মুখ্যমন্ত্রীকে এআইডিএসও-র খোলা চিঠি

(মেদিনীপুর কোতোয়ালি মহিলা থানায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার তনুশ্রী বেজ, সুশ্রীতা সরেন, বর্ণালী নায়ক ও রানুশ্রী বেজ ৬ মার্চ মুখ্যমন্ত্রীকে এই খোলা চিঠি দেন)

আমরা জানি আপনি সরকার এবং দলের কাজে খুবই ব্যস্ত থাকেন। তা সত্ত্বেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে এবং খুবই যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় আপনাকে এই চিঠি লিখছি। সম্ভবত আপনি সংবাদমাধ্যম থেকে আমাদের বক্তব্যের কিছু অংশ শুনে থাকবেন, কিন্ত তা সত্ত্বেও আপনার জ্ঞাতার্থে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু কথা জানাতে চাই।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন, চার বছরের ডিগ্রি কোর্স বাতিল, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে, ক্যাম্পাসে থ্রেট সিন্ডিকেট ও মেদিনীপুরে এআইডিএসও কর্মীদের উপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে ৬ মার্চ সংগঠনের ডাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অভিযানে নেতৃত্ব দেন রাজ্য সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়। উপাচার্যকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

আমরা শুনেছি, আপনি যখন যোগমায়া দেবী কলেজের ছাত্রী ছিলেন, তখন সেই কলেজে এআইডিএসও পরিচালিত ছাত্রী ইউনিয়ন ছিল। স্বভাবতই এ কথা ধরে নেওয়া যায় যে, আমাদের সংগঠনকে জানার সুযোগ আপনার হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই আপনার আছে যে, আমরা যখন কোনও ছাত্র ধর্মঘট বা আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করি তখন তা কখনওই বোমা, পিস্তল, ছুরি কিংবা লাঠিসোটা নিয়ে তা কার্যকর করার চেষ্টা করি না। এটা এআইডিএসও-র সংস্কৃতি নয়। আমাদের সংগঠনের আদর্শ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতেই ৩ মার্চের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মঘটের (স্কুলস্তরের পঠন পাঠন, পরীক্ষা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পরীক্ষা এই ধর্মঘটের আওতার বাইরে ছিল) আবেদন জানাতে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় গেটে পৌঁছনো মাত্রই বিশাল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আচমকা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। গ্রেপ্তার চলাকালীন মহিলা সংগঠকদের উপর পুরুষ পুলিশকর্মীরা অশালীন আচরণ করে। আমাদের মধ্যে একজন, রানুশ্রী বেজ পুলিশি নিগ্রহে গুরুতর আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর জলের জন্য আর্তনাদ করতে থাকলে পুলিশ জল না দিয়ে পুনরায় থাপ্পড় মারে ও নানা ভাবে আঘাত করে। এরপরও যে আমাদের জন্য আরও বীভৎস অত্যাচার অপেক্ষা করছিল, আমরা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

আহত অবস্থাতে গ্রেফতারের পর আমরা বারবার চাইলেও আমাদের কোনও চিকিৎসা করানো হয়নি। আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর মহিলা কোতোয়ালি থানায়। সেখানে আমাদের সাথে যে পাশবিক ও বর্বরোচিত আচরণ করা হয়, অশালীন ভাষা প্রয়োগ করা হয়, তা এই সভ্য সমাজে ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। আমাদের আলাদা আলাদা ভাবে সিসিটিভি ক্যামেরার আড়ালে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করা হয়। লকআপের ভিতর অ্যারেস্ট মেমোতে সই করানোর সময় আমাদের হাতে এবং পায়ে জ্বলন্ত মোমবাতির মোম গলিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের শরীরের উপর চারজন পুলিশকর্মীকে দাঁড় করিয়ে ওসি নিজের বেল্ট খুলে পেটায়, বর্ণালী নায়েকের মুখে ভারী বুট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। মুখগহ্বরের ভেতর রক্ত ঝরতে থাকলে মুখে জল ঢেলে সেই জল খেতে বাধ্য করা হয়। চুলের মুঠি ধরে শূন্যে উঁচু করে ঝুলিয়ে দিয়ে পায়ের তলায় আঘাত করতে থাকে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে থানার ওসি ‘মেরে জোশ আসছে না’ বলে মানসিক বিকারগ্রস্তের মতো চটুল বলিউডি গান চালিয়ে গানের তালে তালে অত্যাচার চালাতে থাকে ও পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতে থাকে। আমাদের মধ্যে একজন সুশ্রীতা সরেনের আদিবাসী জনজাতি পরিচয়কে অত্যন্ত কুৎসিত ইঙ্গিত করে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করতে করতেই ওসি আক্রমণ চালাতে থাকে এবং নানা মিথ্যা ও অনৈতিক মুচলেকা নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শুধু তাই নয়, আগামী দিনে আমাদের সংগঠনের কোন কোন কর্মীর উপর তারা এই ধরনের অত্যাচার চালাবে তার আগাম ঘোষণা দিতে থাকে। সরাসরি গুম ও খুনের হুমকি দেয়। আমাদের উপর অত্যাচারের চিহ্ন লোপাট করবার জন্য আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সন্ধ্যায় স্নান করানো হয়। জানানো হয় আমাদের ছাড়া হবে না। এটা জেনে আমাদের অভিভাবকরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর, আচমকা রাত ২টা নাগাদ অন্ধকার, জনমানবহীন, যানবাহনহীন রাস্তায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আমাদের সাথে কী ঘটতে পারত, এ কথা আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমরা শুনেছি, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে পুলিশের দ্বারা আপনি কী ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। আপনার শাসনকালে পুলিশের এই আচরণ আমাদের সেই ঘটনাকেই স্মরণ করাল। আপনার কাছে আমাদের প্রশ্ন– প্রথমত, যেখানে খুনের আসামীকেও পুলিশি হেফাজতে আইনত অত্যাচার করা চলে না, সেখানে কেবল গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি বলে আমাদের উপর এই অত্যাচার কি আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত? দ্বিতীয়ত, আইন শৃঙ্খলা ও শান্তিরক্ষার প্রহরী বলে যাদের দাবি করা হয়, তাদের কাছে নাগরিকদের বিশেষত নারীদের নিরাপত্তা কতটুকু সুরক্ষিত? তৃতীয়ত, পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের যখন এই নৃশংসতার ঘটনায় অনুতাপ প্রকাশ করা ও তদন্ত করার প্রয়োজন ছিল, তখন তিনি সমস্ত ঘটনাকে বেমালুম অস্বীকার করেছেন এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। এতেও কি প্রমাণ হয় না যে– তিনি সমস্ত ঘটনা জানতেন এবং তার সম্মতিতেই এই বর্বরোচিত অত্যাচার ঘটেছে?

নারকীয় ঘটনার যতটুকু সভ্য সমাজে প্রকাশ্যে আনা যায়, খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তা আপনাকে জানালাম। আশা করি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন নারী হিসেবে এই ভয়াবহ অত্যাচারের তাৎপর্য অনুধাবন করে অপরাধীদের যথাযোগ্য বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।