মহান মার্কসের বিশ্লেষকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার যত অপচেষ্টাই প্রচারযন্ত্র চালাক, সময়ের পরীক্ষায় তা উত্তীর্ণ হয়েছে।
বিশ্বে যখনই আরও একটি অর্থনৈতিক সংকটের বিপদঘন্টা ধ্বনিতহয়, দেখা যায় কার্ল মার্কসের রচনাগুলির বিক্রি ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। পুঁজিবাদ কীভাবে কাজ করে ও মানব সমাজে তার পরিণাম কী কী হয়– তা উনিশ শতকের এই জার্মান চিন্তাবিদ যেভাবে বুঝেছিলেন, খুব কম জনই সেভাবে বুঝেছিল।
কার্ল মার্কস তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যে আদর্শ ও চিন্তাগুলির জন্য, সর্বগ্রাসী প্রচারযন্ত্র তাকে অস্বীকার করতে ও তাঁর চিন্তার মৃত্যুঘন্টা বাজাতে যত চেষ্টাই চালাক, মার্কসবাদ তাকে প্রতিহত করে জীবন্ত রয়েছে শুধু দুনিয়াকে বোঝার একটি পদ্ধতি হিসাবেই নয়, দুনিয়া পাল্টাবার একটি হাতিয়ার হিসাবেও।
মার্কসের দশটি ভবিষ্যদ্বাণী যা মার্কসের জন্মের দুশো বছর পরেও একুশ শতকীয় অর্থনীতির চলনকে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, তা পড়লেই পাঠকরা বুঝবেন, তিনি আজও কত প্রাসঙ্গিক।
১। পুঁজির ঘনীভবন ও কেন্দ্রীভবন
কার্ল মার্কসের অনন্য প্রতিভায় ভাস্বর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে তিনি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন এবং পুঁজির ঘনীভূত ও কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
ঘনীভবনের প্রথম ধারণাটি উদ্বৃত্ত মূল্যের সঞ্চয়ের কথা বলে। এই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয় শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি থেকে (উদ্বৃত্ত শ্রম), যা মুনাফা হিসাবে আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি। কেন্দ্রীভবনের ধারণাটিতে পুঁজি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। প্রায় সময়ই দেউলিয়া হওয়ার কারণে বা অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বহু ব্যক্তি-পুঁজির কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিণামে পুঁজির এই বৃদ্ধি ঘটে।
সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বাজারের অন্ধ হাতের ক্ষমতায় যারা বিশ্বাসী তাঁদের কাছে মার্কসের এই বিশ্লেষণের তাৎপর্য সর্বনাশা।
মার্কস বলেছিলেন, ধনী-গরিবে ক্রমবর্ধমান ফারাক পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজ ২১ শতকে আমরা সেটাই দেখছি। ‘অক্সফ্যাম’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে গোটা বিশ্বে উৎপাদিত সম্পদের ৮২ শতাংশ গেছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের হাতে। বাকি দরিদ্রতম অংশের ৩৭০ কোটি মানুষের সম্পদ যৎসামান্যও বৃদ্ধি পায়নি।
২। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অস্থিরতা এবং সংকটের চক্র
অর্থনৈতিক সংকট যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনও ভ্রান্তির কারণে নয়, তা এই ব্যবস্থার সহজাত বৈশিষ্ট্য– এ কথা প্রথম যাঁরা বলেছিলেন, মার্কস ছিলেন তাঁদের অন্যতম। যদিও আজও এ সম্পর্কে অন্যরকম ধারণা ফেরি করার চেষ্টা চলে।
যাই হোক, মার্কস অর্থনীতির চলনের যে রূপরেখা এঁকে গিয়েছিলেন, সেই পথ ধরেই যে ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজারে ধসের ঘটনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ২০০৭-‘০৮-এর বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সংকট ঘটেছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। সেই কারণেই সমস্যার সমাধান মেলার আশায় এমনকি ওয়াল স্ট্রিটের রাঘব-বোয়ালদেরও ‘ক্যাপিটাল’-এর পাতা ওল্টাতে হয়েছে!
৩। শ্রেণি সংগ্রাম
১৮৪৮ সালে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘‘এযাবৎ কাল পর্যন্ত সমস্ত বিদ্যমান সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস”। ওঁদের এই উপলব্ধি সম্ভবত মার্কসবাদের সবচেয়়ে বিপ্লবাত্মক উপলব্ধি।
এর ফলে উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা সংকটে পড়ে যান। কারণ, মার্কসের মতে আধিপত্যকারী শ্রেণি নিজের মূল্য ও নিজের শ্রেণির পুনরুৎপাদন করতে করতে যে সব অস্ত্রের সাহায্যে অবশিষ্ট অংশের মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে তার অন্যতম হল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।
দেড়শো বছর পর, এখনও কর্তৃত্বকারী ১ শতাংশের সঙ্গে সামাজিক সংগ্রাম চলছে বাকি ৯৯ শতাংশের।
৪। সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনী
মার্কসের তত্ত্ব অনুযায়ী, সর্বোচ্চ মুনাফা পাওয়ার জন্য পুঁজিপতিকে মজুরি কমিয়ে রাখতে হয়। পুঁজিপতি ততক্ষণই এমন করতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করতে অরাজি শ্রমিকের জায়গায় আরেক জন কাজ করতে রাজি থাকে। কাজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকা এই দ্বিতীয় শ্রমিকই হল ‘সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনী’।
১৯ শতক থেকে সামাজিক সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলির লাগাতার সংগ্রামের ফলে বিশেষ করে অগ্রসর দেশগুলিতে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও বাণিজ্য ক্ষেত্রেও কম মজুরির অনুসন্ধান এখনও চলছে।
বিশ শতক জুড়ে কম মজুরিতে দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্টে্রর বৃহৎ উৎপাদক কোম্পানিগুলি এশিয়াতে পাড়ি দেয়।
এতে দেশের বেকারদের জন্য চাকরির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে বহু সরকারই আপত্তি তুলেছে। উদাহরণ স্বরূপ আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের কথা বলা যায়। তা সত্ত্বেও বৃহৎ কোম্পানিগুলি সস্তা শ্রম ব্যবহার করে শ্রমিকদের শোষণ করে মুনাফার চড়া হার বজায় রেখে চলেছে।
মজুরির হার কেমন? সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি দেখাচ্ছে, যা কিছু কেনা সম্ভব তার ভিত্তিতে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা পশ্চিমী দেশগুলিতে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্রমাগত কমে চলেছে। এবং কোম্পানির পরিচালকবর্গের সঙ্গে নিচের তলার কর্মচারীদের মজুরির বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে।
‘দ্য ইকনমিস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুসারে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গত দুই দশক ধরে শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে না, কিন্তু বড়কর্তাদের বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে চোখে পড়ার মতো– গড় বেতনের ৪০ গুণ থেকে বেড়ে এইসব কার্যনির্বাহী পরিচালকদের বেতন হয়েছে গড় বেতনের ১১০ গুণ বেশি। আমাদের ভারতবর্ষের ছবিও অন্যরকম কিছু নয়।
৫। ফিনান্স পুঁজির ভূমিকা
পুঁজির পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়ার মধ্যে শোষণ-পদ্ধতি কেমন ভাবে নিহিত রয়েছে, মার্কস তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। ফিনান্স পুঁজি– অর্থনীতিতে বস্তুগত উৎপাদনে যার ভূমিকা নেই, ‘কোম্পানির কাগজ’ (প্রমিসারি নোট) বা ‘বন্ড’-এর মতো সেই কল্পিত বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে সমালোচনা করেছেন মার্কস। বর্তমানে অর্থনীতির এই বিভাগটির যে পরিমাণ স্ফীতি ঘটেছে, কম্পিউটারের সাহায্যে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে যেভাবে আর্থিক লেনদেন ঘটছে, মার্কসের কালে তা ছিল অকল্পনীয়।
ফাটকা কারবার এবং জটিল আর্থিক ক্রিয়াকলাপের রমরমা, যার উদাহরণ হিসাবে ২০০৭-‘০৮-এ বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট ডেকে আনা তথাকথিত ‘সাবপ্রাইম’-এর কথা উল্লেখ করা যায়, তা মার্কসের উদ্বেগের যথার্থতা প্রমাণ করে।
৬। কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি
মার্কসের উনিশ শতক যখন রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপনের বিস্ফোরণ ঘটেনি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিশেষ পছন্দের দিকে লক্ষ্য রেখে বিজ্ঞাপন ছড়ানোর আধুনিক কৌশল দূর অস্ত্– সেই সময়েই মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং মানুষের মধ্যে কৃত্রিম প্রয়োজনবোধ সৃষ্টি করার ক্ষমতা সম্পর্কে সাবধান করে গেছেন।
একশো পঞ্চাশ বছর আগেই মার্কস বলেছিলেন, পণ্য ও প্রয়োজনের প্রসার পুঁজিবাদে হয়ে দাঁড়ায়, মানুষের মধ্যে অমানবিক, অতি আধুনিক, অস্বাভাবিক পণ্যক্ষুধা সৃষ্টির উপায়।
আজকের পৃথিবীতে নতুন সেল ফোন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই পুরনো হয়ে পড়ছে এবং তখন বিজ্ঞাপন মানুষকে বোঝায় আধুনিকতম মডেলটি কেনবার অতি-আবশ্যকতা। গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলি এমন পরিকল্পনা করে তৈরি করা হচ্ছে যাতে সেগুলি কয়েক বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে এবং সে সব বাতিল করে নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনার প্রয়োজন দেখা দেয়।
৭। বিশ্বায়ন
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘‘উৎপাদিত পণ্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও ক্রমবর্ধমান বাজারের প্রয়োজন বুর্জোয়া শ্রেণিকে গোটা বিশ্ব জুড়ে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। সব জায়গায় তারা বাসা বাঁধে, উপনিবেশ স্থাপন করে, সর্বত্র যোগাযোগ তৈরি করে”।
ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতিক যে ছবি সেদিন তাঁরা এঁকেছিলেন, আজকের বিশ্বায়িত বাজারে তাকে পুরোপুরি যথার্থ বলে মনে হয়।
৮। একচেটিয়া পুঁজির প্রাধান্য
একইসঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুজাতিক পুঁজির সৃষ্টি। ক্লাসিকাল উদারনৈতিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব ধরে নিয়েছিল যে, প্রতিযোগিতা থাকলে বহু-মালিকানা থাকবে। এক ধাপ অগ্রসর হয়ে মার্কস দেখিয়েছেন, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পুঁজির নিয়মের ভিত্তিতে বাজারের প্রবণতা হল পুঁজির একচেটিয়াকরণ।
প্রচারমাধ্যম, টেলিফোন ও তেল কোম্পানিগুলির মিলেমিশে গিয়ে বৃহৎ কর্পোরেশন গঠন হল মার্কস বর্ণিত পদ্ধতির সাম্প্রতিক উদাহরণ।
৯। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আত্মধ্বংসী প্রবণতা
‘যা কিছু স্থাণু, পুঁজিবাদ তাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়’– এ হচ্ছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বর্ণিত মার্কস-এঙ্গেলসের অন্যতম উন্নত উপলব্ধি।
পুঁজিবাদের সৃজনশীল ও একই সঙ্গে আত্মধ্বংসী চরিত্র মার্কস ও এঙ্গেলস যথাযথ ভাবে বুঝেছিলেন। যে কোনও মূল্যে উৎপাদনশীলতার পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে এই ব্যবস্থা উৎপাদন ও অস্থায়ী ভোগের এক অমানবিক চক্র চাপিয়ে দেয়।
সংক্ষেপে এই প্রবণতাই বর্তমানে আমাদের গ্রহটিকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
মানুষের জীবনের উপর বিশ্ব জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কুপ্রভাব বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তা সত্তে্বও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো রাষ্ট্রপ্রধানরা এ কথা অস্বীকার করে চলেছেন।
১০। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব ঘটানোর় সম্ভাব্যতা
পুঁজিবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুগভীর বিশ্লেষণই শুধু নয়, বরং সাম্যবাদের ভিত্তিতে এক নতুন ধরনের সমাজ গড়ে তোলার আহ্বানই হল ইতিহাসে মার্কসের সর্বোত্তম অবদান।
নিপীড়ন ও অসাম্য থেকে চিরতরে মুক্তি অর্জন করার ক্ষমতা যে সর্বহারা শ্রেণির আছে, মার্কসের এই বার্তা বিশ শতককে পাল্টে দিয়েছে এবং রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও কিউবা সহ নানা দেশে সংঘটিত বিপ্লবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আজ এই একুশ শতকেও তাঁর আহ্বান– ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও’ একইভাবে কার্যকরী রয়েছে।
(তথ্যসূত্র : কিউবার গ্রানমা ইন্টারন্যাশনাল)