Breaking News

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষার শক্তি অমোঘ যতদিন তা বহন করব, আমাদের অগ্রগতি চলতেই থাকবে–প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে কমরেড প্রভাস ঘোষ

 

মাঝ-দুপুরের তীব্র রোদ আছড়ে পড়েছে শহিদ মিনারের বিশাল ময়দানে। অসহ্য জীবনযন্ত্রণার মতো, উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে যেন ঝলসে দিচ্ছে বৈশাখী সূর্যের আগুন। কিন্তু ২৪ এপ্রিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে সমবেত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের বুকে হার না মানার দৃঢ় পণ। তাই সংগ্রামের প্রতীক, হাওয়ায় উড়তে থাকা রক্তপতাকার আদলে তৈরি মঞ্চে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতির দিকে, উপস্থিত নেতৃবৃন্দের দিকে পূর্ণ মনোযোগে তাকিয়ে রয়েছেন যাঁরা–তাঁদের চোখেমুখে গভীর আগ্রহ। খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামের সত্যিকারের সাথী, দেশের একমাত্র প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে তাঁরা চিনে নিতে চান লড়াইয়ের পথের দিশা। বুঝে নিতে চান আশু কর্তব্য। সংগ্রামের সেই আহ্বানই ধ্বনিত হল ২৪ এপ্রিলের মঞ্চ থেকে। দলের ৭৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ উপস্থিত কর্মী-সমর্থক-সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানালেন মার্ক্সবাদের বিজ্ঞানসম্মত সত্যের পথে সচেতন সংগ্রামে সামিল হয়ে শোষণমুক্তির লড়াইয়ে প্রাণ-মন এক করে ঝাঁপিয়ে পড়ার। বললেন, পথ দুটো– একটা হল বেকারি, গরিবি, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি মুখ বুজে সহ্য করে অসম্মানের জীবন কোনও-রকমে কাটিয়ে চলা। অন্যটি হল, যে অন্যায় ব্যবস্থা জন্ম দিচ্ছে এই অসহনীয় পরিস্থিতির, সত্যের অমোঘ শক্তিকে হাতিয়ার করে তার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের মর্যাদাময় জীবন বেছে নেওয়া।

সুন্দরবনের জঙ্গলঘেঁষা গ্রাম থেকে এসেছিলেন প্রতিমা বারিক, গোপাল নাইয়ারা। দক্ষিণ ২৪ পরগণার গুড়গুড়িয়া ভাসা থেকে এসেছেন বাঘের সঙ্গে লড়ে বেঁচে ফেরা অরেজ মোল্লার মতো মানুষজন। নদীতে মিন, কাঁকড়া ধরে কারও জীবন কাটে। কেউ ছোট্ট জমিতে চাষ করেন, জন খাটেন। বাঘ-কুমীর-বিষাক্ত সাপের সঙ্গে নিত্যদিনের লড়াইয়ের কথা বলছিলেন তাঁরা। বলছিলেন সরকারি নানা একুশে আইনে, প্রশাসনের নির্মম উদাসীনতায় কী কঠিন তাঁদের বেঁচে থাকার দৈনন্দিন সংগ্রাম। ময়দানে এসেছেন কেন? প্রশ্ন করতেই জোর গলায় উত্তর এল– আসবো না! এই দলটাই তো আমাদের প্রতিদিনের লড়াইয়ের একমাত্র সাথী। এই দলটাই তো শিখিয়েছে, লড়াই ছাড়া বাঁচার অন্য রাস্তা নেই। শিশুকন্যাকে আঁচলের আড়াল দিয়ে প্রখর রোদের মধ্যে বসেছিলেন চন্দনা মান্না। এসেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে। –এই গরমে এত কষ্ট করে ময়দানে এলেন? রোদের তাপে লাল হয়ে উঠেছে মুখ। খর চোখে বললেন, মেয়েদের ওপর অত্যাচার যেভাবে বাড়ছে, যেভাবে ধর্ষণ-খুনের বন্যা বইছে, এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে চলবে কেন? এই দলটাই তো সমাজবদলের লড়াই গড়ে তুলছে। সেই লড়াইয়ে যোগ না দিলে আমার মেয়েটাকেও কি বাঁচাতে পারব! বাঁকুড়ার মৌমিতা মণ্ডল, শকুন্তলা মাঝি, লিপিকা মণ্ডলরা লড়ছেন পড়াশোনার অধিকার আদায়ের লড়াই। বললেন, বাবা চাষের কাজ করেন। ফসলের দাম মেলে না। এই অবস্থায় বাড়তি ফি দেবো কী করে? আমাদের পড়াশোনাই তো বন্ধ হয়ে যাবে। এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া শিক্ষার দাবিতে লাগাতার লড়াই আর কোনও দল করে নাকি? এই দলের সাথে না থেকে পারি?

এইরকম হাজার হাজার খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের ঢেউ এ দিন কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল শহিদ মিনার ময়দানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। এসেছিলেন মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ছোট ব্যবসায়ী, ছাত্রছাত্রী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। কেউ বেরিয়েছেন ভোরবেলায়, কেউ বা আগের দিন দুপুরে বা রাতে ট্রেনে উঠেছেন। কেউ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন নৌকায়। তারপর ট্রেন, বাস ধরে কলকাতা। স্নান হয়নি, খাওয়া হয়নি, রোদের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তবু মুখ তাঁদের আনন্দের আলোয় উজ্জ্বল। চোখ ভরে রয়েছে স্বপ্নে। এ স্বপ্ন দিন বদলের। এ আনন্দ সমাজবিকাশের লড়াইয়ে সামিল হতে পারার। তাঁদের প্রাণের কথাই যেন সঞ্চারিত হচ্ছিল মঞ্চ থেকে ভেসে আসা ‘২৪শে এপ্রিল’ গানের সুরে– ‘দুনিয়ার সবহারা বিপ্লবের সাধিতে দায়িত্ব এদেশে/জন্ম নিল এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট, সুমহান এপ্রিল চব্বিশে’।

সমাবেশের মঞ্চে নেতৃবৃন্দ

ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় চারটে। শুরু হল সভার কাজ। দলের পলিটবুরো সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের নাম সভাপতি হিসাবে প্রস্তাব করলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড স্বপন ঘোষাল। কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক সদস্য কমরেড অশোক সামন্ত তা সমর্থন করলেন। মঞ্চে এলেন প্রধান বক্তা দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। আসন গ্রহণ করলেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেড সৌমেন বসু ও কমরেড গোপাল কুণ্ডু সহ কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা।

এরপর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্যদের, বিভিন্ন গণআন্দোলনের শহিদদের ও কোভিড অতিমারির সময়ে সরকারি অপদার্থতায় নিহত পরিযায়ী শ্রমিকদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ ও এক মিনিট নীরবতা পালিত হল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন ও সেগুলির সমর্থনে বক্তব্য পেশের পর সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হল।

কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনী কমসোমল প্যারেডের মধ্য দিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতি গার্ড অফ অনার প্রদর্শন করার পর শুরু হল প্রধান বক্তা কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে তিনি বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নৃশংস বাহিনির বিরুদ্ধে মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে অসমসাহসী সংগ্রাম গড়ে তুলে বিশ্ববাসীকে সভ্যতার ঘৃণ্যতম শত্রু ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া। সমাজতন্ত্র হারিয়ে সেই রাশিয়া আজ সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত। ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্দর দখল করতে একদিকে রাশিয়া, অন্য দিকে আমেরিকা নেতৃত্বাধীন যুদ্ধজোট ন্যাটো রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত। হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, ঘরছাড়া হচ্ছেন। আসলে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই আজ নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে বেকারি, দারিদ্রে জর্জরিত। এই অবস্থা থেকে বিক্ষুব্ধ জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে একদিকে তারা উগ্র জাতিবাদী আবেগ তৈরি করছে, অন্য দিকে অর্থনীতির সামরিকীকরণের পথ ধরে অস্ত্রশিল্প চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণি সস্তা তেল ও অস্ত্র আমদানির স্বার্থে এবং ভারত-চিন বিরোধে রাশিয়া যাতে চিনের পক্ষে পুরোপুরি চলে না যায়, সেই উদ্দেশ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উস্কানির বিরুদ্ধেও কোনও কথা বলছে না। এর আগে ইরাক সহ নানা দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হানাদারির বিরুদ্ধেও তারা চুপ থেকেছে।

২৪ এপ্রিল সমাবেশে গণসঙ্গীত পরিবেশন করছে দলের সঙ্গীতগোষ্ঠী

কমরেড প্রভাস ঘোষ দেখান, পুঁজিবাদ শুরুতে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতার স্লোগান তুললেও আজ প্রতি পদে তা ধ্বংস করছে। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক, এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের ১৯৪৯ সালের শিক্ষা তুলে ধরে তিনি বলেন, আজ পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই কার্যত ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। চিন্তাজগতে ধর্মীয় উন্মাদনা, ঐতিহ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা চালানো হচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি ধ্বংস করে শুধু প্রযুক্তির উন্নতিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হচ্ছে। আজকের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্লোগান প্রহসনে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে সমস্ত সম্পদ। বাকি ৯৯ শতাংশ আজ পথের ভিখারি। মুনাফা লালসায় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আজ পরিবেশ বিপন্ন করছে। গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এই অবস্থায় পৃথিবীর সব দেশেই নির্বাচন আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতালোভী সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি গরিবি, বেকারিতে বিপর্যস্ত মানুষকে ভিক্ষা দেয়। টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনে। সশস্ত্র ক্রিমিনাল বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে ভোট করায়। এ সবের জন্য টাকা জোগায় ধনকুবের মালিকরা। তারাই তাদের পছন্দমতো দল বা ব্যক্তির পক্ষে প্রচারের হাওয়া তোলে। সেই হাওয়ায় ভেসে যায় অসচেতন সাধারণ মানুষ। এক দলের বদলে অন্য দলকে সরকারি ক্ষমতায় বসায়। যে দলই সরকারে বসুক, প্রত্যেকবারই ভোটে জেতে শাসক শ্রেণি, পরাজিত হয় খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। কারণ ক্ষমতায় বসে মালিক শ্রেণির স্বার্থে মেহনতি মানুষের ওপর আরও কঠিন আক্রমণ চালায় সরকার।

ফলে শোষণমুক্তির জন্য নির্বাচন নয়, চাই বিপ্লব। চাই সঠিক বিপ্লবী নেতৃত্ব ও উন্নত রাজনৈতিক চেতনা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ দেশের বুকে একটি প্রকৃত মার্ক্সবাদী দল গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে হাতে-গোনা কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টি গড়ে তোলেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। সেই সময় দেশে বৃহৎ বামপন্থী দলের অভাব ছিল না। প্রতিনিয়ত তাদের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে কমরেড শিবদাস ঘোষকে। সে সব উপেক্ষা করে, চরম আর্থিক অনটন ও অসংখ্য বাধার বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এই দলটিকে গড়ে তুলেছেন কমরেড ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা। আজ রাজ্যের অসংখ্য গ্রাম-শহরে, দেশের ২৩টি রাজ্যে এই এস ইউ সি আই (সি)-ই মেহনতি মানুষের সংগ্রামের একমাত্র ভরসা।

এ দেশের ক্ষমতালোভী সংসদীয় দলগুলি যেভাবে নির্লজ্জের মতো পুঁজিবাদের তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করছে, কমরেড প্রভাস ঘোষ অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে তা ব্যাখ্যা করেন। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির পিছনে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পুঁজিবাদের সেবক সরকারি দলগুলি দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। মদ ও অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে, নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে মানবদেহধারী এক ধরনের অমানবিক, বিবেকবর্জিত পশুর মতো প্রাণীর জন্ম দিচ্ছে এরা, যারা বিনা দ্বিধায় নারী ধর্ষণ করে, ধর্ষণ করে খুন করে, ভোটের সময় সন্ত্রাস চালায়, বুথ জ্যাম করে, রিগিং করে ভোটে জেতায় দুর্নীতিগ্রস্ত দলগুলিকে।

সমাজের এই ভয়ঙ্কর পরিণামের পিছনে কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূলের মতো দক্ষিণপন্থী দলগুলির পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কমরেড প্রভাস ঘোষ এ দেশের বামপন্থী নামধারী দলগুলির মার্ক্সবাদবিরোধী ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, একসময় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার জয়জয়কার ছিল। অথচ কার্যত কমিউনিস্ট নামধারী সিপিআই ও পরে সিপিএমের একের পর এক অ-মার্ক্সবাদী ভুল পদক্ষেপের জন্যই আজ গোটা দেশে দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির এই রমরমা। নির্বাচনসর্বস্ব এই দলটির ভূমিকার তীব্র নিন্দা করে তিনি বলেন, একবার সরকারি ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর থেকেই যেভাবে ধীরে ধীরে এই দলটি সংগ্রামী বামপন্থার রাস্তা সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করল, তা দেখে ১৯৬৯ সালেই কমরেড শিবদাস ঘোষ সতর্ক করে বলেছিলেন, আরএসএস-হিন্দু মহাসভা ওৎ পেতে বসে আছে। বামপন্থা দুর্বল হলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাস্তবে হয়েছে ঠিক তাই।

কমরেড প্রভাস ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আজ একচেটিয়া পুঁজিপতি শাসক শ্রেণির সমর্থনে বিজেপি-আরএসএস যেভাবে দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুত্বের প্রসার ঘটাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে, গণআন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে তা একটা গুরুতর বিপদ। সম্প্রতি রামনবমীর মিছিলের নামে দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরিতে দাঙ্গা বাধিয়েছে তারা। তিনি আরও দেখান, বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দুত্ব এবং বিবেকানন্দের হিন্দুত্বের মধ্যে কোনও মিল নেই। বলেন, আজ দেশপ্রেমের ঢাক পেটালেও, আমাদের দেশের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শত শহিদের রক্তে রাঙা, তা এই হিন্দুত্ববাদীদের চোখে ছিল প্রতিক্রিয়াশীল।

এই অবস্থায় জনগণকে সচেতন হওয়ার ডাক দিয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, বিষয়গুলি নিয়ে মানুষকে ভাবতে হবে। বুঝতে হবে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদল নয়, চাই শ্রমিক শোষণকারী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ৭০০ প্রাণের বিনিময়ে এই আন্দোলন দাবি আদায় করেছে। এদেশে বৃহৎ বামপন্থী দলগুলি সংগ্রামী বামপন্থার রাস্তায় চললে এই অসাধারণ আন্দোলনটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরাট সুযোগ ছিল। সুযোগ ছিল শ্রমিক শ্রেণির দাবিতে ডাকা সাম্প্রতিক দু’দিনের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বিপ্লবী আন্দোলনের আগুন জ্বালানোর। কিন্তু পথে নেমে মানুষকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করতে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া কাউকেই দেখতে পাওয়া যায়নি।

কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, শুরু থেকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলটি মেহনতি মানুষের প্রতিটি দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই গড়ে তুলছে। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে এদেশের মাটিতে বিশেষীকৃত করে, তার বিকাশ ঘটিয়ে যে তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্ক্সবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ, সেই সত্যের জোরে সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়ছে এ দেশের একমাত্র সংগ্রামী বামপন্থী দল এস ইউ সি আই (সি)। এমএলএ-এমপি-র জোরে নয়, দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের চাপে বহু দাবি অর্জিতও হয়েছে। এর জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বহু নেতা-কর্মীকে। জেলবন্দি থাকতে হয়েছে সারা জীবন। কিন্তু দল পিছু হঠেনি। তিনি বলেন, সত্যের শক্তি অমোঘ। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষার অমোঘ শক্তিতে বলীয়ান আমরা। যতদিন এ শিক্ষা বহন করব, আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। বলেছেন, কৌশল নয়, ধূর্তামি নয়, কোনও দলের বিরুদ্ধে কুৎসা নয়। যুক্তির ভিত্তিতে সংগ্রাম চলবে। দলে দলে তরুণ-তরুণী এই দলে আসছে। অসহায়তা, হতাশার শিকার না হয়ে এই সংগ্রামে প্রতিটি পরিবার থেকে তরুণ-তরুণীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি, যারা ক্ষুদিরাম হতে চাইবে, প্রীতিলতা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।

এদিন শহিদ মিনার ময়দানের সভায় দেখা মিলেছে অগণন তরুণ মুখের। সাগ্রহে ভাষণ শুনেছেন তাঁরা। তাঁদের এই আগ্রহ সমাজের বর্তমান সঙ্কট থেকে মুক্তির প্রবল আকাঙক্ষারই ফল। পথ খোঁজার সেই আকুতিই তাঁদের সম্পূর্ণ আলোচনাটি শুনতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

শুধু দলের কর্মী-সমর্থকরাই নন, এদিন এসেছিলেন অন্যান্য দলের বহু মানুষ, ছিলেন বামপন্থী দলগুলির কর্মী-সমর্থকরাও। অবাক বিস্ময়ে তাঁরা লক্ষ করেছেন শ্রোতাদের অটুট মনোযোগ। শহিদ মিনার চত্বরে বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন দোকান-কর্মচারী, বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টররাও মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য। বলেছেন, অনেকদিন পর লাল পতাকার এত বড় সমাবেশ দেখলাম। শুনলাম ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান। খুব ভাল লাগছে। চায়ের দোকানে বসা এক ব্যক্তি বললেন, এই একটা দলই মানুষের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। একটি বাম দলের এক কর্মী উপস্থিত ছিলেন এই সমাবেশে। ভাষণ শুনে অভিভূত হয়ে তাঁর মন্তব্য–কোনও উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি নেই, জনতার হাততালির লোভে কোনও রকম মনমাতানো কথা নেই, রয়েছে কেবল সংগ্রামী বামপন্থী রাজনীতির পাঠ। মনে হচ্ছে, এতদিন ধরে দল চিনতে শুধু ভুলই করে এসেছি। নদীয়া থেকে আসা একটি বামপন্থী দলের একজন কর্মী বললেন, আজ বুঝলাম, একজনও এমএলএ-এমপি না থাকা সত্ত্বেও কিসের জোরে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) লড়াইয়ের এই প্রেরণা পায়!

এই প্রেরণা আসে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত সত্যের অমোঘ শক্তি থেকে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই সত্যের প্রয়োগ থেকে। ২৪ এপ্রিল প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ শুনে সেই প্রেরণার শক্তি বুকে নিয়ে শহিদ মিনার ময়দান থেকে জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের ময়দানে আবার পাড়ি জমালেন হাজার হাজার মানুষ। আগুন ঝরানো দিনের শেষে সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হাওয়া তখন অভিনন্দন জানাচ্ছে তাঁদের।

(কমরেড প্রভাস ঘোষের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য পরে প্রকাশিত হবে)

তাঁরা বলে গেলেন

  • টালিগঞ্জ এলাকা থেকে রাজ্যের শাসক দলের এক সমর্থক এসেছিলেন সমাবেশ দেখতে। তিনি নিজের মতো ঘুরেছেন, নানা জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন এক পুলিশ কর্মীর সঙ্গেও। দলের যে কর্মীটির সঙ্গে এসেছিলেন, তাকে বললেন, ওই যে পুলিশকর্মী, উনি নিশ্চয়ই আপনাদের সমর্থক। কী করে বুঝলেন? প্রশ্ন করায় তুলে ধরলেন পুলিশ কর্মীর কথা– আমরা তো উর্দি-পরা। অনেক কিছুই বলতে পারি না। আপনারা এই দলটা করছেন। চালিয়ে যান।
  • নদীয়া থেকে এক সিপিএম কর্মী এসেছিলেন তাঁর পরিচিত এক কর্মীর অনুরোধে। তিনি কমরেড প্রভাস ঘোষের আলোচনা, বিষয়বস্তু এবং প্রবল দাবদাহের মধ্যে শ্রোতাদের গভীর আগ্রহ দেখে বললেন, এর থেকেই প্রমাণ হয়, এই দলটাই সঠিক। মার্ক্সবাদের ভিত্তিতে বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ শুনে তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন, আজ বুঝতে পারছি এতদিন ভুল রাস্তায় চলেছি।
  • অন্য দলের একজন বামকর্মী এসেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর সাথে। সভা শেষে বললেন, প্রভাসবাবু যা আলোচনা করলেন, তার মধ্যে কোনও উত্তেজনার খোরাক ছিল না। রাজনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে তিনি যে আলোচনাটা করলেন তা আসলে একটা রাজনৈতিক ক্লাস। এত মানুষ শেষ পর্যন্ত যেভাবে তা শুনলেন, তাতে আমি অবাক। আমি বামফ্রন্টের বহু মিটিংয়ে উপস্থিত থেকেছি, কখনও এ জিনিস দেখিনি।
  • বামফ্রন্টের এক যুব সমর্থক কিছুটা কৌতুহল থেকে মাঠে এসেছিলেন। সমাবেশ দেখার পর বললেন, বামফ্রন্টের বাইরে এত বিশাল শক্তি নিয়ে এসইউসিআই(সি) যে আছে এতদিন সেটা বুঝতেই পারিনি। এসইউসিআই-এর বিরাট সাংগঠনিক শক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার আপনাদের।
  • মিটিং থেকে কিছুটা দূরে ডিউটি করছিলেন একদল পুলিশকর্মী। মিটিং শুরুর ঘণ্টা তিনেক পরে তাঁদের মধ্যে এক অফিসার দলের এক কর্মীকে ডেকে বললেন, আপনাদের মিটিং আরও অনেকক্ষণ চলবে? এখনও দেখছি কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে না। কর্মীটি তাঁকে জানালেন, এবার শেষ হয়ে এসেছে। আসলে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলেই তাঁরা এমন শৃঙ্খলা দেখতে অভ্যস্ত নন। সেখানে দেখেন এক দিকে যখন মিছিল ঢুকছে, অন্য দিকে মিছিল বেরিয়ে যাচ্ছে। বক্তা যখন বক্তব্য রাখছেন, শ্রোতারা গল্প করছে। এস ইউ সি আই (সি)-র সভা তাই তাঁদের বিস্মিত করেছে।
  • বজবজের এক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র বললেন, বাবার কাছে এসইউসি-র নাম শুনেছি। মাঝে মাঝে কাগজে লড়াইয়ের ছবিও দেখেছি। কিন্তু কোনওদিন কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিইনি। এই প্রথম এলাম। প্রবল দাবদাহের মধ্যে এত মানুষ আসবেন, আমি ভাবতেই পারিনি। দলটা এত বড় হয়েছে জানতামই না। দেখে ভাল লাগছে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৯ এপ্রিল ২০২২