৮–৯ জানুয়ারি শ্রমিকরা কেন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, তা দাবি সনদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ বাস্তবে পুঁজিপতি–মালিকরা এবং তাদের গোলাম সরকারই শ্রমিকদের এই ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷
শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী আইন তৈরি, মজুরি হ্রাস বা বাঁচার মতো মজুরি না দেওয়া, শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার কেড়ে নেওয়া, স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ না করা ইত্যাদি অসংখ্য শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ সারা দেশের কোটি কোটি শ্রমিককে এই ধর্মঘটের পথে যেতে বাধ্য করেছে৷ মালিকরা সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যেই সর্বোচ্চ শ্রমিক শোষণের পথ নিয়েছে৷ ধর্মঘট এই শোষণের বিরুদ্ধেই শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ বলিষ্ঠ প্রতিবাদ৷ প্রচলিত আইন এই ধর্মঘটকে যে চোখেই দেখুক, ন্যায় এবং মানবিকতার বিচারে এই ধর্মঘট শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, শ্রমিকের অস্তিত্বের শর্ত৷
৮–৯ জানুয়ারি ধর্মঘটের দাবি
১) মোদি সরকারের আনা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতি প্রত্যাহার, ২) মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, ৩) সকলের জন্য চাকরি, ৪) ন্যূনতম ১৮ হাজার টাকা মজুরি, ৫) সমস্ত শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা, ৬) অবসরকালে সুনিশ্চিত পেনশন, ৭) অঙ্গনওয়াড়ি–আশা–মিড ডে মিল–প্যারা টিচার সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি ও এই সব প্রকল্পে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ, ৮) সম কাজে সম বেতন, ৯) শ্রম আইনগুলির কঠোর প্রয়োগ, ১০) রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্ণিকরণ বন্ধ, ১১) বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনের সিলিং প্রত্যাহার, গ্র্যাচুইটির পরিমাণ বৃদ্ধি, ১২) আবেদনের দেড় মাসের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন প্রদান৷ |
মালিকরা বরাবরই ধর্মঘটের বিরোধিতা করে৷ মালিকি চিন্তার প্রভাবে আরেক দল মানুষ ধর্মঘট বিরোধিতায় সুর মেলাবে৷ ধর্মঘটকে ‘কর্মনাশা’ বলে যারা বিদ্রুপ করে তাদের চোখে ধরা পড়ে না মালিকের ‘লকআউটে’ কত কোটি শ্রমদিবস নষ্ট হয়, উৎপাদন ব্যহত হয়৷ ধর্মঘটে দিন–আনা দিন–খাওয়া মানুষের কত কষ্ট হয়, সে কথা তুলে ধরে যাঁরা প্রতিবেদন লেখেন, তাঁরা বাকি দিনগুলিতে অনাহার–অর্ধাহার–অপুষ্টিতে শ্রমিকের মৃত্যুর কথা ভুলেও বলেন না৷ ধর্মঘট হঠাৎ ‘শ্রমিক দরদি’ সাজা, এই ভণ্ডদের মুখোশও খুলে দেয়৷
বিজেপির শ্রমিক সংগঠন বি এম এস বাদে ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে৷ কর্মচারীদের জাতীয় ফেডারেশন সমূহের যৌথ মঞ্চও ধর্মঘটের পথে সামিল হয়েছে৷ এই ধর্মঘটে বিএমএস–এর সামিল না হওয়ার ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে শ্রমিক সংগঠন মানেই শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার সংগঠন নয়, বরং কোনও কোনও সংগঠন শাসকের হাতের ক্রীড়নক৷ তারা শ্রমিক দরদি সেজে শ্রমিকদের ভিতরে থেকে মালিকদের স্বার্থেই কাজ করে যায়৷
২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রথমে পাঁচ দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন শুরু করে৷ পরবর্তীকালে ১০ দফা দাবি এবং বর্তমানে ১২ দফা দাবিতে দেশব্যাপী শ্রমিকরা যৌথভাবে কনভেনশন, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, আইন অমান্য ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সরকার ও মালিক পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু মালিক শ্রেণি ও তার সেবক সরকার শ্রমিকদের দাবির প্রতি কোনও গুরুত্বই দেয়নি৷ সরকার শ্রমিকদের দাবি শুধু উপেক্ষাই করেছে তাই নয়, আরও বেশি বেশি মাত্রায় আক্রমণ নামিয়ে এনেছে৷ যার ফলে ধর্মঘট অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের ২ সেপ্ঢেম্বর সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়েছে৷ তবুও পুঁজিপতি শ্রেণির সেবায় নিবেদিত সরকার শ্রমিকদের স্বার্থে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি, মালিক শ্রেণিকেও শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনার জন্য কোনও চাপ দেয়নি৷ এই পরিস্থিতিতে ৮–৯ জানুয়ারি ২০১৯ আরেকটি বনধ ডাকা হয়েছে৷
সরকার ও মালিকপক্ষের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী মনোভাবের কারণে আগের ধর্মঘটগুলিতে দাবিগুলির মীমাংসা না হলেও তার অনেক সাফল্য রয়েছে৷ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা দেখিয়ে দেয় উৎপাদনের আসল শক্তি তারাই, মালিকরা নন৷ প্রতিটি ধর্মঘট ব্যক্তি শ্রমিককে উপলব্ধি করায় তাঁরা একা নন৷ ধর্মঘটের সময় শ্রমিকরা সহজেই বুঝতে পারে কে তার শত্রু, কে মিত্র৷ ধর্মঘটে মজুরি মার গেলেও শ্রমিক বুঝতে পারে, ভয়ঙ্কর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে এ তার প্রয়োজন৷ ধর্মঘট শ্রমিক জীবনে নিয়ে আসে সাহস৷ পুঁজির নির্যাতন থেকে মুক্তির চিন্তা শ্রমিকদের মধ্যে এনে দেয় ধর্মঘট৷
আবার শুধু ধর্মঘট করলেই, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক দাবি দাওয়া নিয়ে মারমুখী লড়াই করলেই শ্রমিকের মুক্তি হবে না৷ শ্রমিককে বুঝতে হবে, ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শ্রমিককে দেখাতে হবে, কেন শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই তাদের জীবনের দুঃসহ অবস্থার জন্য দায়ী৷ আর এই শোষণ ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হলে মজুরদের মধ্যে উপযুক্ত রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সংগঠনের বা সংগ্রাম কমিটির জন্ম দিতে হবে৷ ধর্মঘটের সাথে সাথে এই কাজটি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷
বর্তমানে বেশিরভাগ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শ্রমিকদের বলেন, আমার ইউনিয়ন কর, এই সুবিধা পাবে, সেই সুবিধা পাবে৷ শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়ন যেমন বলে, আমরা সরকারে আছি, শ্রমিকদের বেশি সুবিধা আমরাই দিতে পারি৷ এখন যেমন বলছে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন৷ আগে যেমন বলেছে সিপিএমের ট্রেড ইউনিয়ন৷ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্পর্কে কার্ল মার্কসের বক্তব্য ছিল –শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করবে, কারণ এটা হচ্ছে ‘স্কুল অব কমিউনিজম’৷ সাম্যবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের হাতেখড়ি হয় এখানে৷ সকলে মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিদিনের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শ্রমিক ঘটনা বিশ্লেষণের, সত্যানুসন্ধানের সুযোগ পায়৷ সে বুঝতে পারে কেন বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই৷ যথার্থ বিপ্লবীরা ছাড়া আর কেউই প্রতিদিনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের এভাবে শিক্ষিত করে তুলতে চায় না৷ বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষাকে হাতিয়ার করে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন এ আই ইউ টি ইউ সি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে৷
৮–৯ জানুয়ারির ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করার জন্য এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত ইউনিয়নগুলি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ সারা বাংলা নির্মাণ কর্মী ইউনিয়ন, সারা বাংলা মোটর ভ্যান চালক ইউনিয়ন, সারা বাংলা টোটো চালক ইউনিয়ন, অল বেঙ্গল হকার্স ইউনিয়ন, সারা বাংলা আশাকর্মী ইউনিয়ন, ওয়েস্ট বেঙ্গল অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড হেল্পার্স ইউনিয়ন, সারা বাংলা মিড–ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন, ওয়েস্ট বেঙ্গল হোসিয়ারি মজদুর ইউনিয়ন, আই ডি বি আই কন্ট্র্যাক্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, বেঙ্গল জুট মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার মেন্স ইউনিয়ন, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, দুর্গাপুর স্টিল ওয়ার্কার্স কো–র্ডিনেশন কমিটি, কোলিয়ারি ওয়ার্কার্স কো–র্ডিনেশন কমিটি, কোল মাইনার্স ইউনিয়ন, সি টি সি ট্রাম সমন্বয় সমিতি, গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, লরি ট্রান্সপোর্ট এমপ্লয়িজ অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (ওয়েস্ট বেঙ্গল), অল ওয়েস্ট বেঙ্গল প্যারা–মেডিক্যাল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, সারা বাংলা প্রাণীবন্ধু কর্মচারী ইউনিয়ন, ওয়েস্ট বেঙ্গল সিকিউরিটি কন্ট্র্যাক্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, পৌরকর্মী ইউনিয়ন, ওয়াটার ক্যারিয়ার–সুইপার কর্মচারী ইউনিয়ন, নর্থ বেঙ্গল টি প্ল্যানটেশন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন সহ জেলাভিত্তিক সমস্ত এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার অভিযান শুরু হয়েছে৷