সারা দেশ তৈরি হচ্ছে ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ সফল করার জন্য। নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল-২০২১ প্রত্যাহারের দাবিতে এই বনধের ডাক দিয়েছে কৃষক সংগঠনগুলির জোট ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) বনধকে সর্বাত্মক সফল করার জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন রেখেছে। দলের কর্মীরা প্রচারের কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কৃষক ও শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠনগুলি, ছাত্র যুব মহিলা শিক্ষক অধ্যাপকদের সংগঠনগুলি, স্কিম ওয়ার্কারদের সংগঠন, ছোট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিকরা প্রায় সবাই এই বনধকে সমর্থন করেছে এবং সর্বাত্মক ভাবে সফল করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে।
বনধে একদিনের রুটি-রুজি বন্ধ হয় খেটে খাওয়া মানুষের। তবুও তাঁরা নিজেরাই কেন এই বনধ সফল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সর্বশক্তি দিয়ে?
গত ৭৫ বছরে দেশের কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার যে মূল সমস্যা তার সমাধান কোনও সরকার করেনি। কৃষকদের দীর্ঘদিনের এই দাবি মানা দূরের কথা, বিজেপি সরকার গোটা কৃষি ব্যবস্থাটিকেই দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির হাতে তুলে দিতে নতুন আইন নিয়ে এসেছে। একই সাথে বিদ্যুৎ আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনী এনে গোটা বিদ্যুৎ ব্যবস্থাটিকেও একচেটিয়া পুঁজির হাতে তুলে দিচ্ছে। এতে কৃষকরা যেমন একচেটিয়া পুঁজির ক্রীতদাসে পরিণত হবে তেমনই বিদ্যুতের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।
এ ছাড়া বিজেপি সরকার রেল, তেল, গ্যাস, বিমান ও জাহাজ বন্দর, জাতীয় সড়ক, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ সমস্ত জাতীয় সম্পদ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিষেবার বাড়তি খরচের বোঝা সাধারণ মানুষের উপর চাপবে। বিজেপি সরকারের নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং স্বাস্থ্যনীতির ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে ইতিমধ্যেই একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফার পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ সব কিছুই বিজেপি সরকার একতরফা ভাবে দেশের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, সাধারণ মানুষ কিংবা বিরোধীদের মতামতের কোনও গুরুত্ব না দিয়েই তারা সরকারি ক্ষমতার জোরে এ কাজ করে চলেছে। সরকারের এই ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি।
অন্য দিকে সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে। কিন্তু সেই প্রতিবাদকে মূল্য দেওয়ার মতো নূ্যনতম গণতান্ত্রিক বোধ বিজেপি সরকারের নেই।
নতুন কৃষি আইনের মারাত্মক পরিণতি উপলব্ধি করে কৃষকরা তা প্রত্যাহারের দাবিতে গত নভেম্বর থেকে দশ মাস ধরে দিল্লি বর্ডারের নানা জায়গায় অবস্থান-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা ট্রাক্টর নিয়ে বারবার মিছিল করেছেন, রাজ্যে রাজ্যে মহাপঞ্চায়েতের আয়োজন করে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছেন। কিন্তু সরকার কয়েক দফা আলোচনার প্রহসন ছাড়া আর যা করেছে তা হল কৃষকদের নামে কুৎসা– খালিস্তানি, পাকিস্তানি প্রভৃতি নামে দাগিয়ে দেওয়া। এই অবস্থায় শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষ বিজেপি সরকারের একতরফা আক্রমণের সামনে পড়ে যখন খানিকটা দিশেহারা হয়ে ভাবছিল এই আক্রমণকে কি রোখা যাবে, নাকি পড়ে পড়ে শুধু মারই খেতে হবে, ঠিক তখনই দেশজুড়ে আওয়াজ উঠল– সরকার যখন কৃষক-শ্রমিক-কর্মচারী, সাধারণ মানুষ কারও কথা শুনবে না, কোনও দাবিতে কর্ণপাত করবে না, তখন ধর্মঘট ছাড়া উপায় কী!
যে শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল, মার খাওয়াটাকে ভবিতব্য বলে যারা ধরে নিয়েছিল, এই ভারত বনধের কর্মসূচি আসলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। যে শ্রমিক, যে কৃষক, যে সাধারণ মানুষ ভাবছিল আক্রমণটা শুধু তার উপরেই, এ আক্রমণ সে একা কী করে রুখবে, ২৭ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের ডাক তাকে দেখিয়ে দিল, আক্রমণটা শুধু তার একার উপর নয়, তাই প্রতিরোধেও সে একা নয়, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, কোটিতে কোটিতে শ্রমজীবী মানুষ তারই মতো বনধের শরিক হতে এগিয়ে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য গোটা দেশ স্তব্ধ করে দিয়ে, উৎপাদনকে এক দিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়ে সরকারের টনক নাড়িয়ে দেওয়া যে, সরকার কিংবা একচেটিয়া পুঁজিপতিরা যত ক্ষমতাশালীই হোন, দেশের মানুষ এই সব কালা আইন মেনে নেবে না।
বনধ কিংবা ধর্মঘট মালিকদের, আর তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার সরকারকে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। একটা ধর্মঘট মেহনতি মানুষকে বুঝতে শেখায় মালিকদের শক্তির উৎস কী, শোষিত মানুষের শক্তির উৎসই বা কোথায়। শোষিত মানুষ বুঝতে পারে ধর্মঘটে কাজ করতে অস্বীকার করার দ্বারা তারা সমস্ত উৎপাদন যন্ত্রকেই অচল করে দেওয়ার শক্তি ধরে। ধর্মঘট শোষিত মানুষকে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে, বুঝতে শেখায়– মালিকরা যতই অর্থ, সম্পদ, উৎপাদন যন্তে্রর মালিক হোক না কেন, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের শ্রম ছাড়া সে-সবই মূল্যহীন, তা থেকে কোনও মুনাফাই আসবে না। ধর্মঘট প্রতিটি খেটে খাওয়া মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, তারা একা নয়, তারা রয়েছে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে তারা প্রত্যক্ষ করে, অনুভব করে। হতাশা কাটিয়ে আত্মশক্তিতে তারা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।
মালিকি শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মিছিল, মিটিং, সমাবেশের মতো আন্দোলনের পদ্ধতিগুলিকে মালিকরা উপেক্ষা করার ভান করতে পারে, আন্দোলনকারীদের সাথে সরকারের মন্ত্রী-আমলারা দেখা না করতে পারেন, দাবি পূরণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, দেখছি-দেখব করে কালহরণ করতে পারেন, কিন্তু ধর্মঘটকে তাঁরা এভাবে উড়িয়ে দিতে পারেন না। কারণ, একটা মিছিল বা সমাবেশ যত বড়ই হোক, তাতে সামিল হয় ঐ দাবির সঙ্গে যুক্ত মোট জনসংখ্যার একাংশ। একমাত্র ধর্মঘটই দাবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অংশের মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত করে নিতে পারে। তাই বনধ বা ধর্মঘট হল সংগ্রামের একটা উচ্চতর হাতিয়ার। এদেশের মানুষ দেখেছে কীভাবে গরিব ঘরের সন্তানদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার অধিকার ফিরে পেতে সাহায্য করেছে ১৯৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারির বাংলা বনধ।
ভারত বনধ নিয়ে কোনও প্রচার সংবাদমাধ্যমে নেই। প্রচারমাধ্যমগুলির পিছনে কাজ করে মালিকদেরই বিপুল পরিমাণ পুঁজি। এগুলির মালিক তারাই। বনধ সম্পর্কিত প্রচারে তাই এই মাধ্যমগুলি চিরকাল একতরফা মনগড়া এবং বিকৃত প্রচার করে। ধর্মঘটের বিরুদ্ধে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
আবার কংগ্রেস, তৃণমূলের মতো তথাকথিত বিরোধী দলগুলিকেও এই বনধ চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচনী স্বার্থে এই দলের নেতারা সব সময়ই গরিব মানুষের, শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষার কথা বলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের হয় সরাসরি বনধের বিরোধিতা করে মালিকদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, না হয় শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের দাবিগুলির পক্ষে দাঁড়াতে হবে। আবার সিপিএমের মতো বামনামধারী দলগুলি যারা মুখে হলেও দাবিগুলিকে সমর্থন করছে, তারাও দাবি আদায়ে কতটা সিরিয়াস, কতটা দায়বদ্ধ তা বনধ সফল করার প্রশ্নে তাদের ভূমিকার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মেহনতি মানুষের পক্ষে এদের চিনে নেওয়াও অনেক সহজ হবে।
বনধে প্রতিফলিত বিপুল জনমত থেকে সরকার যদি শিক্ষা না নেয়, আরও শক্তিশালী, আরও ব্যাপক মানুষের সংঘবদ্ধ রূপ সংগ্রামের হাতিয়ার গড়ে তুলে সারা দেশব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠবে। পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির প্রয়োজনবোধ জীবন্ত হয়ে সংগ্রামের আর এক নতুন অধ্যায়ে উত্তীর্ণ হবে।