বাজেট পেশ করতে গিয়ে পরম্পরাগত সুটকেসের বদলে দড়ি বাঁধা ‘বহি খাতা’ হাতে সংসদে এসে মোদি–২ সরকারের অর্থমন্ত্রী এবার ব্যাপক চমক সৃষ্টি করেছিলেন৷ পেটোয়া মিডিয়ার কল্যাণে তার প্রচারও হয়েছে বিস্তর৷ কিন্তু তাঁর ওই ‘বহি খাতা’–র পাতায় পাতায় চরম অসত্যের যে খোঁজ মিলেছে, তা ছাপিয়ে গেছে আর সব কিছুকে৷
বাস্তবিকই এবারের বাজেটে আয়–ব্যয়ের যে হিসাব তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী, তার পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে ডাহা মিথ্যা পরিসংখ্যানের উপর ভর করে৷ দেশের মানুষের সঙ্গে বিজেপি সরকারের এই প্রতারণা সত্যিই স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো৷
বাজেট বক্তৃতায় সরকারের সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী৷ যে বছরটি সদ্য চলে গেল, তার ও চলতি বছরের আয়–ব্যয়ের হিসাব বাজেটে পেশ করাই রীতি, কারণ এ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অবস্থার একটা ছবি পাওয়া যায়৷ কেন এ তথ্য বাজেট ভাষণে নেই স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠেছিল৷ উত্তরে মন্ত্রী জানান, বাজেট–নথির সঙ্গে যুক্ত অতিরিক্ত কাগজপত্রে যেগুলিকে বলা হয় ‘সাপ্লিমেন্টারি মেটিরিয়াল’, তাতে এ সংক্রান্ত হিসেব দেওয়া আছে৷ বলা বাহুল্য, অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করেন যাঁরা, তাঁরা ছাড়া এই ‘সাপ্লিমেন্টারি মেটিরিয়াল’ অধিকাংশ মানুষই খুঁটিয়ে দেখেন না৷ এবারের বাজেটের এ হেন ‘সাপ্লিমেন্টারি মেটিরিয়াল’গুলি পরীক্ষা করতেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে বেড়াল৷ এ নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অর্থনীতিবিদ রথীন রায়৷ প্রশ্ন তোলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষও৷ তাঁরা দেখিয়েছেন, ২০১৮–’১৯–এর আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব বাজেটে দেখানো হয়েছে, তা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, ডাহা মিথ্যা৷ মূলধারার সংবাদমাধ্যম এ খবর বিশেষ প্রচার করেনি৷ কিন্তু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা সরকারি আর্থিক সমীক্ষার পরিসংখ্যানগুলির সঙ্গে বাজেটের পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখে মোদি সরকারের এই জঘন্য মিথ্যাচারের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন৷
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক প্রকাশিত আর্থিক সমীক্ষা ২০১৮–’১৯–এর দ্বিতীয় খণ্ডে পরিসংখ্যানের কয়েকটি তালিকা দেওয়া আছে৷ পৃষ্ঠা এ–৫৯–এ এমনই একটি তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে কিছু পরিসংখ্যান যেগুলিকে বলা হয় ‘প্রভিশনাল অ্যাকচুয়ালস’, অর্থাৎ অর্থমন্ত্রকের হিসাবে এগুলি হল ২০১৮–’১৯–এর আয় ও ব্যয়ের সঠিক পরিমাণ৷ কম্পট্রোলার জেনারেল অফ অ্যাকাউন্টস বা সিএজি এই পরিসংখ্যানগুলি ঠিক কিনা, তা যাচাই করে৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাজেট–নথির সঙ্গে দেওয়া পরিসংখ্যানে আয় ও ব্যয় যা দেখানো হয়েছে, আর্থিক সমীক্ষার এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তার থেকে বিস্তর আলাদা৷ বাস্তবে আর্থিক সমীক্ষায় আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব রয়েছে, বাজেটের আয়–ব্যয়ের হিসাব তার চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে৷ বাজেট–নথি তৈরি করেছে যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক, আর্থিক সমীক্ষার রচয়িতাও তারাই ফলে জোরদার প্রশ্ন উঠে গেছে, এই পার্থক্য ঘটতে পারল কী করে তবে কি ইচ্ছাকৃত ভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে হিসাবের এই গরমিল?
এই গরমিল বাস্তবে চমকে দেওয়ার মতো এবং সরকারের তরফে গোঁজামিল দিয়ে গরমিল মেটানোর চেষ্টাও ততোধিক চমকপ্রদ৷ সবচেয়ে বেশি গরমিল রয়েছে কর–রাজস্বের হিসাবে৷ বাজেটে আদায়ীকৃত কর–রাজস্বের যে হিসাব দেখানো হয়েছে, প্রকৃত কর–রাজস্বের পরিমাণ তার চেয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা কম প্রকৃত কর রাজস্ব কম হওয়ার পিছনে মূল কারণ জিএসটি–র আদায় কম হওয়া, যা নিয়ে ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়েছে৷ কিন্তু সরকারের ঘরে কর–রাজস্ব কম এলে কী হবে, মোদি সরকার আয়ের সেই ঘাটতি ম্যানেজও করে ফেলেছে৷ তা তারা করেছে অত্যন্ত কৌশলে এবং দেশের মানুষের চোখের আড়ালে৷ কী সেই কৌশল? দেখা গেছে, বাজেটে খরচের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, সরকারেরই আর্থিক সমীক্ষা বলছে, বাস্তবে খরচ করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম টাকা৷ বাজেটে যা খরচ দেখানো হয়েছে, সরকার নানা খাতে আসলে তার চেয়ে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম খরচ করেছে৷ অর্থাৎ আয় ও ব্যয়– দু’দিক থেকেই গোটা বাজেটের পরিমাণটাই কমিয়ে দেওয়া হল বিপুল ভাবে৷ হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি–র ১ শতাংশের মতো৷ রাজকোষ ঘাটতি নিয়েও বাজেটে মিথ্যাচার করা হয়েছে৷ এর পরিমাণ বাজেটে যা বলা হয়েছে, তার তুলনায় সরকারেরই হিসাবে ১০ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা বেশি৷
ফলে এ কথা ভাবলে বোধহয় ভুল হবে না যে, বাজেটে যা–ই বলা হোক না কেন, বাস্তবে কর বাবদ আয় কম হওয়ায় গত আর্থিক বছরে মোদি সরকার জনগণের জন্য বরাদ্দ খরচগুলিতে বড়সড় কোপ বসিয়েছিল৷ অথচ বাজেটে সে কথা চেপে যাওয়া হয়েছে৷ অর্থাৎ বরাদ্দ কমানোর সমস্ত সিদ্ধান্তগুলিই নেওয়া হয়েছে সংসদকে এড়িয়ে, দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে৷ কোন কোন খাতে কোথায় কোথায় বরাদ্দ কমানো হল, তার জন্য দেশের সাধারণ মানুষের কোন কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হল, তা থেকে গেল সকলের চোখের আড়ালে৷ এ তো জনগণের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা বাস্তবে এই হল মোদি সরকারের ব্যাপক ঢাক ঢোল পেটানো ‘সব কা বিকাশে’র আসল চেহারা৷
এই বাজেটের ভিতটাই শুধু যে মিথ্যা তাই নয়, এখানে ভবিষ্যতের যে ছবিটি তুলে ধরা হয়েছে, তাও সম্পূর্ণ অলীক৷ বলা হয়েছে, ২০২৪–’২৫ সালের মধ্যে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তথা জিডিপি পৌঁছে যাবে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে৷ কিন্তু কোন রাস্তায় হেঁটে পৌঁছানো যাবে সেই স্বর্গে, তার কোনও নিশানা দেওয়া হয়নি বাজেটে৷ অর্থমন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন, প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে অর্থনীতির বিকাশ হলে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে৷ যদি কোনও বছর ৮ শতাংশের চেয়ে কম হয় বৃদ্ধির হার, তাহলে সহজ হিসাবেই বোঝা যায়, পরবর্তী বছরগুলিতে বৃদ্ধির হার ঠেলে তুলতে হবে ৯–১০ শতাংশে৷ যেমন, ২০১৮–’১৯ আর্থিক বছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকেই আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫.৮ শতাংশে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম৷ এই যখন অবস্থা, বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ রাখতেই যখন ঘুম ছুটে যাচ্ছে সরকারের, হিসাবের নানা অদল–বদল, কায়দা–কৌশল করেও সেই অঙ্ক ছোঁয়া যাচ্ছে না, সেখানে কোন হিসাবে এই আকাশকুসুম নির্মাণ করলেন অর্থমন্ত্রী, তা ভাবলে অবাক হতে হয়৷
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, বছরে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির হার পেতে হলে প্রতি বছর ৩৫ শতাংশ হারে বিনিয়োগ চাই৷ দুনিয়াজোড়া এই চরম মন্দার সময়ে, যখন মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনের জিনিসটুকু কিনতেই দম বেরিয়ে যাচ্ছে, বাড়তি কেনাকাটা দূরের কথা, সেখানে কোথা থেকে এবং কেন আসবে এই বিপুল বিনিয়োগ, কোন পুঁজিপতি লগ্নি করবে, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী৷
বাস্তবে এই মিথ্যাচার আর দেশের সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানোই পুঁজি নরেন্দ্র মোদিদের৷ গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদির প্রতিটি প্রতিশ্রুতি যেভাবে ‘জুমলা’য় পরিণত হয়েছে, তাতে এ কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ বিশেষ নেই৷ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় বসে যে সেই পথ থেকে সরবেন না তাঁরা, বাজেটের নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর জুয়াচুরি তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে৷
(সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জুলাই, ’১৯ এবং দ্য ওয়্যারে প্রকাশিত অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষের নিবন্ধ)