মিড ডে মিলে টাকা নেই, ট্যাবের টাকাও চুরি

মিড ডে মিল খাস না কেন? ভাল্লাগে না। ঝোলে কেমন যেন গন্ধ।

বকুনি দিতে গিয়েও থেমে যেতে হয় কলকাতার একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকাকে। যে খাবার আসে মিড-ডে মিলে, সেই সয়াবিনের ট্যালটেলে ঝোল আর খানিক ভেপসে যাওয়া আলুমাখা নিজের সন্তানের পাতে তুলে দিতে পারতেন কি? তাই সন্তানসম কচিমুখগুলোর সামনে চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। গরিব-নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনার এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগানোর কথা বলে যে মিড-ডে মিল প্রকল্পের সূচনা, তার এমন দুরবস্থা কেন? পোলাও কালিয়া মাংস নয়, একটা করে ডিমও কি পড়ুয়াদের পাতে দেওয়া যায় না? সরকারি সাফাই শুনে শুনে মানুষ ক্লান্ত– টাকা নেই। আর আছে সেই চিরাচরিত কেন্দ্র-রাজ্য তরজা। বিগত ১০ মাস ধরে সর্বশিক্ষা মিশন এবং মিড-ডে মিল খাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য ১২০০ কোটি টাকা দেয়নি কেন্দ্র এবং এই অভিযোগ মেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার আবার পাল্টা দোষ চাপিয়ে বলেছেন, কেন্দ্রের জাতীয় শিক্ষানীতি মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত পিএমশ্রী স্কুল চালু করলে তবেই টাকা পাবে রাজ্য। অর্থাৎ শিশুদের পাতে খাবার থাক বা না থাক, স্কুলগুলোর দশা ক্রমশ আরও খারাপ হোক, কেন্দ্রকে ‘জো-হুজুর’ না করলে শিক্ষার খরচ মিলবে না, এই হচ্ছে ‘জনদরদি’ বিজেপি সরকারের আসল মুখ। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে মিড-ডে মিল এর অবস্থা দেখলেও অঙ্ক মিলে যায়, সেখানে আজ অমুক রাজ্যে পচা খাবার খেয়ে শিশুরা অসুস্থ হচ্ছে তো কাল তমুক বিজেপি নেতা মিড-ডে মিলে ডিম দেওয়া বন্ধ করে আমিষের বিরুদ্ধে নিদান হাঁকছেন।

আর এই রাজ্যে প্রায় পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারটির ভূমিকা কী? শিক্ষা তো যৌথ তালিকাভুক্ত, সর্বশিক্ষার টাকা চল্লিশ শতাংশ দেওয়ার কথা রাজ্যেরও। মিড-ডে মিল এবং স্কুলের পরিকাঠামোর খাতে টাকার কথা উঠলেই যাদের টাকার অভাব ঘটে, তারা কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির প্রত্যেক পড়ুয়াকে ট্যাব কেনার জন্য দশ হাজার টাকা দিচ্ছে। জানা যাচ্ছে সেই ট্যাবের বরাদ্দও সরকারি সার্ভার থেকে চুরি করে নিয়েছে হ্যাকাররা। এই লুঠেরাদের মধ্যেও কোথাও প্রভাবশালীর হাত আছে কতটা তা হয়ত পরে জানা যাবে, হয়ত যাবে না। কিন্তু এর সঙ্গে মিড ডে মিলের বরাদ্দ কমার সম্পর্ক কী?

২০১৮-র একটি সমীক্ষা বলছে, পশ্চিমবঙ্গের সব পড়ুয়াকে বছরে ২২০ দিন ডিম দিতে সেই সময় খরচ পড়ত কম-বেশি ৬৯৩ কোটি টাকা। এই ভয়ঙ্কর দুর্মূল্যের বাজারে মিড-ডে মিলের জন্য কত টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার? প্রাথমিক এবং উচ্চপ্রাথমিকে মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ যথাক্রমে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ৮ টাকা ১৭ পয়সা, যে টাকায় আজ একটি স্কুলপড়ুয়া শিশুর পাতে কী রকম পুষ্টিকর পেটভরা খাবার দেওয়া যায় তা সাধারণ বুদ্ধিতে খুঁজে পাওয়া ভার। হিসেব বলছে, এই বরাদ্দ মাত্র ২ টাকা করে বাড়ালে বছরে বাড়তি খরচ হবে ৪ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা। আর কত খরচ হচ্ছে ট্যাব দিতে? এত দিন দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠলে তবে ট্যাব এর টাকা পাওয়া যেত, এ বছর একাদশের পড়ুয়ারাও ট্যাবের টাকা পেয়েছে, ফলে খরচ দ্বিগুণ। একাদশ-দ্বাদশ মিলিয়ে প্রায় পনেরো লক্ষ পড়ুয়াকে মাথাপিছু দশ হাজার টাকা দিতে খরচ হচ্ছে সরকারি কোষাগারের পনেরশো কোটি টাকা। অর্থাৎ মিড ডে মিলে মাথাপিছু খরচ মাত্র ২ টাকা বাড়াতে যে খরচ হয়, ট্যাবের পিছনে খরচ হচ্ছে তার তিনশো গুণেরও বেশি। ডি এল রায় বেঁচে থাকলে হয়তো আরও একবার লিখতেন, ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই রাজ্য, এই দেশ’!

শুধু কি মিড-ডে-মিল এর দশাই শোচনীয়? শিক্ষকের অভাব, নিয়োগ-দুর্নীতি তো আছেই, সরকারি স্কুলশিক্ষার সামগ্রিক পরিকাঠামোর অবস্থা আরও ভয়ানক। গ্রামের দিকের অনেক স্কুলে স্কুলবাড়িই নেই, কোথাও ছাদ ভেঙে জল পড়ে। প্রয়োজনীয় ক্লাসঘর, পর্যাপ্ত টেবিল, বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড, শৌচালয়, আপৎকালীন ওষুধের ব্যবস্থা এই ন্যূনতম দরকারি জিনিসগুলো আছে এমন স্কুলের সংখ্যাই হাতে গোনা। বছরের পর বছর এই ‘নেই রাজ্যের নৈরাজ্য’ চলতে চলতে হাল এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারি স্কুলে এসব কিছুই থাকবে না, এটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে সাধারণ মানুষ। শিক্ষার জন্য অপরিহার্য এই জিনিসগুলো কেন নেই, এই প্রশ্ন তুললেই যারা টাকার অভাবের কথা বলেন, সেই সরকারি কর্তাব্যক্তিরাই কেউ কেউ ট্যাবের সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, উচ্চশিক্ষায় ট্যাব নাকি খুবই জরুরি।

 সত্যিই কি হাতে হাতে ট্যাব দিলে পড়াশুনার উন্নতি হবে? নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর কথা শোনা যাক। ক্লাসে রোজ ঢুলতে থাকে মেয়েটি, প্রায়ই বলে মাথাব্যথা, চোখব্যথা, পড়াশুনায় মন নেই। অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়ে জানা গেল– অনেক রাত পর্যন্ত ফোন ঘাঁটার বদভ্যাস কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না মা-বাবা। লকডাউনের সময় অনলাইন ক্লাসের সুবাদে হাতে ফোন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এখন দরকার না থাকলেও নানা ছুতোয় ফোন নিয়ে বসে পড়ছে মেয়ে। এ তো শুধু একটি মেয়ের ঘটনা নয়, ঘরে ঘরে, স্কুলে স্কুলে স্মার্টফোনের সর্বনাশা আকর্ষণের ফলাফল প্রতিনিয়ত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন অভিভাবক-শিক্ষকরা। শুধু যে শরীর আর মনঃসংযোগের ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, ফোন হাতে পেলে বয়ঃসন্ধির বহু ছেলেমেয়েই এমন জিনিস ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখছে, যা তাদের দেখার কথা নয়।

‘প্রথম এডুকেশন ফাউন্ডেশন’-এর একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পড়ুয়ার কাছে মোবাইল আছে, কিন্তু তারা সেটা ব্যবহার করে পড়াশুনার জন্য খুবই কম, মূলত বিনোদনের জন্যই। কাগজে নিয়মিত লেখা হচ্ছে শরীরে-মনে স্মার্টফোনের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। শিক্ষাবিদ-মনোবিদরা বারবার বলছেন শিশু-কিশোরদের মোবাইল-কম্পিউটার এর ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে। আর রাজ্যের সরকার এই ক্ষতি আটকানোর পরিবর্তে বিপুল টাকা খরচ করে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির প্রত্যেক ছাত্রের হাতে ট্যাব পৌঁছে দিচ্ছে।

ইন্টারনেট স্কুলস্তরের শিক্ষায় ঠিক কী কাজে লাগে? নানা অতিরিক্ত তথ্য জানতে, বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরির কাজে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। কিন্তু এগুলোর একটির জন্যও শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ব্যক্তিগত ট্যাব তুলে দেওয়ার দরকার ছিল না। বরং ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষকরা বাড়তি তথ্য পড়ুয়াদের পৌঁছে দেবেন বা স্কুলের মধ্যেই প্রয়োজনে ইন্টারনেট থেকে কোনও জরুরি বিষয় বুঝিয়ে দেখিয়ে দেবেন, দরকার হলে ক্লাসরুমে অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করবেন, এটাই হওয়া উচিত। কম্পিউটারের জ্ঞান এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে পড়াশুনার মানোন্নয়নই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে সরকারের স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা, ক্লাসরুমে এই ধরনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা, শিক্ষকদের তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার দিকে যত্নশীল হওয়ার দরকার ছিল। তথ্য বলছে, যে টাকা তারা ট্যাবের পিছনে ঢালছেন সেই টাকায় ৭৫ হাজার স্মার্ট ক্লাসরুম, ১৫ হাজার নতুন ক্লাসরুম, ৭৫ হাজার সিসি-ক্যামেরার ব্যবস্থা করা যায়। কাজেই এই অকাতরে ট্যাব বিলানোর পেছনে আর যাই থাক, শিক্ষার উন্নতির কোনও উদ্দেশ্য যে নেই তা বোঝা খুব কঠিন নয়।

তা হলে এর উদ্দেশ্য কী? যে কথা পাঁচজন সাধারণ মানুষ বোঝেন, শিক্ষক অভিভাবকরা বোঝেন সরকারি কর্তাব্যক্তিরা তা কিছুই বুঝতে পারছেন না, এমন ভাবলে ভুল হবে। আসলে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার নাম করে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েকে নানা অবক্ষয় ও বিকৃতির দিকে ঠেলে দেওয়া এর অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এর পেছনে আছে সস্তার ভোট রাজনীতি। মানুষের বেকারি, মূল্যবৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে সরকার যেমন ভোটের আগে নানা ভাতা, পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প দিয়ে চাপা দিতে চায়, ক্লাবগুলোকে ফূর্তি করার টাকা দেয়, এ-ও ঠিক তাই।

 করোনা অতিমারির সময় থেকে রাজ্যে ও দেশের শিক্ষাজগতে একের পর এক পদক্ষেপ ও পরিবর্তনগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে, অতিমারির সুযোগ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে অনলাইন মাধ্যমের দিকে ঠেলে দেওয়া, বেসরকারি কোচিংগুলোকে অবাধ ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া, মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ রেখে স্কুলশিক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে আনা, সরকারি স্কুল তুলে দেওয়া বা সংযুক্ত করিয়ে দেওয়া, সবই একই পরিকল্পনার নানা অংশ। বিজেপির জাতীয় শিক্ষানীতিতে এতেই জোর দেওয়া হয়েছে।

ক্লাসরুমের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষক-পড়ুয়া সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে পাঠক্রমের পড়া ছাড়াও মানবিকতা-মূল্যবোধের যে শিক্ষা হয়, যে সামাজিক মনন গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে, অনলাইন পড়াশুনার প্রবণতা তাকে ইতিমধ্যেই অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঘরে ঘরে ট্যাব পৌঁছে দিয়ে সেই সর্বনাশ আরও পাকাপোক্ত করা হল। পরিণামে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার হাল আরও নামবে, আরও ফুলেফেঁপে উঠবে বেসরকারি স্কুল-ব্যবসা। একটা বিরাট অংশের তরুণ প্রজন্ম আরও হারিয়ে যাবে অশিক্ষার অন্ধকারে।

কেন্দ্রীয় সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ চালু করে শিক্ষার সামগ্রিক পণ্যায়নের যে ছক কষেছে, রাজ্য সরকারের এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত তাকেই আরও সাহায্য করবে। সচেতন প্রতিবাদ-আন্দোলন ছাড়া শিক্ষার এই সর্বনাশ আটকানোর আর পথ নেই।