একটা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা মানবিক তা বোঝা যায় সেই সরকারের কাজকর্ম কতটা জনমুখী সেটা দেখে৷ শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, বাঁচার অধিকার– নেতা–মন্ত্রীদের মুখের এই কথাগুলি শুধু ‘বাজে কথার ফুলের চাষ’ হয়েই শোভা পাচ্ছে, নাকি মানুষের জীবনে তা ফলপ্রসূ হচ্ছে– তা দিয়েই হবে তার বিচার৷
শিশুশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিড–ডে মিল প্রকল্পের হাল দেখলেই শিশুদের সম্পর্কে তথা সাধারণ মানুষের সম্পর্কে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক রাজ্যগুলিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, মিড–ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ছে৷ মিড–ডে মিলে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের৷ কারণ, এতদিন বরাদ্দ ছিল প্রতি মিলের জন্য প্রাথমিকে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৬ টাকা ৫১ পয়সা৷ এর মধ্যে চাল ডালসবজি ডিম তেল নুন মশলা গ্যাসের খরচ, রাঁধুনির মাইনে সবই ধরা আছে৷ যখন, দেশে ছোট এক ভাঁড় চা পাঁচ টাকার নিচে মেলে না, সেখানে এই টাকায় বাড়ন্ত বাচ্চাদের এক বেলার প্রধান আহার কী করে হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই সকলের আশা ছিল, সরকার নিশ্চয়ই মিড ডে মিলের বরাদ্দ একটা যুক্তিগ্রাহ্য পরিমাণে বাড়াবে৷ পরিবর্তে সরকার কী পরিমাণে বাড়াল? প্রাথমিকের শিশুদের জন্য জনপ্রতি ১৩ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে জনপ্রতি ২০ পয়সা৷ এত বরাদ্দে শিশুদের পুষ্টি–বৃদ্ধি না হয়ে উপায় আছে!
লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার দাম যখন ক্রমাগত কমছে, গরিব মানুষকে ভিক্ষা দিতেও যখন কেউ পয়সা দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না, সেই সময় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মন্ত্রীদের হাতের ফাঁক গলে ১৩ ও ২০ পয়সা বরাদ্দ বাড়ল৷ কোন হিসাব থেকে বিজেপি মন্ত্রীরা এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এই পরিমাণে বরাদ্দ বাড়ালেন? কী পুষ্টিকর খাবার এতে দেওয়া সম্ভব এই মন্ত্রীরা বলবেন কি? এ কি দেশের বিশাল সংখ্যক গরিব পরিবারের শিশুর প্রতি উপহাস নয়?
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড৷ শিশুরা দেশের সম্পদ– প্রধানমন্ত্রী সহ তাঁর দলের সব নেতা–মন্ত্রীরা এ কথা বলে বেড়াচ্ছেন, অথচ বাস্তবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ যে শিশু, তাদের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা করে চলেছে সরকার৷ দেশের আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ ছাত্রের আর্থিক দুরবস্থার কথা যদি সত্যই ক্ষমতাসীন দলগুলি ভাবত, তাদের প্রকৃত শিক্ষাদানের কথা, তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশের কথা ভাবত, তবে এই হাস্যকর বরাদ্দ তাঁরা করতে পারতেন না৷ অর্থ এই ক্ষেত্রে কোনও বাধা হতে পারে না৷ তারা চাইলেই সাংসদদের জন্য সরকারি ক্যান্টিনে বিরিয়ানি নামমাত্র মূল্যে না দিয়ে, সাংসদ–বিধায়কদের বেতন না বাড়িয়ে, সামরিক খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে, ধনকুবেরদের উপর কর বাড়িয়ে, পুঁজিপতিদের কাছ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে, ঋণ খেলাপি বৃহৎ পুঁজির মালিকদের ঋণ–মকুব না করে মিড ডে মিল খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারত৷ ৫ জুলাই কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের পর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর একটি মন্তব্যও, বরাদ্দ তো দূরের কথা৷
শিশুদের পাশাপাশি সারা দেশে ২৬ লাখের বেশি মিড ডে মিল কর্মী রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই মহিলা৷ তারা দিন রাত মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলি চালু রাখেন, শিশু ও মায়েদের পুষ্টিবৃদ্ধির সরকারি প্রকল্পের কাজ করে যান নিরলসভাবে৷ অথচ তাদের বাঁচার মতো মজুরি দেয় না সরকার৷ বাজার, হিসাব, রান্না থেকে শুরু করে তাদের নানা কাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়৷ বিনিময়ে মাস গেলে মজুরি মেলে মাত্র হাজার টাকা অর্থাৎ দৈনিক ৩৩ টাকা৷ যেন দয়া করে সরকার তাদের ভাতা দেয়৷ মিড ডে মিল কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, দৈনিক ৩৩ টাকায় কেউ সংসার চালাতে পারে কি? এই অসহায় শিশু, যাদের মিড–ডে মিল বা সরকারি স্কুলের উপরই ভরসা করে থাকতে হয়, তাদের প্রতি একটু দরদ দরকার৷ আর দরকার মিড–ডে মিল প্রকল্পের পরিকাঠামোর উন্নয়নে সরকারের উপযুক্ত পরিকল্পনা৷ কিন্তু ভোটে জিতে আসা সব দলই এটাকে অবহেলার চোখে দেখে৷ কারণ এই শিশুরা, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মিড–ডে মিল কর্মীরা তাদের আর কী দিতে পারে? উল্টো দিকে পুঁজিপতিদের, ধনকুবেরদের আর্শীবাদ ধন্য হয়েই মসনদে আসীন হয় এই সমস্ত ক্ষমতাপিপাসু দলগুলি৷
নামেমাত্র মিড ডে মিল প্রকল্প রেখে সরকারের বাহাদুরি নেওয়ার কী আছে? দায়িত্ববোধহীন বিজেপি সরকারের ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান কি শুধুই কথার কথা নয়?