আমাদের এই সমাজটি যে শোষক ও শোষিতে বিভক্ত এবং শোষক পুঁজিপতি শ্রেণিই যে সমাজকে পরিচালনা করে, তারাই যে রাষ্ট্র ও সরকারের আসল পরিচালক, এ কথা বহু মানুষই সাধারণ আলোচনায় মানতে চান না। তাঁরা বলেন, ও মশাই এ-সব আপনাদের, কমিউনিস্টদের প্রচার। ও আপনারাই শুধু শ্রেণি দেখতে পান। দেশের বর্তমান ভয়াবহ আর্থিক পরিস্থিতি কিন্তু এমন সব মানুষেরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব এবং পুঁজিপতি শ্রেণির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাটি।
গত পৌনে দু’বছরে করোনা মহামারিতে যখন হাজারে হাজারে মানুষ মারা গেছে, বিনা চিকিৎসায় ধুঁকেছে, লক্ষ লক্ষ ছোট-মাঝারি কল-কারখানা-ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, কয়েক কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে, অর্থাৎ মানুষের জীবনে দুঃসহ সঙ্কট নেমে এসেছে ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেল, ভারতে বিলিয়ন ডলারের মালিকের সংখ্যা (অন্তত ৭৪০০ কোটি টাকার সম্পদ যাঁদের) ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪২। এঁদের মিলিত সম্পদের অঙ্ক ৫৩ লক্ষ কোটি টাকা। ধনকুবেরদের সম্পদ এতটাই বেড়েছে যে, প্রথম ১০ জনের মোট বিত্তকে কাজে লাগাতে পারলে আগামী ২৫ বছর দেশের স্কুল শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার খরচ উঠে আসবে। দেশের ধনীতম ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ, আর জনসংখ্যার নীচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। আবার ধনীতম ৯৮ জনের হাতে রয়েছে নিম্নতম ৫৫.৫ কোটি মানুষের সম্পদের সমান টাকা।
করোনা অতিমারির সময়ে সম্পদের এমন বৈষম্যের কথাই উঠে এসেছে অক্সফ্যাম ইন্ডিয়ার সমীক্ষায়।
বিশ্বায়ন পুঁজিপতিদের অবাধ লুটের সুযোগ করে দিয়েছে
এ বার দেখা যাক, করোনা অতিমারি যা সাধারণ মানুষের জীবনে সর্বনাশ নামিয়ে এনেছে তা অতিধনীদের জীবনে কী বিরাট সৌভাগ্য এনে দিয়েছে। ‘আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া’-র প্রকাশিত ২০২১-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর পরিবার দৈনিক আয় করেছেন ১০০২ কোটি টাকা। গত দু’বছরে তাঁদের সম্পত্তি ২৬১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬.৭২ লক্ষ কোটি টাকা। আম্বানিদের সম্পত্তি ২৫০ শতাংশ হারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭১ লক্ষ কোটি টাকা। আদানি এখন আম্বানিদের টপকে এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। শুধু তো আদানি-আম্বানিরাই নন, অতিমারির সময়ে ভারতীয় ধনকুবেরদের সম্পত্তি ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা।
অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী থেকে সরকারের আর্থিক উপদেষ্টা সকলেই দেশের মানুষকে প্রতিদিন শোনাচ্ছেন, দেশের জিডিপির রেকর্ড হারে বৃদ্ধি ঘটছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তা হলে সেই বৃদ্ধি দেশের সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না কেন? সাধারণ মানুষের জীবনে বৃদ্ধি তো দূরের কথা, তারা ক্রমাগত দারিদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী-বর্ণিত আর্থিক বৃদ্ধি সত্যিই ঘটছে ধরে নিলে তার ফল কারা ভোগ করছে তা উপরের তথ্য থেকেই তো স্পষ্ট!
পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার সরকারের মন্ত্রীরা
স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের মনে এই প্রশ্ন ধাক্কা দিচ্ছে যে, এমন ভয়ঙ্কর অতিমারির সময়ে সাধারণ মানুষ যখন সর্বস্ব হারাচ্ছে, তখন এমন অবিশ্বাস্য মুনাফা পুঁজিপতিরা করতে পারছে কী করে! সাধারণ মানুষ বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, সরকার কেন তাদের এই লুঠতরাজে বাধা দেয় না?
প্রশ্নটা অত্যন্ত ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু যাঁরা এই প্রশ্ন করেন, তাঁরা খুঁটিয়ে বিচার করলে দেখতে পাবেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে অন্যায়ের উপর। বঞ্চনাই তার ভিত্তি। অন্যকে শোষণ না করলে, বঞ্চিত না করলে আর এক জনের লাভ হয় না, ধনবৃদ্ধি হয় না। এই তার নৈতিকতা, এই তার আইন! তাই শোষণ, লুণ্ঠন সবই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আইনসঙ্গত। এই নীতির উপরই দাঁড়িয়ে আছে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাই সেই রাষ্টে্রর যারা পরিচালক, সরকারের যারা পরিচালক তাদের কাছেও ন্যায়সঙ্গত আচরণ আশা করা যায় না। সরকার তথা সরকারের মন্ত্রীরা পুঁজিপতিদের এই লুঠতরাজে বাধা দেয় না, দিতে পারে না। কারণ তাঁরা এই পুঁজিপতি শ্রেণিরই রাজনৈতিক ম্যানেজার। পুঁজিপতিরাই তাঁদের নেতা হিসাবে তুলে আনে, প্রচার দিয়ে তাঁদের নির্বাচনে জেতায়। প্রচারের খরচ, দল চালানোর খরচ সবই জোগায় এই পুঁজিপতিরা। বিনিময়ে এইসব নেতারা সরকারে গিয়ে, মন্ত্রী হয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে। পার্লামেন্টে, বিধানসভায় গিয়ে তারা যে আইন তৈরি করে তা পুঁজিপতিদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। স্বাধীনতার পরে যেদিন তারা জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি গড়ে তুলেছিল সেদিনও তার উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা, আবার আজ যখন সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত তথা সরকারি শিল্প, সংস্থা, সম্পত্তি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে, সে-ও তাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই। এটা স্পষ্ট যে, ধনকুবেরদের এই বিপুল ধনবিস্ফোরণ কোনও ধনকুবেরের যোগ্যতায়, ব্যক্তিগত কৃতিত্বে হয়নি। পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ারই ফল এটি।
সরকারি সম্পত্তির অবাধ লুঠ
বিশ্বায়ন, উদারিকরণের নামে, সংস্কারের নামে একের পর এক সরকার ক্ষমতায় বসে পুঁজিপতিদের সীমাহীন লুঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই লুঠের পথে পুরনো আইনে সামান্য হলেও যতটুকু বাধা ছিল সেগুলিকে বদলে দিয়েছে, লুঠের আরও বেশি সহায়ক নতুন আইন তৈরি করেছে, প্রতিদিন আরও নতুন নতুন আইন তৈরি করে চলেছে। জনসাধারণের উপর ক্রমাগত একের পর এক ট্যাক্স চাপাচ্ছে, বিপরীতে পুঁজিপতিদের ট্যাক্স কমাচ্ছে, ট্যাক্স ছাড় দিচ্ছে। ব্যাঙ্কগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে নিয়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা তা শোধ না করে গায়েব করে দিচ্ছে। সরকার প্রতিটি বাজেটে জনগণের করের থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলিতে আবার জমা করে দিচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের মুনাফার এই পাহাড়ের একটি অংশ আসলে জনগণেরই করের টাকা।
‘বাজারের স্বাধীনতা প্রয়োজন’ এই বুলি আওড়ে আসলে পুঁজিপতিদের অবাধ লুঠতরাজের স্বাধীনতাই দিয়ে দিয়েছে সরকারগুলি। বিশ্বায়নকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ফলে গোটা দুনিয়ায় যে আর্থিক সম্পদের বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটেছে তা কোথাওই দরিদ্র মানুষের, সাধারণ মানুষের, শ্রমিক-কৃষকের জীবনে এতটুকু সমৃদ্ধি বয়ে আনেনি। তার সমস্ত ফল আত্মসাৎ করেছে পুঁজিপতি শ্রেণি, বৃহৎ পুঁজিপতির দল। বঞ্চিত হয়েছে শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে পণ্য তৈরির সময় যে মূল্য যোগ করে মানুষের জীবন্ত শ্রম, ১৯৮০-৮১ তে তার ২৮.৫ শতাংশ পেত শ্রমিক, ২০১৪ তে তা ৯ শতাংশেরও নীচে চলে গেছে। শ্রমিকদের এই সীমাহীন বঞ্চনা মালিকদের মুনাফাবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই যুগেই আর্থিক বৈষম্য আকাশ ছুঁয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতেও পুঁজিপতিরা অবাধে লুঠ চালিয়েছে
করোনার তাণ্ডবলীলা দেখিয়ে দিয়েছে এই সরকার, এই রাষ্ট্র আসলে কার। একটা অতিমারির ধাক্কা দেশের বিরাট সংখ্যক দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনকেও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এবং তা এমনই যে, সরকার হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করলে সেই মানুষদের পক্ষে একদিনও শহরে টিকে থাকা অসম্ভব হয়েছে। তাঁরা এমনকি পায়ে হেঁটেও হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরতে চেয়েছেন।
করোনা অতিমারির সময়ে যখন লাগাতার লকডাউন চলেছে তখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার নাম করে সরকার পুঁজিপতিদের জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। আর সেই টাকার বেশির ভাগটাই নানা কায়দা আর চালাকিতে গিয়ে ঢুকেছে বৃহৎ পুঁজিপতিদের ভাণ্ডারে। বিপরীতে সরকার সাধারণ মানুষের জন্য রেশনে যে খুদ-কুঁড়োটুকু ছুঁড়ে দিয়েছিল তা-ও এখন বন্ধ করে দিয়েছে। মহামারিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে, ওষুধের অভাবে কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেছে, তাদের শেষকৃত্যটুকুর দায়িত্বও সরকার নেয়নি– মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, চরে পুঁতে দেওয়া হয়েছে, শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে।
করোনা অতিমারিতে সাধারণ মানুষের জীবন যখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত তখন এই অসহায়তাকে পুঁজি করেই মাস্ক, স্যানিটাইজার, ওষুধ, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা-সরঞ্জামের ব্যবসা করে একদল পুঁজিপতি শত-কোটিপতি বনে গিয়েছে। আর একদল পুঁজিপতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সুযোগে, বহু অফিসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ হওয়ার সুযোগে ফোন, ইন্টারনেট-সরঞ্জাম এবং ডেটা, অ্যাপের ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে এই সব কিছুর আকাশছোঁয়া দাম বাড়িয়েছে এবং বিপুল মুনাফা করেছে। কারণ, সরকারগুলি করোনার অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। জনসাধারণের জন্য বিকল্প শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা করেনি। এই ভাবে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কয়েকটি প্রজন্মকে অশিক্ষার অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলেছে।
দুর্নীতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ চরিত্রে পরিণত হয়েছে
পুঁজিপতিদের এই অস্বাভাবিক মুনাফার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস সরকারি সম্পত্তির আত্মসাৎ। অর্থাৎ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে, বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে প্রচলিত রাস্তায় মুনাফা অর্জন নয়, সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে, নেতাদের সঙ্গে, এমএলএ-এমপিদের সঙ্গে অন্যায় যোগসাজশে, গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে, নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের ঘুষ দিয়ে, কিনে নিয়ে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করে মুনাফা বাড়িয়ে তোলা। ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির বিপুল ধনবৃদ্ধির পিছনে এই দুর্নীতি প্রবল ভাবে কাজ করে চলেছে। সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের সাথে এমন অসৎ যোগসাজশের মধ্যে দিয়ে ধনবৃদ্ধির এই পদ্ধতিকে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলেন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্যাঙাৎতন্ত্র। তাঁরা দেখাতে চান, এটা আসল পুঁজিবাদ নয়, পুঁজিবাদের বিকৃতি। বাস্তবে এটা এসেছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম মেনেই, তার ফল হিসাবে। ফলে স্যাঙাৎতন্ত্র পুঁজিবাদের থেকে আলাদা তো নয়ই, বরং তার চূড়ান্ত অবক্ষয়িত রূপ। পুঁজিবাদের বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল স্তরে দেশে দেশে পুঁজিবাদের এটাই এখন সাধারণ চরিত্র। একদা আম্বানিদের উত্থান, সম্প্রতি আদানিদের উত্থান এই স্যাঙাৎতন্ত্রেরই ফল। এই যোগসাজশের কারণেই পুঁজিপতিরা অবাধে সরকারের সম্পত্তি, যা আসলে জনগণের সম্পত্তি, সেগুলি অবাধে লুঠ করে যায়, সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা হয় চোখ বুজে থাকে, না হলে সরাসরি সেই কাজে সহায়তা করে। তাই আজ জনগণের সমস্ত সম্পত্তি– কল-কারখানা, রেল তেল গ্যাস খনি বন্দর বিদ্যুৎ স্কুল কলেজ হাসপাতাল সবই পুঁজিপতিদের মুঠোয়। স্যাঙাৎদের বদান্যতাতেই আম্বানিরা সমুদ্রের তলায় ওএনজিসির একের পর এক তেল ব্লক থেকে তেল চুরি করে সেগুলি ফাঁকা করে দেয়। চুরির তদন্তে তারা দোষী সাব্যস্ত হলে, আবার নতুন তদন্ত করে তাদের ক্লিনচিট দিয়ে দেওয়া হয়। আদানিরা কয়লা আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অন্যায়ের এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্ব দুর্নীতি সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ৮৫।
পুঁজিবাদের সেবকরা দুর্নীতিগ্রস্ত হবেই
আজ যে সরকারি শিল্প, সংস্থা, সম্পত্তি সব কিছুর বেশির ভাগই যে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির কুক্ষিগত হচ্ছে তার পিছনেও কাজ করছে নেতা-মন্ত্রীদের সাথে পুঁজিপতিদের গোপন বোঝাপড়া-লেনদেন। এরই ফলে রেল থেকে প্রতিরক্ষা, বন্দর থেকে বিদ্যুৎ সবই পাচ্ছে মূলত আম্বানি-আদানি এবং কয়েক জন পুঁজিপতি। এই পুঁজিপতিরাই আজ নানা বিষয়ে সরকারের নীতি ঠিক করে দিচ্ছে। এমনকি তাদের পছন্দমতো লোককে নির্দিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে তারাই ঠিক করে দিচ্ছে। টু-জি কেলেঙ্কারির সময় তদন্তে উঠে এসেছিল কী ভাবে টাটারা সেই সময়কার টেলিকম মন্ত্রীর নাম ঠিক করে দিয়েছিল। ঠিক তেমনই আম্বানিরা ঠিক করে দেয় তেলমন্ত্রীর নাম। এরই ফলে, সরকারি টেলিকম সংস্থা বিএসএনএল দিনে দিনে ধুঁকতে থাকে আর জিও-র ব্যবস্থা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে চলে গেলেও দেশের মানুষকে বেশি দামে কিনতে হয়। এরই ফলে একদিন যে রাজনীতিবিদরা, নেতারা সাধারণ মানুষের থেকে উঠে আসতেন, সাধারণ জীবনযাপন করতেন, আজ তাদের অধিকাংশই কোটি কোটি টাকার মালিক, লোকসভায়, রাজ্যসভায়, বিধানসভাগুলিতে ৯৯ শতাংশ সদস্যই কোটিপতি, বহু-কোটিপতি। অধিকাংশই রাজনীতির বাইরে বিরাট বিরাট কারবারের মালিক। শিল্পপতি, পুঁজিপতিরা অন্যায় সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে এদের ঘুষ দেয়, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেয়, প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব এমএলএ-এমপিরা যে আইন তৈরি করেন তা জনস্বার্থকে প্রতিফলিত করে না, পুঁজিপতিদের স্বার্থকেই রক্ষা করে। এই সব পুঁজিপতিরা তাদের অনুগত পার্টিগুলিকে যেমন নিজেদের মালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমে প্রচার দেয়, তেমনই বিপুল পরিমাণ ফান্ড জোগায়। সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম-এর পেশ করা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটির মালিক হয়েছে বিজেপি। ২০১৯-২০ সালের হিসেব অনুযায়ী বিজেপির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা। বাকি পঞ্চাশটি সর্বভারতীয় এবং আঞ্চলিক দলের মিলিত সম্পদের যেয়েও যা বেশি। এই টাকার উৎস কী? এই টাকা তো জনগণ দেয়নি। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) যেভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গণআন্দোলনের খরচ সংগ্রহ করে, এই টাকা তো সেইভাবে সংগ্রহ করা হয়নি। এই টাকার সিংহভাগই এসেছে অন্যায় ভাবে সুবিধা পাওয়া এই সব পুঁজিপতিদের থেকে।
দুর্নীতিগ্রস্ত দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের এই যে যোগসাজশ, যে মিথোজীবিতা অর্থাৎ পরস্পরের স্বার্থে পরস্পরের অবস্থান, এর বলি হচ্ছে জনগণ তথা শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের স্বার্থ। এই সব রাজনৈতিক দলগুলি মুখে জনস্বার্থের কথা বলে আর কাজে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখে। তাই পার্লামেন্টে কৃষি-আইন কোনও বিতর্ক ছাড়াই পাশ হয়ে যায়। কৃষি আইনের বিরোধিতায় কৃষকরা বছরভর খোলা আকাশের নীচে বসে থাকলেও নামকরা দলগুলি, তাদের নেতারা কেউ সেই প্রতিবাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। এই পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতেই শ্রমিকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে পুরনো শ্রমআইন বাতিল করে নতুন আইন আনা হয়েছে। আইন সরলীকরণের নামে সেই আইনে শ্রমিকদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহু সংগ্রামে অর্জিত আট ঘণ্টা কাজের অধিকারকে অতীতের বিষয় করে দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ে সব কাজকেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে (ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট) করে দেওয়া হয়েছে। মালিক শ্রেণির এই সীমাহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাতে সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে সে-জন্য আইনে সংগঠিত হওয়ার, প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
অসাম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই ব্যবস্থার বদল অবশ্যম্ভাবী
এর থেকেই তো স্পষ্ট পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় আইন যা তৈরি হয় তা শোষিত মানুষের নয়, শুধুমাত্র পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্যই। এবং সরকারগুলিও শুধুমাত্র শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে, শ্রমজীবী জনগণের নয়। এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পুঁজিবাদী এই উৎপাদন ব্যবস্থাটি, তার আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি সবকিছুই দেশের বেশির ভাগ মানুষকে শোষণ-লুণ্ঠনের জন্যই তৈরি হয়েছে। তাই শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই ব্যবস্থাটিকে না বদলে, শুধু কয়েকজন মন্ত্রীকে বদলে, একটি সরকারকে বদলে শোষণ-লুণ্ঠনের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। পাঁচ বছর অন্তর একবার ভোট দিয়ে মানুষের এই দুরবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। সচেতন সংগঠিত শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলনের আঘাতে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে শ্রমিক-কৃষকের রাজ গড়ে তুলেই একমাত্র শোষণের অবসান ঘটানো সম্ভব। শোষিত মানুষের মুক্তির এই রাস্তাটি দেখিয়ে গিয়েছেন মহান কার্ল মার্কস। তিনি দেখিয়েছেন, আজ শোষিত শ্রেণি তথা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ সমাজের প্রায় সমস্ত মানুষের স্বার্থের সাথে একাকার হয়ে গেছে। পুঁজির ব্যাপক কেন্দ্রীভবনের মধ্য দিয়ে উৎপাদনের সামাজিক চরিত্রের সাথে উৎপাদনের মালিকানা ব্যক্তিগত হওয়ায় উভয়ের বিরোধ আজ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই রয়েছে সমাজ পরির্বতনের, বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবিতা।