ক’দিন আগেই ওরা এসেছিল আমার দোকানে। যেমন প্রায়ই আসে পার্টির কাগজ নিয়ে। সেদিন একটা হ্যান্ডবিল দিয়ে বলল, ২৯ তারিখ গণ আইন অমান্য, দেখতে আসবেন। দেখলাম, এসএসসি-নার্সিং দুর্নীতি-রান্নার গ্যাসের দাম বাড়া-মেয়েদের ওপর অত্যাচার এরকম নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলন। ওদের বাক্সে দশ টাকা ফেলে একটু মজা করেই বলেছিলাম, ‘মার খেতে নয় তো?’ সুন্দর ঝকঝকে চেহারার ছেলেটি হেসে বলল, ‘না না ওটার জন্য আমরা আছি। আপনাদের ডাকছি দেখার জন্য, পাশে থাকার জন্য।’ তারপর পাশের মহিলা কর্মীকে দেখিয়ে ছেলেটি বলল, ‘ধরুন এই দিদি আহত হলেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতেও তো সাহায্য লাগবে, তাই না?’
ওরা চলে যাওয়ার পর সেদিন বেশ কিছুক্ষণ বসেছিলাম চুপ করে। না চাইলেও বারবার মনে ভিড় করছিল ছেলেটির শান্ত ভাবে হেসে বলা কথাগুলো। সত্যিই কি পুলিশ মারবে ওদের? পুলিশের সাথে এইসব ছেলেমেয়েগুলো লড়তে পারবে? এই দলটা তো বরাবরই মার খায় জানি, লড়াই করে। তাও মনে হয়, কী হবে এসব করে? কিছুই তো পাল্টাচ্ছে না। চারপাশ দেখে হতাশ লাগে, মনে হয় এ রাজ্যে, এ দেশে কিছু হবে না। তবু সেদিন ভেবেছিলাম, যাব নাকি একবার? দেখে আসব ওদের জমায়েত? তারপর ভুলেই গেছি ওদের কথা। সেদিন যখন পাশের দোকানের দিলীপদা এসে বলল, টিভিতে দেখছ এসইউসি’র ছেলেমেয়েগুলোকে কী রকম মারছে? বুকটা কেঁপে উঠল। মনে পড়ল, আজই তো ঊনত্রিশ, বুধবার। মোবাইলে নিউজ চ্যানেল খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হাজার হাজার মানুষের মিছিল ঢেউয়ের মতো এগোচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে। পুলিশ পাগলের মতো লাঠি ঘোরাচ্ছে, রাস্তায় ফেলে মারছে, মহিলাদেরও রেয়াত করছে না, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রিজন ভ্যানের দিকে। ওরই মধ্যে একটি মেয়ে হাত মুঠো করে স্লোগান দিচ্ছে, ‘আইন ভাঙো জেলে চলো।’ একজনের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। তবু সে এগোচ্ছে পুলিশের চোখে চোখ রেখে। একজনকে বাঁচাতে দশজন এগিয়ে আসছে। লাঠি হেলমেট-বর্ম নিয়েও পুলিশ যেন পেরে উঠছে না এদের তেজের কাছে। হঠাৎ কেমন চোখে জল এসে গেল আমার। টিভির পর্দায় যা দেখছি, তা কি এই সমাজের ছবি? যেখানে রাজনীতি মানে নেতা-মন্ত্রীদের নির্লজ্জতা, দিনে-রাতে দলবদল, টাকার লোভ আর মিথ্যাচার? আজকের দিনে শুধু আদর্শের জন্য মানুষ এমন করে লড়তে পারে? এত লোক পুলিশের লাঠির পরোয়া না করে এগোতে পারে? এমন তেজ, আদর্শের জন্য এমন লড়াইয়ের কথা তো পড়েছি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে, আর শুনেছি বাবার মুখে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বামপন্থী আন্দোলনের গল্পে।
আমার মেয়েটা যাতে নিরাপদে বাড়ি ফেরে, আমার ছেলেটা যাতে চাকরি পায়, তার জন্য ওরা রাস্তায় নেমে মার খাচ্ছে। আর আমি ক’টা টাকা চাঁদা দিয়েই দায়িত্ব সারলাম। এমএলএ-এমপি নেই বলে অনেক সময় অনেকের সাথে গলা মিলিয়ে বিদ্রুপও করেছি এই দলের ছেলেমেয়েদের। বলেছি, এত যে লড়ো, ভোটে তো জিততে পারো না। ওরা বলেছে, ভোটে কিছু হবে না, আন্দোলনেই হবে। আজ মনে হচ্ছে, পারলে এরাই পারবে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছেলেটির হাসিমুখ– মার খাওয়ার জন্য তো আমরা আছি।
স্বপন মণ্ডল
হাতিবাগান, কলকাতা