৬ ডিসেম্বর দিনটি বিশ্বের ইতিহাসে আর একটি কালা দিন হিসাবে চিহ্ণিত হল৷ এ দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন৷
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে চরম ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে একই সাথে তা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষায় ট্রাম্পের নির্লজ্জ ভূমিকারও নগ্ন প্রকাশ৷ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর জেরুজালেম প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত৷ এই শহরে রয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের আল আকসা মসজিদ, ইহুদিদের পবিত্র ধর্মস্থান টেম্পল মাউন্ট৷ আবার খ্রিস্টানদের কাছেও জেরুজালেম যিশুর স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র শহর৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে যুদ্ধবাজ ইজরায়েল দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্টাইনে বার বার হানাদারি চালিয়ে আসছে, জেরুজালেম শহরটিও বার বার তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে৷
প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েলের বিরোধের ইতিহাস দীর্ঘদিনের৷ ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকে বিভিন্ন আরব জাতিগোষ্ঠীর বাসস্থান হিসাবে প্যালেস্টাইনের অস্তিত্ব ছিল৷ বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের ইহুদিদের মধ্যে থেকে প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র তৈরির চিন্তা জন্ম নেয়৷ একের পর এক ধনী ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে পাড়ি জমিয়ে সেখানে জমিজায়গা কিনে নিয়ে চাষবাস চালাতে থাকে৷ প্যালেস্টাইনের গরিব আরব অধিবাসীরা তাদের শ্রমিক হিসাবে কাজ করত৷ এইভাবে প্যালেস্টাইনের বিরাট এলাকা নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেওয়ার পর এই ধনী ইহুদিরা আরবদের ঘরবাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করতে শুরু করে, এমনকী কবরখানাগুলিও এদের হাত থেকে রেহাই পায়নি৷ স্বভাবতই আরব অধিবাসীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে খেপে ওঠে এবং প্রতিরোধ শুরু করে৷ কিন্তু নানা উপজাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকার দরুণ তারা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি৷ অচিরেই এই দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ এলাকার উপর সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টি পড়ে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যালেস্টাইন ব্রিটিশ শাসকদের আওতায় আসে৷ কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ইহুদিবাদীদের বিরোধ বাধে৷ ইহুদিবাদীদের পক্ষ নিয়ে বিষয়টিতে নাক গলাতে শুরু করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৌশলী চালে আরব জনগোষ্ঠীগুলির আপত্তি উপেক্ষা করে রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে৷ এর একটি অংশ প্যালেস্টাইন নামে আরবদের অধিকারে থাকে, অন্য অংশটিতে ১৯৪৮–এর ১৫ মে তৈরি হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল৷ প্যালেস্টাইন–ইজরায়েলে বিরোধের সেই শুরু৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে তৈরি ও তাদের অর্থ ও অস্ত্রসাহায্যে পুষ্ট ইহুদিবাদী ইজরায়েল লাগাতার হানাদারি চালাতে থাকে প্যালেস্টাইনে৷ অশান্ত হয়ে ওঠে পশ্চিম এশিয়া৷ আরবদের দৈনিক দিনযাপনের অঙ্গ হয়ে ওঠে রক্ত, ধ্বংস আর আর্তনাদ৷ লক্ষ লক্ষ আরব উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়৷ আক্রমণ আসে জেরুজালেমের উপরেও৷ ১৯৬৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েল জেরুজালেমের পূর্বাংশ দখল করে নেয় এবং ’৮০ সালে শহরটিকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে৷ যদিও বিশ্বের কোনও দেশই ইজরায়েলের এই অন্যায় দখলদারিকে স্বীকৃতি দেয়নি৷
এদিকে প্যালেস্টাইনের আক্রান্ত আরবদের মধ্যে থেকে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে৷ আন্তর্জাতিক উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়৷ ১৯৯৩ সালে প্রতিরোধী সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও–র সঙ্গে ইজরায়েলের একটি চুক্তি হয় যা অসলো চুক্তি নামে পরিচিত৷ সেখানে আরব–ইহুদি বিরোধ মিটিয়ে প্যালেস্টাইনে স্বশাসিত সরকার গড়ার কথা এবং প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যতে তার রাজধানী হিসাবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়৷ ততদিন পর্যন্ত জেরুজালেমকে ‘আন্তর্জাতিক শহর’ হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়৷ কিন্তু সেই চুক্তি লঙঘন করে, রাষ্ট্রসংঘের নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে তার ছোট স্যাঙাৎ ইজরায়েল জেরুজালেমের বেশির ভাগ অংশ দখল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, লাগাতার রক্তক্ষয়ী হানাদারি চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টাইনের উপর৷ প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়ছে আরব তরুণ–যুবকরাও৷ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়ছে প্যালেস্টাইন৷ রক্তে ভিজছে পশ্চিম এশিয়ার মাটি৷
গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষ ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়েছে৷ ইরান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডনের মতো আরব দেশগুলি তো বটেই, এমনকী দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হানাদারির সঙ্গী ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানরাও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পের পাশে নেই৷ পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার মিত্র দেশ সৌদি আরব পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তারা সমর্থন করে না৷ এই ঘোষণার নিন্দা করেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সহ অন্যান্য দেশ৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে৷ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেইরেস বলেছেন, ‘আমি এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আমার নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে যাব’৷ খোদ ইজরায়েলের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরোধিতা করেছেন৷ বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হয়েছেন তাঁরা৷
গোটা বিশ্ব বিরুদ্ধে যাবে জেনেও ট্রাম্প এমন ভয়ানক ঘোষণা করলেন কেন? আসলে ঘরে–বাইরে তাঁর অবস্থান এখন যথেষ্ট সমস্যাসঙ্কুল৷ পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার নাজেহাল অবস্থা৷ নিছক সাম্রাজ্যবাদী লালসা চরিতার্থ করতে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাক, লিবিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধানোর কারণে গোটা বিশ্বের মানুষ অভিযোগের আঙুল তুলেছে আমেরিকার দিকে৷ সম্প্রতি সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে মৌলবাদী সন্ত্রাসী আইসিস গোষ্ঠীকে সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে আসতে হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে৷ সেই অঞ্চলে প্রভাব বাড়িয়ে ফেলেছে রাশিয়া ও ইরান৷ এই অবস্থায় পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা বেছে নিয়েছে তার নিজের সৃষ্টি এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান ইজরায়েলকে৷ জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে এই অঞ্চলে সংঘর্ষের উত্তাপ বাড়িয়ে তুলতে পারলে তার লাভ দু’দিক দিয়ে৷ প্রথমত, বাজার সঙ্কটে জেরবার অর্থনীতির শেষ আশ্রয় সামরিকীকরণের গতি বাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা হু হু করে বাড়ানো যাবে৷ তার দ্বিতীয় লক্ষ্য, সাম্রাজ্যবাদী স্যাঙাৎ ইজরায়েলকে সামনে রেখে পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে যেতে পারবে আমেরিকা৷
ট্রাম্পের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন ঘোষণার পিছনে দেশের ভিতরে তাঁর নড়বড়ে অবস্থানটিও কাজ করেছে৷ ক্ষমতায় আসার পর গত প্রায় এক বছরে দেশের মানুষের মূল সমস্যাগুলির কোনও সমাধান করতে না পারলেও বার বার বিতর্কিত পদক্ষেপ ও মন্তব্য করে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন তিনি৷ জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তাঁর নতুন আইন প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ শুধু বিরোধীরা নন, তাঁর নিজের দলেরও অনেকে ট্রাম্পের বিরোধিতায় সরব৷ এই অবস্থায় এরকম একটি ঘোষণার দ্বারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের মানুষের কাছে নিজের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷
এ প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান চরম নিন্দনীয়৷ পৃথিবীর সমস্ত দেশ যখন ট্রাম্পের এই অন্যায় ঘোষণার বিরুদ্ধে সরব, তখন ভারত সরকার স্পষ্ট ভাষায় এর নিন্দা না করে ভাসাভাসা ভাবে যে সব কথা বলেছে, তা কার্যত ট্রাম্পের পক্ষেই যায়৷ ভারত সরকারের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সঙ্গে ভারত আজ গভীর মিত্রতায় আবদ্ধ৷ তাই আমেরিকার নিন্দা করতে ভারত সরকারের মুখে বাধে৷ ভারতবাসীর পক্ষে এ চরম লজ্জার ঘটনা৷ অথচ ইতিহাস বলে, ভারতের সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মন থেকে প্যালেস্টাইনের পক্ষেই সব সময় দাঁড়িয়েছে৷ স্বাধীন রাষ্ট্র হলে প্যালেস্টাইনের রাজধানী হবে পূর্ব–জেরুজালেম– এই সিদ্ধান্তকেও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে ভারতের মানুষও বরাবর সমর্থন করে এসেছে৷ সেই ইতিহাস অগ্রাহ্য করে ১৯৯২ সাল থেকে দু’দশকের বেশি সময় ধরে দেশের কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে অস্ত্র ব্যবসায় জোয়ার আনতে সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত৷ এ ব্যাপারে দেশের কর্পোরেট পুঁজির বিশ্বস্ত তল্পিবাহক কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি খুবই আগ্রহী৷ দেশের প্রথম যে প্রধানমন্ত্রী ইজরায়েল সফরে যান, তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদি৷ সেখানে ভারত ও ইজরায়েলের সম্পর্ককে ‘ম্যারেজ মেড ইন হেভেন’ বলে ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন তিনি৷ আসলে দেশীয় বৃহৎ পুঁজির স্বার্থরক্ষায় আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমেরিকা–ইজরায়েলের হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে ভারত৷ অস্ত্র কারবারেও বড় জায়গা নেওয়ার জন্য ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির মালিকরা এখন আমেরিকা–ইজরায়েলের দোসর৷ তাই ভারত সরকার দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই অন্যায় ঘোষণার বিরুদ্ধে নীরব থাকল৷
কিন্তু নীরব থাকলে চলবে না ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতন্ত্রপ্রিয় শান্তিকামী মানুষদের৷ সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের প্রতি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বড়কর্তা আমেরিকার অন্যায় সমর্থন ও প্যালেস্টাইনের আরবদের উপর ঘটে চলা বর্বরতার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী কণ্ঠ তুলতে হবে সোচ্চারে৷ প্রশ্ন তুলতে হবে, বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করার অধিকার কে দিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে৷ দাবি তুলতে হবে, অবিলম্বে প্যালেস্টাইনিদের উপর বর্বর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে৷ এই প্রশ্নে গোটা বিশ্ব জুড়ে জঙ্গি শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী দানবদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার দ্বিতীয় কোনও পথ নেই৷