মোদি সরকারের রাজত্বে গ্রাম–ভারতে বাস করা মানুষ জীবনের অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলিতেও খরচ করতে পারছে না৷ গত চার দশকে এই খরচ এতখানি কমে যাওয়ার নজির নেই৷ নুন চিনি তেল মশলা থেকে জামাকাপড় বাড়িভাড়া, এমনকি পড়াশোনার জন্যও আজ খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে গ্রামে বাস করা মানুষ৷
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (এনএসও)–র ২০১৭–১৮ সালের সমীক্ষা রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে৷ রিপোর্টটিকে চেপে রাখতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ সম্প্রতি এক সংবাদপত্রে তা ফাঁস হয়ে যায়৷ গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার বেড়ে ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে বলে দেখিয়েছিল যে এনএসও–র সমীক্ষা রিপোর্ট, সেটিকেও ঠিক একই রকম ভাবে চেপে রেখেছিল সরকার৷ সে রিপোর্টও সংবাদপত্রে ফাঁস হয়েছিল৷
দেশের জনসংখ্যার তিন ভাগের দু’ভাগই বাস করে গ্রামে৷ তাঁদের জীবনের উপর আর্থিক মন্দা কী মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, খরচে মানুষের এই অক্ষমতা তারই প্রমাণ৷ রিপোর্ট অনুযায়ী দানাশস্য কেনা গ্রামে কমেছে ২০.৪ শতাংশ, শহরে ৭.৯ শতাংশ৷ চিনি নুন মশলা কেনার পরিমাণ গ্রামে কমেছে ১৬.৬ শতাংশ, শহরে ১৪.২ শতাংশ৷ খাদ্যদ্রব্য সহ জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলিও মানুষ কিনছে না কেন? তারা কি সন্তান সহ পরিবারের মুখে দু’বেলা পেটভরে খাবারটুকু তুলে দিতে চায় না, সন্তানের শিক্ষার পিছনে খরচ করতে চায় না? এইসব অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র কেনার মতো আয় মানুষের নেই বলেই খরচ এত কমে গেছে৷এটা বুঝতে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না৷
এই রিপোর্ট সরকারের গত বছর জুনে প্রকাশ করার কথা ছিল৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে এই রিপোর্ট বের করার সাহস করেনি সরকার৷ তা হলে গত পাঁচ বছরে বিজেপি কেমন ‘আচ্ছে দিন’ এনেছে, সেটা বেরিয়ে পড়ত৷ সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টটি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনেক খামতি থাকায় রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়নি৷
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী এমন খামতি ছিল যে কারণে সরকার রিপোর্টটি খারিজ করে দিল? এবারের প্রকাশিত রিপোর্টের হিসাব মতো দেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই এখন দারিদ্রসীমার নিচে৷ ফলে সরকারের ‘সব কা বিকাশের’ তৈরি করা ভাবমূর্তিতে কালি মাখামাখি হবে বলেই যে এই রিপোর্টও চেপে রাখা হয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
কালো টাকা উদ্ধারের নামে মোদি সরকারের নোট বাতিল এবং জিএসটি চালুর সিদ্ধান্ত অর্থনীতির উপর এক মারাত্মক আক্রমণ হিসাবে নেমে এসেছিল৷ ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলি এখনও সেই আক্রমণের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ বাস্তবে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী আর্থিক নীতিই মানুষের কেনার ক্ষমতাকে এমন করে টেনে নামানোর জন্য দায়ী৷ পুঁজিবাদী শোষণ যে মারাত্মক আকারে দেশের মানুষের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে, কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাওয়া তারই ফল৷ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে কৃষির সঙ্গে যুক্ত তার অবস্থা তীব্র পুঁজিবাদী শোষণে চরম সংকটে৷ চাষিরা ধান পাট আলু তুলো আখ প্রভৃতি প্রতিটি কৃষি উৎপাদনের ন্যায্য দাম থেকে দশকের পর দশক ধরে বঞ্চিত হয়ে চলেছে৷ কৃষক আত্মহত্যার বিরাম নেই৷ গ্রামীণ মানুষের জীবনের উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে৷ মন্দার ফলে কলকারখানা যেমন শয়ে শয়ে বন্ধ হয়ে চলেছে তেমনই চালু কারখানাগুলিতেও লাখে লাখে শ্রমিক–কর্মচারী ছাঁটাই হয়ে চলেছে৷ এই বিরাট সংখ্যক মানুষের কেনার ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার কারণেই আজ এই ভয়ঙ্কর মন্দা৷
জনগণের কেনার ক্ষমতা বজায় রাখতে তাদের জন্য নিয়মিত রোজগারের ব্যবস্থা করা ছিল এই মুহূর্তে সরকারের বড় দায়িত্ব৷ বাস্তবে সরকার কী করছে? মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর কোনও উদ্যোগ নিয়েছে? না৷ ফসলের ন্যায্য দাম দূরের কথা, নামমাত্র দাম বাড়াতেও চাষিদের বার বার রাস্তার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে৷ বেকারদের কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা নেই৷ বিপরীতে মন্দার সংকট থেকে রেহাই দিতে পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঢেলে দিয়ে সরকার প্রমাণ করেছে, জনস্বার্থ নয়, পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ সম্প্রতি সরকার কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে৷ আবাসন শিল্পের মালিকদের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গড়ে দিয়েছে সরকার৷ ব্যাঙ্কগুলি থেকে পুঁজিপতিদের লোপাট করে দেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে পুষিয়ে দিয়েছে৷ দফায় দফায় ব্যাঙ্কের সুদের হার কমিয়েছে৷ দাবি করেছে, এর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে৷ অথচ সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা না বাড়লে বাজার কখনও চাঙ্গা হয় না৷ বাজার চাঙ্গা না হলে পুঁজিপতিদের হাতে যত পুঁজিই থাকুক, তারা বিনিয়োগ করবে না৷ এই সংকট পুঁজিপতি শ্রেণিরই তৈরি, তাদের নির্মম শোষণের ফল৷
মহান কার্ল মার্কস বহু আগে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের’ তত্ত্বে দেখিয়ে দিয়েছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক কীভাবে শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মুনাফা করে এবং তার পুঁজি গড়ে তোলে৷ তিনি দেখান, কীভাবে ক্ষুদ্রপুঁজিকে বৃহৎ পুঁজি গিলে খায় এবং এই প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া পুঁজির জন্ম হয়৷ উল্টো দিকে শ্রমজীবী মানুষকে ক্রমাগত শোষণ করতে করতে কীভাবে পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের ছিবড়ে করে দেয় এবং পরিণতিতে তাদের কেনার ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকে৷ এই কেনার ক্ষমতা কমে যাওয়া মানেই পুঁজিবাদী বাজার সংকুচিত হওয়া৷ বাজার সংকুচিত হওয়া মানেই উৎপাদিত পণ্যের গুদামে জমে যাওয়া৷ ফলে সমাজ জুড়ে মন্দা ছড়িয়ে পড়া৷ সাম্রাজ্যবাদের প্রথম যুগে মন্দা আসত ঢেউয়ের মতো৷ মন্দার পর উৎপাদন আবার স্থিতিশীল হত৷ তারপর মন্দা ঘন ঘন হতে থাকল৷ এক সময়ে এসে মন্দা এবেলা–ওবেলার সংকটে পরিণত হল৷ আর এখন তো মন্দা স্থায়ী রূপ নিয়েছে৷
পুঁজিপতি শ্রেণি মন্দা এড়াতে একের পর এক টোটকা প্রয়োগ করে চলেছে৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ কেইনস একসময় পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাঁচাতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কোনও উপায়ে জনগণের হাতে টাকা দিয়ে,কাজ দিয়ে জনগণের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর দাওয়াই দিয়েছিলেন৷ তা–ও যখন কাজে এল না তখন এল বিশ্বায়নের দাওয়াই– উদারিকরণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারি মালিকদের হাতে জলের দামে কিংবা বিনামূল্যে তুলে দেওয়া৷ কিন্তু কোনও টোটকাই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সংকট কাটাতে পারল না৷ এই অবস্থায় দেশে দেশে পুঁজিপতি শ্রেণি মন্দার সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিতে থাকল শোষিত সাধারণ মানুষের উপরই৷ ফলে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ এই পরিস্থিতি শুধু ভারতেই নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে৷ সর্বত্রই শোষিত মানুষ পুঁজিবাদী শোষণ–শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে৷ রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ–মিলিটারির সাথে ব্যারিকেড ফাইট করছে৷ ভারতের শাসকরা মানুষের ক্ষোভকে বিপথগামী করতে ধর্ম–জাতপাত–মন্দি প্রভৃতি জিগির তুলে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে৷ কিন্তু মানুষের আর্থিক সংকট যেভাবে তীব্র আকার নিয়েছে, তাতে মানুষকে এই মিথ্যা জিগিরে বেশি দিন ভুলিয়ে রাখা যাবে না৷ শোষিত মানুষ পুঁজিবাদী শোষণের জোয়াল থেকে মুক্ত হতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলনে ফেটে পড়বেই৷ শুধু দরকার লড়াইয়ের সঠিক শক্তিকে চিনতে পারা৷