মার্কসবাদের তিনটি উৎস ও অঙ্গ :  ভি আই লেনিন

 

সমস্ত সভ্য দুনিয়ায়, সরকারি ও উদারনৈতিক– উভয় প্রকার বুর্জোয়া বিজ্ঞানের কাছেই মার্কসের শিক্ষা চরম ঘৃণা ও শত্রুতার বিষয়৷ এরা মনে করে, মার্কসবাদ একটা ক্ষতিকারক বিষাক্ত মতবাদ৷ এদের কাছে অন্য কোনও মনোভাব আশাও করা যায় না৷ কারণ, শ্রেণিসংগ্রামকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজে নিরপেক্ষ সমাজবিজ্ঞানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না৷ কোনও না কোনও ভাবে, সমস্ত রকমের সরকারি ও উদারনৈতিক বিজ্ঞান মজুরি দাসত্বের পক্ষেই দাঁড়ায়৷ আর মার্কসবাদ এই দাসত্বের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷ পুঁজির মুনাফা কমিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো উচিত কি না– এই প্রশ্নে মালিকের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা যেমন আশা করা যায় না, তেমনি মজুরি দাসত্বের সমাজেও নিরপেক্ষ বিজ্ঞানের আশা করা নির্বোধ সারল্য ছাড়া কিছু নয়৷

কিন্তু এটাই সব নয়৷ দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাস একেবারে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে, মার্কসবাদে এমন কিছু নেই, যাকে বলা যাবে ‘সংকীর্ণতাবাদ’৷ কথাটা এই অর্থে বুঝতে হবে যে, মার্কসবাদ কোনও গোঁড়া, নিষ্প্রাণ ও নিশ্চল মতবাদ নয়, এ এমন কোনও মতবাদ নয়– বিশ্বসভ্যতার বিকাশের রাজপথ থেকে অনেক দূরে যার সৃষ্টি হয়েছে৷ বরং মার্কসের প্রতিভা এটাই যে, মানবসমাজের সবচেয়ে অগ্রণী চিন্তাবিদরা যে সব প্রশ্ন আগেই তুলে গিয়েছিলেন, মার্কস সে সবের যথাযথ উত্তর দিয়েছেন৷ দর্শন, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, এবং সমাজতন্ত্রের মহান চিন্তানায়কদের শিক্ষার প্রত্যক্ষ ও অব্যবহিত ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই মার্কসের মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে৷

মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ তা সত্য৷ সর্বব্যাপক ও সুসমঞ্জস এই দর্শন মানুষকে দেয় একটি অখণ্ড বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যা কোনও ধরনের কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়া বা বুর্জোয়া নিপীড়নের সাথে কোনও রকম আপস করে না৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যা মূর্ত হয়েছে জার্মান দর্শন, ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র ও ফরাসি সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে– মার্কসবাদ তার ন্যায্য উত্তরসূরী৷ মার্কসবাদের এই তিনটি উৎস, যেগুলি তার গঠনকারী উপাদানও বটে– সে সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করব৷

(১)

মার্কসবাদের দর্শন হল বস্তুবাদ৷ ইউরোপের আধুনিক ইতিহাসের সমগ্র পর্যায় জুড়ে এবং বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সে, যেখানে– সমস্ত ধরনের মধ্যযুগীয় বস্তাপচা চিন্তার বিরুদ্ধে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যমান ভূমিদাসত্ব ও ধ্যানধারণায় টিকে থাকা তার প্রভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল– সেখানে বস্তুবাদই হল একমাত্র দর্শন যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমস্ত শিক্ষাগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সেগুলির প্রতি অনুগত থেকেছে এবং কুসংস্কার ও ধর্মের নামে ভণ্ডামি ইত্যাদির বিরোধিতা করেছে৷ এই কারণে গণতন্ত্রের শত্রুরা সর্বদা বস্তুবাদকে ‘ভুল প্রতিপন্ন করার’, তাকে লঘু ও হেয় করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়েছে এবং নানা রূপের দার্শনিক ভাববাদ প্রচার করেছে যা বাস্তবে কোনও না কোনও ভাবে সর্বদা ধর্মেরই সাফাই বা সমর্থনে পরিণত হয়েছে৷

মার্কস–এঙ্গেলস অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে দার্শনিক বস্তুবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং বারবার ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, এই ভিত্তি থেকে প্রতিটি বিচ্যুতিই কী গুরুতর ভুল৷ তাঁদের অভিমতগুলি সব থেকে পরিষ্কার ও পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে এঙ্গেলস–এর রচনা ‘লুডউইগ ফুয়েরবাখ’ ও ‘অ্যান্টি ডুরিং’–এ যা কমিউনিস্ট ইস্তাহারের মতোই প্রতিটি শ্রেণিসচেতন শ্রমিকের নিত্যপাঠ্য৷

কিন্তু মার্কস অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদেই থেমে যাননি৷ তিনি দর্শনকে আরও উচ্চস্তরে উন্নীত করেছেন, তাকে জার্মান ধ্রুপদী দর্শন, বিশেষত হেগেলের দর্শনশাস্ত্রের সাফল্যগুলির দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন, যে হেগেলীয় দর্শন আবার উন্নীত হয়েছিল ফুয়েরবাখের বস্তুবাদে৷ এই অর্জিত সাফল্যগুলির মধ্যে প্রধান হল দ্বন্দ্বতত্ত্ব (ডায়ালেকটিক্স), যা বিকাশকে পূর্ণতম, গভীরতম ও সর্বাপেক্ষা সর্বাঙ্গীন রূপে উপলব্ধি করার মতবাদ৷ যে মতবাদ তুলে ধরে, মানুষের জ্ঞান হল আপেক্ষিক, যার মধ্যে বিকাশমান বস্তুজগতের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই৷ বুর্জোয়া দার্শনিকদের পুরনো ও ক্ষয়িষ্ণু ভাববাদী শিক্ষাগুলির ‘নতুন’ ব্যাখ্যা সত্ত্বেও রেডিয়াম, ইলেকট্রন, মৌলিক পদার্থের রূপান্তর সহ প্রকৃতি–বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলি মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সত্যতাকেই দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে৷

মার্কস দার্শনিক বস্তুবাদকে পূর্ণ বিকশিত ও তার উপলব্ধিকে গভীরতর করেছেন, প্রকৃতিজগত সম্পর্কে জ্ঞানকে প্রসারিত করে তার মধ্যে মানবসমাজ সংক্রান্ত জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন৷ মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক মহান কীর্তি৷ ইতিপূর্বে ইতিহাস ও রাজনীতি বিচারের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও খামখেয়ালি চিন্তার যে প্রাবল্য ছিল, তাকে অপসারিত করে একটি সর্বাঙ্গীণ ও সুসমঞ্জস অপূর্ব বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা হল, যা দেখাল কীভাবে উৎপাদিকাশক্তির বিকাশের ফল হিসাবে এক ধরনের সমাজব্যবস্থা থেকে উচ্চতর ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে৷ সামন্তী ব্যবস্থার মধ্য থেকেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটা যার উদাহরণ৷

মানুষের জ্ঞান যেমন প্রতিফলিত করে প্রকৃতিজগতকে (যা আসলে বিকাশমান বস্তুজগৎ), যা মানুষের চেতনা নিরপেক্ষভাবেই অবস্থান করে, ঠিক তেমনই মানুষের সামাজিক জ্ঞান (অর্থাৎ, মানুষের দার্শনিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা মতামত ও তত্ত্ব) প্রতিফলিত করে সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে৷ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে অর্থনৈতিক ভিত্তিরই একটি উপরিকাঠামো৷ যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক রূপ যে ধরনের হোক না কেন, সেগুলি সর্বহারাদের উপর বুর্জোয়াদের আধিপত্য জোরদার করার জন্যই কাজ করছে৷

মার্কসের দর্শন হচ্ছে একটি সুসম্পূর্ণ দার্শনিক বস্তুবাদ যা মানবজাতিকে, বিশেষত শ্রমিক শ্রেণিকে জ্ঞানের শক্তিশালী হাতিয়ার জুগিয়েছে৷

(২)

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল ভিত্তি, যার উপর রাজনৈতিক উপরিকাঠামো তৈরি হয়– এই সত্যোপলব্ধির পর মার্কস অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারের জন্য গভীরতম সাধনায় ব্রতী হন৷ মার্কসের প্রধান রচনা, ‘পুঁজি’ (ক্যাপিটাল) নিয়োজিত হয়েছে আধুনিক, অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির পর্যালোচনায়৷

মার্কসের পূর্বেকার ধ্রুপদী রাজনৈতিক–অর্থশাস্ত্র উদ্ভব হয়েছিল পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিকশিত দেশ ইংল্যান্ডে৷ অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর অনুসন্ধান চালিয়ে ‘শ্রমের মূল্যতত্ত্ব’ (লেবার থিওরি অফ ভ্যালু)–র ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ মার্কস তাঁদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান, তিনি ওই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করেন এবং ধারাবাহিকভাবে তার বিকাশ ঘটান৷ তিনি দেখান যে, কোনও পণ্য উৎপাদন করতে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় যে পরিমাণ শ্রমসময় ব্যয় করা হয়, তার দ্বারাই প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়৷

বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা দেখেছিলেন দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের সম্পর্ক (একটি পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্য), মার্কস সে জায়গায় প্রতিষ্ঠা করলেন মানুষে মানুষে সম্পর্ক৷ পণ্যের বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের মাধ্যমে এক একজন উৎপাদকের সঙ্গে অপরাপর উৎপাদকের সংযোগকে প্রকাশ করে৷ মুদ্রার ব্যবহার দেখায় যে, এই সংযোগ ক্রমেই ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে, তা প্রতিটি উৎপাদকের সমগ্র আর্থিক জীবনকে একটি অখণ্ড সত্তার মধ্যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করে দিচ্ছে৷ এই সংযোগেরই আরও বিকাশ সূচিত করছে পুঁজি৷ মানুষের শ্রমশক্তি পরিণত হচ্ছে পণ্যে৷ জমি, কারখানা ও শ্রমের হাতিয়ারগুলির মালিকের কাছে মজুরি–শ্রমিক তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করছে৷ দিনের একটি অংশে শ্রমিক খাটছে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয় (মজুরি) উপার্জন করার জন্য৷ দিনের বাকি অংশের কাজের জন্য কোনও মজুরি সে পায় না৷ এই অংশের শ্রমের দ্বারা সে পুঁজিপতির জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করছে– যে উদ্বৃত্ত মূল্যই হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা ও সম্পদের উৎস৷

উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব হচ্ছে মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূল ভিত্তিপ্রস্তর৷

পুঁজি তৈরি হয় শ্রমিকের শ্রমের দ্বারা৷ আবার সেই পুঁজিই ছোট উৎপাদকদের ধ্বংসসাধন ও বিশাল বেকারবাহিনী সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে শ্রমিককে পিষ্ট করে৷ শিল্পের ক্ষেত্রে বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থার বিজয়ের ফল তৎক্ষণাৎ বোঝা যায়৷ কিন্তু একই জিনিস কৃষির ক্ষেত্রেও ঘটতে দেখা যাবে৷ সেখানেও বৃহদায়তন পুঁজিবাদী কৃষির প্রাধান্য বাড়ছে, যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে এবং কৃষি–র্থনীতির পুরনো ধাঁচা মুদ্রা–পুঁজির ফাঁদে আটকা পড়ে ডুবছে, তা পিছিয়ে পড়া উৎপাদনপ্রণালীর বোঝার চাপে ভেঙে পড়ছে৷ ক্ষুদ্র উৎপাদনের ভাঙন কৃষিতে ভিন্ন রূপে ঘটছে, কিন্তু ভাঙন যে ঘটছে, তা একটি অনস্বীকার্য ঘটনা৷

পুঁজি ক্ষুদ্র উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটায় এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের জোটগুলির জন্য একটি একচেটিয়া অবস্থান তৈরি করে দেয়৷ উৎপাদনটাই ক্রমে অধিকতর হারে সামাজিক চরিত্র নেয়– হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জীবদেহের অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো একসাথে বাঁধা পড়ে যায়৷ কিন্তু এই যৌথ শ্রমের ফল আত্মসাৎ করে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি৷ উৎপাদনের নৈরাজ্য, সংকট, বাজারের জন্য উন্মত্ত প্রতিযোগিতা এবং ব্যাপক জনসমষ্টির অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতা তীব্রতর হয়ে ওঠে৷

পুঁজির উপর শ্রমিকদের নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ঐক্যবদ্ধ শ্রমের এক বিশাল ক্ষমতা সৃষ্টি করে৷

মার্কস দেখিয়েছেন সেই পথের দিশা, যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ পণ্য অর্থনীতির ভ্রূণাবস্থা থেকে সরল বিনিময় ব্যবস্থা পার করে পৌঁছেছে তার উচ্চতম রূপ বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থায়৷ বিশ্বের পুরনো ও নতুন সকল পুঁজিবাদী দেশের বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় শ্রমিকদের কাছে মার্কসীয় মতবাদের সত্যতা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরছে৷

বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদ জয়যুক্ত হয়েছে৷ কিন্তু এ জয় শুধু পুঁজির উপর শ্রমের বিজয়লাভের আগমনী গান৷

(৩)

সামন্ততন্ত্র যখন উৎখাত হল এবং বিশ্বে ‘স্বাধীন’ পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটল, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই স্বাধীনতা আসলে শ্রমজীবী জনগণের উপর অত্যাচার ও শোষণের একটি নতুন ব্যবস্থা৷ এই অত্যাচার ও শোষণের প্রতিফলন ও প্রতিবাদ স্বরূপ নানা ধরনের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ অবিলম্বে দেখা দিতে শুরু করে৷ প্রথম দিককার সমাজতন্ত্রবাদ অবশ্য ছিল কাল্পনিক সমাজতন্ত্র৷ তা পুঁজিবাদী সমাজের সমালোচনা করেছে, নিন্দা করেছেন, অভিশাপ দিয়েছে, তার ধ্বংসের স্বপ্ন দেখেছে, উন্নততর এক ব্যবস্থার কল্পনায় মেতেছে এবং ধনীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, শোষণ করা অনৈতিক কাজ৷

কিন্তু কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রকৃত সমাধানের পথ দেখাতে পারেনি৷ তা পুঁজিবাদী সমাজের মজুরি–দাসত্বের প্রকৃত চরিত্র ব্যাখ্যা করতে পারেনি, পুঁজিবাদী বিকাশের নিয়মগুলি কী তা–ও আবিষ্কার করতে পারেনি এবং কোন সে সামাজিক শক্তি যা নতুন সমাজ তৈরি করার ক্ষমতা রাখে– তা–ও নির্দেশ করতে পারেনি৷

ইতিমধ্যে সামন্ততন্ত্র, ভূমিদাসত্বের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের সর্বত্র এবং বিশেষ করে ফ্রান্সে যেসব উত্তাল বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা থেকে উত্তরোত্তর পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, সমাজের শ্রেণিগুলির মধ্যকার সংগ্রামই হচ্ছে সকল বিকাশের মূল ভিত্তি ও চালিকাশক্তি৷

সামন্ত শ্রেণিকে পরাজিত করে রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনও একটি বিজয়ও মরণপণ প্রতিরোধের মোকাবিলা না করে অর্জন করা যায়নি৷ পুঁজিবাদী সমাজের নানা শ্রেণিগুলির মধ্যে জীবন–মরণ সংগ্রাম ছাড়া কম–বেশি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি নিয়ে কোনও পুঁজিবাদী দেশই দাঁড়াতে পারেনি৷

মার্কসের প্রতিভা এখানেই যে, এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের যে শিক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে সর্বপ্রথম তিনিই সিদ্ধান্তের আকারে তুলে ধরতে সক্ষম হন এবং তা ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করেন৷ মার্কসের এই সিদ্ধান্তই হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রামের মতবাদ৷

সমস্ত রকম নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতিগুলির পিছনে সবসময় কোনও না কোনও শ্রেণির স্বার্থই যে কাজ করে, এই সত্য আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত জনসাধারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বদা প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ শিকার হয়েছে এবং চিরকাল তাই হতে থাকবে৷  সংস্কার ও উন্নয়নের চ্যাম্পিয়নরা পুরনো ব্যবস্থার রক্ষকদের হাতে ততদিন বোকা বনে যাবেন, যতদিন না তাঁরা বুঝবেন যে, প্রতিটি পুরনো প্রতিষ্ঠান তা যত বর্বর ও ক্ষয়িষ্ণুই হোক না কেন, তাকে কোনও না কোনও শাসক শ্রেণির শক্তিই টিকিয়ে রেখেছে৷ এবং ওই শাসক শ্রেণিগুলির বাধা চূর্ণ করার একটাই পথ, তা হল আমাদের সমাজের মধ্যকার যে শক্তিগুলি তাদের বিশেষ সামাজিক অবস্থানের কারণে পুরনো ব্যবস্থাকে সমূলে উচ্ছেদ করার ও নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষমতার অধিকারী এবং একমাত্র যাদের দ্বারাই তা সম্ভব, তাদের খুঁজে বের করা, তাদের সচেতন করে তোলা এবং সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করা৷ মানবসমাজের সকল নিপীড়িত শ্রেণিগুলি এতকাল পর্যন্ত যে চিন্তাগত দাসত্বের বাঁধনে থেকে জড়ত্বের শিকার হয়েছে, মার্কসের দার্শনিক বস্তুবাদই একমাত্র সেই চিন্তার দাসত্বের বন্ধন থেকে সর্বহারা শ্রেণিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণির সত্যকার অবস্থান কোথায়, একমাত্র মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বেই তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে৷

আমেরিকা থেকে জাপান, সুইডেন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, সারা দুনিয়া জুড়ে সর্বহারার স্বতন্ত্র সংগঠনের সংখ্যা বাড়ছে৷ নিজেদের শ্রেণিসংগ্রাম পরিচালনা করে সর্বহারা শ্রেণি ক্রমে দীক্ষিত ও শিক্ষিত হয়ে উঠছে, পুঁজিবাদী সমাজের কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করছে, আরও নিবিড়ভাবে নিজেদের সংগঠিত করছে এবং শিখছে কী করে নিজেদের সাফল্যের পরিমাপ করতে হয়৷ সর্বহারা শ্রেণি নিজেদের শক্তিসমূহকে ইস্পাতদৃঢ় করে তুলছে এবং বেড়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্যভাবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২০ সংখ্যা)