মানুষ ধুঁকছে অপুষ্টি-অনাহারে, সরকার বাড়তি চাল-গম দিচ্ছে মদ ব্যবসায়ীদের

গত ডিসেম্বরে সামনে এসেছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএম)-২০১৯-‘২০-র হাড় হিম করা রিপোর্ট। দেখা যাচ্ছে, দেশের বড় ১০টি রাজ্যের মধ্যে ৭টিতেই শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা উদ্বেগজনক। এই ৭টি রাজ্যের প্রতিটিতেই শিশু অপুষ্টি বেড়েছে। তিনজন পিছু একজন শিশু পুষ্টির অভাবে ঠিকমতো বাড়তে পারেনি। প্রসূতি মায়েদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই ভুগছেন রক্তাল্পতায়। অর্থাৎ পৃথিবীর আলো দেখার আগেই গুরুতর অপুষ্টির শিকার হচ্ছে তাঁদের গর্ভের সন্তান।

কয়েকমাস আগে প্রকাশিত ২০২০ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্টেও অপুষ্ট ভারতের মর্মান্তিক ছবি স্পষ্ট। ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানেরও নিচে নেমে গিয়ে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ৯৪। দেখা গেছে এ দেশে অপুষ্টির মাত্রা আফ্রিকার বহু দারিদ্রপীড়িত দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। রাষ্ট্রসংঘের একটি (ইউএন-এফএও) রিপোর্ট বলছে, ভারতের প্রায় ২০ কোটি মানুষের প্রতিদিন দু’বেলা খাবার জোটে না।

এ তো গেল করোনা অতিমারি হানা দেওয়ার আগেকার ছবি। এখন এই অতিমারি বিধ্বস্ত দেশে খাদ্যসঙ্কট যে আরও বহু গুণ তীব্র হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু দেশ পরিচালনার জন্য তো সরকার আছে! দেশের মানুষের অপুষ্টি দূর করতে তারা কী করছে? আগের বছরগুলির কথা যদি বাদও দিই, অতিমারি-লকডাউনে বিপর্যস্ত কোটি কোটি কাজ-খোয়ানো, না-খেতে-পাওয়া পরিবারগুলির কথা আদৌ তারা ভেবেছে কি? ভাবলে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক মাস রেশনে নাম কা ওয়াস্তে কিছু চাল-গম দিয়ে ডিসেম্বর থেকে তা বন্ধ করে দিল কেন? ডিসেম্বর থেকে অভাবে জর্জরিত, অতিমারি ও লকডাউনে বিপর্যস্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমস্যাগুলি কি উবে গেছে? সরকার কি সকলের হাতে কাজ তুলে দিতে পেরেছে? নাকি টান পড়েছে দেশের খাদ্যভাণ্ডারে!

কেউ কেউ শেষের যুক্তিটাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে পারেন। মনে হতে পারে, সরকারের পক্ষে কি দেশের মানুষের মুখে মাসের পর মাস ধরে এ ভাবে খাদ্য তুলে দেওয়া সম্ভব! তাঁদের সামনে তুলে ধরা যাক, ভারতের সঞ্চিত খাদ্যভাণ্ডারের চেহারাটা। গত কয়েক বছর ধরেই এ দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের সমস্ত মানুষকে সারা বছর ভরপেট খাওয়াতে যতটা লাগে, ভারতে ফসলের উৎপাদন হয় তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ২০১৮-‘১৯ সালে ২৮ কোটি ৩৩ লক্ষ ৭০ হাজার টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে এ দেশে। বর্তমানে গোটা বিশ্বের মধ্যে চাল ও গম উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয়, মিলেট (জোয়ার, বাজরা, রাগি ইত্যাদি শস্য) উৎপাদনে প্রথম। আপদে-বিপদে অর্থাৎ জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য সরকার ‘বাফার স্টক’-এ মজুত থাকার কথা মোট ৩০৭ লক্ষ টন খাদ্যশস্য, যার মধ্যে প্রয়োজনীয় চালের পরিমাণ ১০২ লক্ষ টন। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অক্টোবরের শুরুতে দেশে মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৬৩০ লক্ষ টন। শুধু মজুত চালেরই পরিমাণ ১৯৩ লক্ষ টন। অর্থাৎ দেশের গুদামগুলিতে চাল সহ মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এর ওপর সরকার আবার ধান কেনার কাজ শুরু করেছে। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেনা হয়ে গেছে ২৮৬ লক্ষ টন। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এ বছর ধান কেনা হবে ৪৯৫ লক্ষ টন। বুঝতে অসুবিধা নেই, পুরনো মজুত খালি করা না গেলে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য রাখার জায়গা সরকারি গুদামে হবে না।

কী ভাবে খালি করা হবে গুদাম? না, খেতে না পাওয়া মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে বা কম দামে খাদ্যশস্য বিলি করা হবে না। বিজেপি সরকার ঘোষণা করেছে, এই বাড়তি খাদ্যশস্য তুলে দেওয়া হবে ভাটিখানা মালিকদের হাতে, ইথানল তৈরির জন্য। মদের অন্যতম উপাদান এই ইথানল নাকি ব্যবহৃত হবে জ্বালানি হিসাবে। ঘোষণা হয়েছে, ভাটিখানা গড়ায় উৎসাহ দিতে শিল্পপতিদের ৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা সাহায্যও দেবে মোদি সরকার। অথচ এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের একটা বড় অংশ ব্যবহার করে অতিমারিতে কাজ হারিয়ে পথে বসা, গরিব, অনাহারী, দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের মুখে খুব সহজেই তো তুলে দেওয়া যেত দু’বেলার পেটভরা খাবার! সে পথে কিন্তু হাঁটল না নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার। মানুষের দুর্দশায় কতখানি নির্বিকার হলে তবে কোনও সরকার এমন কাজ করতে পারে!

এ তো স্পষ্ট যে, সরকারি রিপোর্টেই দেশের বড় অংশের মানুষের অপুষ্টির এই যে ভয়াবহ ছবি উঠে এল, সে ছবির কারিগর আর কেউ নয়, খোদ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার! এই সরকারই তো অভুক্ত, কঙ্কালসার এই ভারতের নির্মাতা যারা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে বেচে দেয় মুনাফালোভী মদ-ব্যবসায়ীদের কাছে! এই তা হলে মোদি-শাহদের ঢাক পেটানো দেশপ্রেমের নমুনা! এই প্রধানমন্ত্রীই না দ্বিতীয়বার সরকারে বসে সংসদে প্রবেশ করার সময় দেশের সংবিধানকে সাড়ম্বরে মাথায় ঠেকিয়েছিলেন! আজ কিন্তু সেই সংবিধানের পাতায় লেখা মানুষের ‘খাদ্যের অধিকার’কে দু’পায়ে মাড়িয়ে যেতে বাধছে না তাঁর কিংবা তাঁর সরকারের।

যদিও এ নির্লজ্জ অমানবিকতা নতুন নয়। এর আগেও অনেকবার সরকারি নির্দেশে বাড়তি টন টন খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে, তবুও মালিকদের মুনাফার স্বার্থে, পণ্যের দাম পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেগুলো বাজারে জোগান দেওয়া হয়নি কিংবা বিনা দামে বা কম দামে গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। এমন করলে নাকি অলস হয়ে যাবে খেটে-খাওয়া মানুষ! হায় রে, এঁরাই নাকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি!

বাস্তবিকই, পুঁজিবাদী ভারত রাষ্ট্রটির আসল মালিক মুনাফাবাজ পুঁজিপতি শ্রেণি আর তার রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারগুলি সাধারণ মানুষ সম্পর্কে এমন অবমাননাকর ধারণাই পোষণ করে। সাধারণ মানুষের ভোটে জিতে সরকারে বসে এরা সর্বশক্তি উজাড় করে দেয় মালিক শ্রেণির সেবায়। তাদের মুনাফার ভাণ্ডার ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার নির্লজ্জ অপচেষ্টায় গরিব মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেও হাত কাঁপে না এদের। দেশের খাদ্যভাণ্ডারের উদ্বৃত্ত শস্য মদের কারবারিদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ঘটনা পুঁজিপতি শ্রেণির পেটোয়া সরকারগুলির ঘৃণ্য চেহারা দেশের মানুষের সামনে আরও একবার তুলে ধরল।