মার্কসবাদ বলতে লেনিন বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি বুঝেছিলেন
নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকীতে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে
মার্কসবাদী–লেনিনবাদ বিজ্ঞান কথাটার মানে হচ্ছে, সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ এটা আয়ত্ত করার ব্যাপারটা শুধুমাত্র একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে না, বরং একজন মানুষের বুদ্ধি কীভাবে প্যাটার্নড হবে, অর্থাৎ কোন ধাঁচায় গড়ে উঠবে, সেটা নির্ভর করে সেই বিশেষ মানুষটির চিন্তাপ্রক্রিয়ার উপর৷ যেমন, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্তই ধরুন৷ যাঁরা ট্রটস্কি, বুখারিন বা তাঁদের শিবিরের অন্যান্যদের মতাবলম্বী ছিলেন, অথবা, পরবর্তীকালে যাঁরা ক্রুশ্চেভের কট্টর সমর্থক ছিলেন, তাঁরা অতি সহজেই বিশ্বাস করেছেন ও জোর গলায় বলেছেন যে, স্ট্যালিন সোভিয়েট ইউনিয়নের অপরিমেয় ক্ষতি করে গেছেন৷ এমন কথাও তাঁরা বলেছেন যে, স্ট্যালিনের মতো ‘ধুরন্ধর শয়তান’ আর হয় না৷ অন্য দিকে, যাঁরা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুগামী ছিলেন, লেনিন–স্ট্যালিন–মাও সে–তুঙের নেতৃত্বে যাঁদের দ্বিধাহীন আস্থা ও আনুগত্য ছিল, তাঁদের ট্রটস্কির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে, অথবা ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে আধুনিক শোধনবাদীরা সমাজতন্ত্রের যে অপরিমেয় ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে বিশ্বাস ছিল সমস্ত তর্কের ঊর্ধ্বে৷ অথচ দেখুন, এই দুই শিবিরের লোকেরাই দাবি করেন যে, তাঁরা মার্কসবাদ–লেনিনবাদ এবং সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করেন৷ তা হলে, আপনারা দেখছেন, উভয়পক্ষই নিজেদের সাম্যবাদী বলছেন, সাধারণভাবে উভয়েই সাম্যবাদী আন্দোলনের পরিমণ্ডলের মধ্যে আছেন, তবুও এত গুরুত্বপূর্ণ বা একটা মূল বিষয়ের উপর উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত একেবারে বিপরীত৷ এরকম কেন হচ্ছে?
আমাদের দেশেও দেখবেন, সিপিআই, সিপিআই(এম) বা অন্যান্য দলের এমন বহু নেতা কর্মী আছেন, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর রাজনীতি যুক্ত বামপন্থী আন্দোলনে ভাঙন ঘটাচ্ছে এবং কংগ্রেসের সুবিধা করে দিচ্ছে৷ আবার, উল্টোদিকে আমাদের দলে একেবারে সাধারণ স্তরে এমন বহু কর্মী আছেন, যাঁদের অন্য কোনও দলের নেতা কোনও মতেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের সত্যিকারের বিপ্লবী চরিত্র সম্পর্কিত ধারণাকে গুলিয়ে দিতে পারবেন না৷
তা হলেই দেখা যাচ্ছে, চিন্তাপ্রক্রিয়া এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতার সীমাটা এই জায়গায়৷ ব্যক্তির জিনিয়াস বা ট্যালেন্ট (প্রতিভা) যাই বলুন, কোনও কিছুই সীমাহীনভাবে স্বাধীন নয়, যেমন খুশি তিনি চলেনও না, চলতে পারেনও না৷ প্রত্যেকেই ভাবেন যে, তিনি খুব স্বাধীনভাবে মুক্তমনে চিন্তা করছেন৷ এ কথা ঠিক যে, মানুষের মনের একটা স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সীমাহীন নয়, তা আপেক্ষিক৷ মনের স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে৷ সেই সীমাটা দুটো জায়গায়৷ একটা হচ্ছে বাস্তব পরিবেশ, আর একটা হচ্ছে চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির ভিতরে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার অজান্তে বা জানিতভাবে তার চিন্তাপদ্ধতি গড়ে উঠেছে, সেই প্রক্রিয়াটির দ্বারা তার মনের বা চিন্তার স্বাধীনতা সীমায়িত৷ তাই আমরা একেক জন একেক রকমভাবে মার্কসবাদ বুঝছি, লেনিনবাদ বুঝছি এবং তা ব্যক্ত করছি৷ সমাজে অনেক ব্যক্তি যাঁরা মার্কসবাদকে সঠিক বলে মনে করেন, তাঁরাও মার্কসবাদকে বলছেন তাঁদের মতন করে৷ অনেকেই মনে করেন, মার্কসবাদের সমস্ত বই তিনি পড়েছেন, তিনি সব জানেন৷ মার্কসবাদ জানার তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি৷ সুতরাং, তাঁর বোঝায়ও কোনও গণ্ডগোল হয়নি৷ এভাবে যাঁরা ভাবেন, দেখা যাবে, মার্কসবাদ নিয়ে তাঁদের মধ্যে পরস্পর আলোচনায় হয়তো কোনও পয়েন্টে কোথাও দু–লাইনের ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে ঐক্য হচ্ছে, কিন্তু, তারপর তিন লাইনে গিয়ে বলে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য হবে না৷ অথচ সবাই মনে করছেন, তাঁরা সব জানেন৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে, কারওর মনে করাটা এখানে আসল নয়, তা দিয়ে সমস্যার মূল জায়গাটা ধরা যাবে না৷ এখানেই প্রশ্ন আসে, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধির৷
এখন, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার মানে কী? এই ‘প্রকৃত’ বলতে আমরা কী বুঝি? যুক্তিসম্মত আলোচনায় পাওয়া যাবে যে, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার যথার্থ মানে হচ্ছে, সঠিক বিজ্ঞানসম্মত বিচারপদ্ধতি, অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মত দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতি৷ এই সঠিক বিচারপদ্ধতি বাদ দিয়ে কোনও একটা বিষয়ে আলোচনায় যদি মনে হয়, এটাই ‘প্রকৃত’ এবং তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যও হয়, তবে তাতে লাভ হয় না৷ আজ যেটা মনে হল প্রকৃত, কালই আবার একটা ঘটনায় দেখা যাবে, সমস্তটাই গোলমাল হয়ে গেল৷ এতে যেটা হয়, তা হচ্ছে সাময়িক ঐক্য৷ এর নামই হল সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছানো৷ কিন্তু এ ঘটনা তো দুটো সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ চিন্তাপদ্ধতির লোকের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে৷ তারাও তো অনেক সময় অনেক ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে উপর উপর সাধারণ ঐক্যে আসে৷ একেবারে দুই বিপরীত মেরুর দর্শনের ব্যক্তিরাও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর একটা মোটামুটি বিচারধারায় ঐক্যবদ্ধ হয়, একত্রে কাজ করে৷ না হলে, বিভিন্ন দল ও শক্তির যুক্তফ্রন্ট হয় কী করে? এইভাবে কোনও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর ঐক্য করাটাই তো যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির মূল কথা৷ কিন্তু, এই মাপকাঠিতে তো একটা পার্টি প্রকৃতই মার্কসবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার বিচার হয় না৷ একটা পার্টি প্রকৃতই মার্কসবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার মার্কসবাদ–লেনিনবাদের উপলব্ধিটা সঠিক কি না, তা যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি, তা হলে সেই পার্টির বিচারপদ্ধতি কী, চিন্তাপ্রক্রিয়া কীরকম, অর্থাৎ সেটা সঠিক মার্কসবাদ–লেনিনবাদসম্মত বিচারপদ্ধতি এবং চিন্তাপ্রক্রিয়া কি না, সেইটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি৷ অথচ এই ব্যাপারটা আমাদের দেশে মার্কসবাদী–লেনিনবাদী আন্দোলনে পরিষ্কার হয়নি৷ আমাদের দেশে প্রথমে সিপিআই, তারপর তা ভেঙে সিপিআই(এম), সেটাও ভেঙে পরে সিপিআই(এমএল) হল৷ অবশ্য, সিপিআই(এমএল) দ্রুত ভেঙে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ সিপিআই এবং সিপিআই(এম) এই যে একই পার্টি ভেঙে দুটো পার্টি আমাদের দেশে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের নাম নিয়ে দাঁড়াল, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি ও গৌরবকে ভিত্তি করে বড় পার্টি হয়ে গেল, তাদের মার্কসবাদ–লেনিনবাদ সম্পর্কে উপলব্ধি কী? এই আসল জায়গাটাই কেউ বিচার করে পরিষ্কার করে নিতে চায় না৷ তাদের রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তগুলো বিচার করতে গিয়েও আমরা প্রতিপদেই দেখছি যে, ছোটখাটো দু’চারটে বিষয় ছাড়া মূল বক্তব্য, রাজনৈতিক বক্তব্য তাদের আগাগোড়াই ভুল৷ ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিপ্লবের স্তর, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নেতৃত্ব সম্পর্কে ধারণা ইত্যাদি যে কোনও মূল বিষয়ে বিচার করলেই দেখা যাবে, এ সম্পর্কে সিপিআই, সিপিআই(এম)–এর বক্তব্য, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব সবই ভুল৷
কিন্তু আমি এর চেয়েও আর একটা মূল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই৷ কারণ, মার্কসবাদী–লেনিনবাদী সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে কেবল বিপ্লবের স্তর নির্ধারণটা সাধারণভাবে সঠিক হওয়াই বোঝায় না৷ যদিও বিপ্লবের স্তরটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে যে দলকে জনগণের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে হয়, জনগণকে সংগঠিত করতে হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে টেনে আনতে হয়, তার কাছে রাষ্ট্রের চরিত্র কী, বিপ্লবের স্তর কী, কোন শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কোন কোন শ্রেণি মিলে উচ্ছেদ করবে– এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জরুরি, এগুলো অন্যতম মূল বিষয়৷ এগুলো ছাড়া একটা রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড়াতেই পারে না৷ এগুলো হল একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে বিপ্লবী তত্ত্বের বিশেষীকৃত রূপ৷ কিন্তু আমি বলতে চাইছি, এই জায়গায় যদি দুটো রাজনৈতিক দলের মিল হয়ে যায়, তাহলেই কি বলা যাবে, তত্ত্বের মিল হয়ে গেল? অনেকে বলবেন, মিল হল৷ আমি মনে করি, না৷ শুধু এই দিয়ে মিল হয় না৷ যেমন, আমরা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) বলি, ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী দেশ এবং এখানে বিপ্লবটা হবে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ এই কথাটা আমাদের দেশে আরএসপি বলে, ওয়ার্কার্স পার্টি বলে, আরসিপিআই–ও বলে থাকে৷ এমন ব্যক্তিও দেশে পাওয়া যাবে, তত্ত্ব বোঝেন বলে যাঁদের অহমিকা আছে, তাঁদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরাও বলে দেবেন, ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, এখানে ক্ষমতায় আছে বুর্জোয়া শ্রেণি, তাদের উচ্ছেদ করবে শ্রমিক–চাষি–নিম্নমধ্যবিত্ত, নেতৃত্ব দেবে সর্বহারা, বিপ্লবটা এখানে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ ব্যস, তা হলেই কি এসব দল ও ব্যক্তির সাথে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর মূল বক্তব্য মিলে গেল, তত্ত্ব মিলে গেল, এ কথা বলা যায়? না, বলা যায় না৷ এই মিল আছে কি না দেখতে গেলে দেখতে হবে, প্রত্যেকের বিচারপদ্ধতি, চিন্তাপ্রক্রিয়া, মার্কসবাদী–লেনিনবদী মূল নীতিগুলোর সর্বব্যাপক ক্ষেত্রে উপলব্ধি, যৌথ চিন্তা বা যৌথ নেতৃত্ব এবং তার বিশেষীকৃত প্রকাশ– এইসব মূলগত বিষয়ে চিন্তাগত ভিত্তি এক কি না, অর্থাৎ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ সম্পর্কে ধ্যানধারণাগুলো মূল যে চিন্তাগত ভিত্তি থেকে জন্ম নিচ্ছে, সেই ভিত্তিটা এক কি না৷
এখন, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের এই যে প্রকৃত উপলব্ধি, অর্থাৎ সঠিক মেথডলজি (বিচারপদ্ধতি), এটা মার্কস–এঙ্গেলস–লেনিনের বই মুখস্থ করে আয়ত্ত করা যায় না৷ রাশিয়াতেও অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি মার্কস–এঙ্গেলসের কোটেশন আউড়ে রাশিয়ার সমাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাশিয়ার বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি৷ তাঁরাও মুখে বলেছিলেন, মার্কসবাদ একটা ডগমা (সূত্রবাদ) নয়, কিন্তু বাস্তব বক্তব্যে ও কার্যকলাপে তাঁরা তাকে সূত্রবাদেই পরিণত করেছিলেন৷ মার্কস তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছিলেন, সর্বহারা বিপ্লব প্রথমে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই হবে৷ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তখনকার উদারনৈতিক পরিবেশ দেখে মার্কস এমন কথাও বলেছিলেন যে, ওইসব দেশে বিপ্লব শান্তিপূর্ণ উপায়ে হবে৷ রাশিয়াতে অনেক মার্কসবাদী পণ্ডিত মার্কসের ওই কথাগুলো আউড়ে বিপ্লব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন৷ এঁদের সঙ্গে লেনিনকে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রামে নামতে হয়েছিল৷ লেনিন বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী যুগের সঙ্গে মার্কসের যুগের পার্থক্য কী, এবং সেই পার্থক্য অনুযায়ী কেন এ যুগে বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর বদলে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল স্থানগুলিতে এসে যাবে এবং সেখানেই বিপ্লব হবে, তা দেখালেন৷ লেনিন তত্ত্বগত ভাবে এ–ও দেখালেন, আজকের যুগে বুর্জোয়ারা যখন গণতন্ত্রের চেয়ে সামরিকবাদ ও আমলাতন্ত্রের দিকেই বেশি ঝুঁকেছে, তখন প্রতিটি দেশে বিপ্লব সশস্ত্র হতে বাধ্য৷ এসব বিষয় ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও রূপ, কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন, তার গণতন্ত্রের ধারণা, সর্বহারা একনায়কত্ব, সর্বহারা বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা চাষির ভূমিকা ইত্যাদি নানা মূল বিষয়ে প্লেখানভ, ট্রটস্কি, কাউটস্কি ও অন্যান্যদের সঙ্গে লেনিনের তীব্র বিতর্ক হয়৷ এই বিতর্ক কেন হল? সকলেরই তো মার্কস–এঙ্গেলস–এর বইগুলো কণ্ঠস্থ ছিল, তা হলে বিতর্ক হল কেন? কারণ, একদল কেবল মার্কস–এঙ্গেলসের বাণীগুলোকে, সিদ্ধান্তগুলোকেই তত্ত্ব বলে ধরে নিয়েছেন৷ আর, লেনিন মার্কসবাদের তত্ত্ব বলতে মার্কস–এঙ্গেলসের কথাগুলো, বা তাঁদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্তগুলো তাঁরা করেছিলেন, শুধু সেগুলোকে মনে করেননি৷ তিনি ধরেছেন– যে বিজ্ঞানটাকে, যে বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে প্রয়োগ করে মার্কস একটা সময়ে সিদ্ধান্তগুলো করেছিলেন, সেই বৈজ্ঞানিক বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতিটাই হল মার্কসবাদ৷ যেমন, মার্কস নিজে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখে সর্বহারা বিপ্লব গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ পথে হবে বলে যে সিদ্ধান্ত করেছিলেন, প্যারি কমিউনের ঘটনার পর সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্কস তাঁর একই বক্তব্যের উপর নিজেই ‘গোথা প্রোগ্রামে’ সংশোধনী এনেছিলেন৷ দু’য়ের মধ্যে সময়েরও খুব পার্থক্য ছিল না৷ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আগ্রাসী রূপটা না দেখে মার্কস একরকম সিদ্ধান্ত করেছিলেন, পরে প্যারি কমিউন তাঁকে শুধরে দিয়েছে৷ আজও যাঁরা মার্কসের কোনও কথা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এই কথাটা মার্কস বলেছিলেন, যা ইতিহাসে ফলেনি, ওই কথাটা ফলেছে, তাঁরা কি মার্কসবাদী? তাঁরা মার্কসবাদ বোঝেনইনি৷ লেনিন ঠিকই ধরেছিলেন যে, এগুলো মার্কসবাদ নয়, এভাবে মার্কসবাদ বোঝা যাবে না, তাকে প্রয়োগ করা যাবে না৷
একইভাবে লেনিন কোথায় কী বলেছেন, তা লেনিনবাদ নয়৷ লেনিন যে বিজ্ঞানটিকে প্রয়োগ করলেন, যে কায়দায় যেভাবে করলেন এবং তা করতে গিয়ে আবার ওই বিজ্ঞানকে, ওই বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে তিনি যতটা উন্নত করলেন এবং তার ভিত্তিতে একটা বিশেষ অবস্থায় যে মূল নীতিগুলো নির্ধারণ করলেন, সেই মূল নীতিগুলো হল মূল বুনিয়াদ, আর সেই বিচারবিশ্লেষণ পদ্ধতিটি হল লেনিনবাদ৷ সেটি আয়ত্ত করতে না পারলে, শুধু লেনিনের কথাগুলো মুখস্থ করে আওড়ালে কিছুই হবে না, শুধু নকলনবিশি করা হবে৷ তাই লেনিনের সময় পার্টি গঠন, আর আজকের সময়ে ভারতবর্ষের জমিতে পার্টি গঠনের পদ্ধতি হুবহু এক হতে পারে না– বিশেষ করে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ আজ যে রূপ নিয়ে দেখা দিচ্ছে, তা লেনিনের সময় এই রূপ নিয়ে ছিল না৷ আজকের সমাজে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটানোটা প্রধান সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়ে নেই৷ পুরোপুরি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে, অর্থাৎ সামন্ততন্ত্রকে ভেঙে বুর্জোয়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিপ্লবের স্তরে, ব্যক্তি স্বাধীনতার আকাঙক্ষাকে ভিত্তি করে ব্যক্তিসত্তাকে উদ্দীপ্ত করাটাই প্রয়োজন হিসাবে থাকে৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া শাসন যেখানে কয়েক যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত, যেখানে বুর্জোয়ারা পিছিয়ে–পড়া বা অগ্রসর যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই হোক এক ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চালু করার চেষ্টা করেছে, সেই সমাজটা যেহেতু আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়ে গেছে, সেহেতু সেটা যদি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে–পড়াও হয়, তবুও সেই পিছিয়ে–পড়া বুর্জোয়া সমাজের সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রসর বুর্জোয়া সমাজের মতন একই লক্ষণগুলো জন্ম নেবে৷ এইসব পিছিয়ে–পড়া বুর্জোয়া সমাজেও ব্যক্তিবাদ আজ অগ্রসর বুর্জোয়া সমাজগুলোর মতো একটা সুবিধায় পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ আজ ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাটা যেমন করে ভাবে, বিচার করে, অধিকারটা দাবি করে, সেই অধিকারটা আজ আর লড়াই করে আদায় করার জায়গায় নেই৷
বুর্জোয়া বিপ্লবের যুগে ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জন করার বিষয়টা ছিল– স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, সামন্তী বাঁধনের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় কুসংস্কার–কুআচারের বিরুদ্ধে, পরদেশ দখলদারীর বিরুদ্ধে লড়ে কিছু অর্জন করার বিষয়৷ সেদিন এই ব্যক্তির অধিকারের লড়াইটা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নীতিনৈতিকতার ধারণার উপর সমাজপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পরিপূরকই ছিল৷ তাই সামাজিক আন্দোলনে ব্যক্তিবাদ সেদিন তেমন কোনও ঝামেলার সৃষ্টি করেনি৷ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, দেশাত্মবোধক আন্দোলনে, বিপ্লবী আন্দোলনে ব্যক্তিসত্তাগুলো সামনে এসে প্রবল ঝঞ্ঝাট তৈরি করেনি৷ কিছু কিছু হয়তো করেছে, তবুও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার প্রশ্নে তা সামগ্রিকভাবে বাধা ছিল না, ব্যক্তি–ব্যক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যেই ঐ ব্যক্তিবাদ মূলত সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু, একটা প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যেখানে শ্রেণীসংগ্রাম তীব্র রূপ পরিগ্রহ করেছে, যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো দেশ– এইসব দেশে ব্যক্তিবাদ যে রূপ নিয়েছে, এমনকী ভারতবর্ষেও তার খানিকটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ আজকে এইসব দেশে একটা বিপ্লবের স্লোগান নয়, সেইমতো কোনও দায়দায়িত্ব তার নেই৷ তা অধিকার অর্জনের হাতিয়ারের বদলে একটা প্রিভিলেজ–এ (সুবিধায়) অধঃপতিত হয়েছে, যাকে বলা হয় নিকৃষ্ট ধরনের ব্যক্তিবাদ৷ সমাজ পরিবেশে এই নোংরা ব্যক্তিবাদের প্রভাব সমাজ অভ্যন্তরে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে কাজ করছে৷ এমন একটা পরিবেশ থেকে একটা দেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা তার কর্মকাণ্ড বা আন্দোলনও বিচ্ছিন্ন নয়৷
(১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর প্রদত্ত ভাষণ)
‘বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মার্কসবাদী বিজ্ঞান’
নির্বাচিত রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড