই মাদ্রাসাগুলির ৪০ হাজার পড়ুয়া এবং আড়াই হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী তীব্র বঞ্চনার শিকার৷ তেমনই বঞ্চনার শিকার অন্যান্য স্কুল–কলেজের এই সব আংশিক সময়ের শিক্ষকরাও৷ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার তোষণ করে পুঁজিপতিদের, আর শোষণ করে জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষদের৷ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, লাগাতার আন্দোলনই পারে বঞ্চনার মাত্রা কমাতে৷ প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিতে রাজ্যের ৪৮ হাজার পার্শ্বশিক্ষককে এই আন্দোলনের পথেই থাকতে হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)