এবারের গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ভারত সরকারের বিদ্যুৎদপ্তর বলছে, কয়লার অভাবে দেশের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সংকটের মুখে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রাজ্যে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ার ফলে শুরু হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং।
কেন এই সংকট? সত্যিই কি আমাদের দেশে কয়লার অভাবের জন্য এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে? নাকি এর পিছনে রয়েছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এক গভীর ষড়যন্ত্র? এ কথা সত্য, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে প্রবল তাপ প্রবাহের জন্য গত বছরের তুলনায় এ বার বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার কয়লা সরবরাহের অভাবে গত বছরের অক্টোবরে একইভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তা হলে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কেন? কেন গত বছরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্রীয় শক্তিমন্ত্রক যথা সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি?
ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা মূলত কয়লার উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৬৬ শতাংশ আসে তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ১৭৩টি তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কয়লার ৭০ শতাংশ সরবরাহ করে ভারত সরকারের সংস্থা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড। এ ছাড়া রয়েছে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিজস্ব কোল ব্লক। তা হলে অভাব কেন?
একসময় কোল ইন্ডিয়ার কয়লা ছিল উদ্বৃত্ত। ২০১৬-তে তারা দেশের চাহিদা মিটিয়েও বাংলাদেশকে কয়লা সরবরাহ করেছে। তা হলে উৎপাদন ব্যবস্থা আজ দুর্বল কেন? বাস্তবে কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারি মালিকদের স্বার্থে কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে যথাযথভাবে ব্যবহার করছে না। দেশের তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই সংস্থাকে সুপরিকল্পিতভাবে দুর্বল করছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর ‘কয়লায় আত্মনির্ভরতা’ ঘোষণাটি যে কতবড় মিথ্যাচার তা বুঝিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সঙ্কট। ওই বছর কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডের বাড়তি মজুত (সারপ্লাস রিজার্ভড) ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী বর্তমান খনিগুলোর সম্প্রসারণ ও নুতন খনি খোলার কাজে ব্যবহার না করে কেন্দ্রীয় বাজেটের আর্থিক ঘাটতি পূরণের জন্য আত্মসাৎ করেছে সরকার। এই ঘটনা না ঘটলে কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। তা সত্ত্বেও কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড গত বছরের তুলনায় বর্তমান সময়ে প্রায় ১৫.৬ শতাংশ বেশি কয়লা উৎপাদন করেছে। তা হলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কয়লার অভাবে উৎপাদন সংকটের মুখে পড়ছে কেন?
সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি অথরিটি (সিইএ)-র নির্দেশানুযায়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সব সময় ২২-২৫ দিনের কয়লা মজুত থাকার কথা। কিন্তু কী কারণে কয়লা মজুত রাখা সম্ভব হচ্ছে না? কেন ৯৩টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার চরম সংকট? এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎদপ্তর দোষ দিচ্ছে রেলদপ্তরকে। বলছে, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ‘রেক’ (পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মালগাড়ি) সরবরাহ করতে পারছে না রেল-কর্তৃপক্ষ।
সিইএ-র তথ্য অনুযায়ী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লা পৌঁছতে সারা ভারতে প্রতিদিন ৪৭৩টি রেক প্রয়োজন। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল ৩৭৯টি রেক। পরে তা বেড়ে হয়েছে ৪১২টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কেন রেল প্রয়োজনীয় রেক দিল না ? কেন রেল, কয়লা এবং বিদ্যুৎ দপ্তরের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হলেন না? এই ঘটনাগুলি কি নিছক কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের জন্য ঘটছে, না অন্য কোনও গভীর কারণ রয়েছে এর পিছনে?
এই সংকট মোকাবিলায় কোল ইন্ডিয়ার খনি এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অধীনে থাকা খনিগুলি থেকে উৎপাদন বাড়াতে বলাটাই ছিল সমস্যা সমাধানের সহজ উপায়। অথচ ২৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ দপ্তর সরকারি বেসরকারি সমস্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করার আদেশ জারি করেছে। যে ভারত ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কয়লা রপ্তানি করত, তাদের কেন বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে? যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বাড়ছে তখন কয়লা আমদানির উপর নির্ভরতা কাদের স্বার্থে?
সরকারি আদেশনামায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে তার প্রয়োজনের ১০ শতাংশ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতেই হবে। আরও বলা হয়েছে, আমদানিকৃত কয়লার ৫০ শতাংশ ৩০ জুনের মধ্যে এবং ৪০ শতাংশ ৩১ আগস্টের মধ্যে এবং বাকি ১০ শতাংশ আমদানি করতে হবে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে। এই কয়লা বিদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করবে আদানি গোষ্ঠী সহ বৃহৎ পুঁজিপতিরা, যারা বিদেশে বহু কয়লা খনির মালিক। তারা এর থেকে বিপুল মুনাফা লুটবে। এ জন্যই দেশের বাজারে কয়লার কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে ‘আত্মনির্ভরতা’-র বুকে ছুরি মেরেছে বিজেপি সরকার।
বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করার জন্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উপর ব্যাপক আর্থিক চাপ বাড়বে। প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ চাপবে দেশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উপর। এই বিপুল বাড়তি টাকার দায়িত্ব বহন করবে কে? অবশ্যই বিদ্যুৎগ্রাহকদের বলির পাঁঠা বানিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে এই টাকা আদায় করা হবে।
প্রশ্ন হল বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কয়লাই যদি সমস্যার সমাধান হবে, তা হলে কেন গুজরাতের মুন্দ্রাতে আমদানি করা কয়লার উপর নির্ভরশীল আদানির ৪৬০০ মেগাওয়াট এবং টাটার ৪০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এই সংকটের সময় তাদের উৎপাদন ক্ষমতার চাইতে অনেক কম উৎপাদন করছে? কেন কেন্দ্রীয় সরকার এই সব পুঁজিপতিদের বাধ্য করছে না পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে? এই বৃহৎ পুঁজিপতিরা বিদেশে নিজেদের খনি থেকে আমদানিকৃত কয়লার দাম সরকারের মদতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে বেশি করে দেখিয়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলিকে বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করে কৃত্রিম ভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এটা আমাদের কথা নয়, ভারত সরকারের ডাইরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স-এর রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে এই কারচুপি উল্লেখিত হয়েছে। এবার মোদি সরকার দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও কয়লা রপ্তানির অধিকার দিয়ে এই বৃহৎ মালিকদের লুটের রাস্তা প্রশস্ত করল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন কোম্পানিগুলির মাঝের কারচুপিপূর্ণ পাওয়ার পার্চেজিং এগ্রিমেন্ট (পিপিএ)।
দেশের অভ্যন্তরে কয়লার কোনও অভাব নেই। কয়লার এই সংকট কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য। এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া কোনও দলই সরকারের এই ষড়যন্ত্রের স্বরূপ জনসমক্ষে ফাঁস করেনি। জনগণের কাছে এস ইউ সি আই (সি)-র আবেদন, এর বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ গ্রাহক কমিটি গড়ে তুলে আন্দোলনে সোচ্চার হোন। দাবি তুলুন–
১) বিদ্যুৎকে মুনাফার পণ্য করা চলবে না,
২) কয়লার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা চলবে না,
৩) দেশীয় খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে,
৪) পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে বিদেশ থেকে অপ্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করার সরকারি আদেশনামা অবিলম্বে প্র্যত্যাহার করতে হবে,
৫) যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা না কমিয়ে তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লা মজুত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রেক সরবরাহের ব্যবস্থা ভারতীয় রেলকে সুনিশ্চিত করতে হবে,
৬) কয়লা খনি অঞ্চলে অবস্থিত তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা পূর্ণ মাত্রায় বজায় রাখতে হবে।