বিএসএফএর ক্ষমতা বৃদ্ধি
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, আসামের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) এক্তিয়ার ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হবে। এই এলাকার মধ্যে সরাসরি তল্লাশি, বাজেয়াপ্ত এবং গ্রেপ্তার করার অতিরিক্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বিএসএফ-এর হাতে। বিজেপি সরকারের যুক্তি, এই ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং চোরাচালান রোখা সম্ভব হবে। দেশের মানুষের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।
এতদিন বিএসএফ ছিল, পুলিশ ছিল, কিন্তু সীমান্ত এলাকার মানুষের নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত ছিল? সেখানকার মানুষের অভিজ্ঞতা হল– সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান চলে অবাধে, অথচ কাঁটাতার পেরিয়ে চাষ করতে গিয়ে বিএসএফের হাতে অত্যাচারিত হন চাষিরা। তল্লাশির নামে মহিলাদের শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়। দিনের পর দিন গরিব মানুষের থেকে লুঠ চলে, গরু-ছাগল অবাধে পাচার হয়ে যায়। মহিলা-শিশু পাচার চলে বিএসএফের নাকের ডগায়। পাচারকারী এবং বিএসএফ চক্রের ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়ে উঠেছে অসহনীয়। এ ছাড়াও সীমান্ত এলাকায় গুম-খুন চলে অবাধে। গত পাঁচ বছরে বিএসএফের বিরুদ্ধে ২৪০টি অত্যাচার, ৬০টি খুন এবং ৮টি নিখোঁজের ঘটনার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। অনথিভুক্ত সংখ্যা আরও অনেক। যখন আফস্পা সহ এই ধরনের আইনগুলি প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন, তখন এ ধরনের পদক্ষেপ কি জনগণের দুর্গতি বাড়িয়ে তুলবে না?
জানা গেছে, বিএসএফের এলাকা বাড়লে ১১টি জেলা, রাজ্যের ৩৭ শতাংশ এলাকা এবং উত্তরবঙ্গের সিংহভাগ তাদের দখলে চলে যাবে। বিএসএফের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব সরকার ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো’র উপর আঘাত বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এর বিরোধিতা করে প্রস্তাবও পাশ হয়েছে।
যে প্রশ্নটি উঠছে তা হল, সীমান্তের ১৫ কিমি-র মধ্যে বিএসএফ যদি চোরাচালান রুখতে না পারে, তাহলে ৫০ কিমি ভিতরে ঢুকে পারবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? গুজরাটে সীমান্তের ৮০ কিমি পর্যন্ত বিএসএফ-এর ক্ষমতা থাকলেও সেখানে তারা চোরাচালান রুখতে পারছে না কেন? সেখানকার মানুষের নিরাপত্তার হাল কী? সম্প্রতি গুজরাটে আদানির মুন্দ্রা বন্দরে চোরাচালান করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণে মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তাও বিএসএফ-এর হাতে নয়। তাহলে বিএসএফ-এর এক্তিয়ার বাড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন? জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিএসএফের অবাধ যাতায়াতের ছাড়পত্র মানুষকে ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। সীমান্তের দূরবর্তী এলাকায় আইনশৃঙখলা রক্ষার জন্য তো পুলিশ রয়েছে। পুলিশের সাথে বিএসএফের বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই তো এ কাজ করা যায়। তা সত্ত্বেও বিএসএফ-এর ক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দেয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই এ অভিযোগ উঠছে যে, বিরোধী রাজ্যগুলির বিস্তীর্ণ এলাকায় নিজেদের আধিপত্য কায়েমই এর উদ্দেশ্য।
সত্যিই কি কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিএসএফের ক্ষমতা বাড়িয়েছে? তাহলে সীমান্তে বিএসএফ জওয়ানদের হাতে একের পর এক অত্যাচার- খুনের ঘটনায় বিজেপি নেতারা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কেন? উল্টে এর বিরোধিতা করলে দেশাত্মবোধের জিগির তুলে তাদের ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিচ্ছেন! সম্প্রতি কোচবিহারের সিতাইয়ে ৩ জন মানুষকে গরু চোরাচালানকারী সন্দেহে বিএসএফ গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। সন্দেহের ভিত্তিতে এভাবে খুন মানুষের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বিএসএফের এক্তিয়ার বৃদ্ধির কেন্দ্রীয় সরকারের এই ফরমান সাধারণ মানুষ কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারে না।