আক্রমণ, প্রহার, জখম, ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার উৎস কী? একই মানুষ তো একই সাথে সব অপরাধ বয়ে নিয়ে বেড়ায় না। অপরাধের ছোট ছোট স্তর অতিক্রম করতে করতে যখন কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মননে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি লাভের উদগ্র বাসনা অনুভূত হয় তখনই তো তার প্রতিপক্ষ নির্ধারিত হয়। প্রথমে চলে পরিবার-পাড়া-অঞ্চলের মধ্যে শাসকের রাজনৈতিক পরিসরে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। ধাপে ধাপে অন্যের প্রতি খবরদারি, দাদাগিরি, গুন্ডামি। পরিসর বাড়তে বাড়তে সরকারি প্রকল্পের টাকা চুরি, গোষ্ঠী বানিয়ে এলাকায় জল, জঙ্গল, জমি, মাটি, পাথর, বালি, কয়লা, ইমারতি দ্রব্য কেনা বেচার উপর একচ্ছত্র দখলদারি, দুর্নীতি, ধাপে ধাপে সরকারি মদতে পুকুরচুরি, ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায়, সম্পত্তি দখলের মধ্যে দিয়ে এলাকায় গুন্ডাদের নায়কে রূপান্তরণ। একই পরিবারে, একই পাড়ায়, অঞ্চলে, ক্ষমতার উদগ্র বাসনায় পাশাপাশি ছোটো বড় গোষ্ঠী গজিয়ে ওঠে। কার হাতে কত রাজনৈতিক ক্ষমতা, কত অর্থ, কত পেশিশক্তি এই নিয়ে চলে জনপ্রিয় কথাবার্তা। গোটা সমাজ, ধনী-দরিদ্র-শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মানুষই এই জনপ্রিয় আলোচনায় দিন, মাস, বছর অতিক্রম করে। এই জনপ্রিয়তার মধ্যেই ব্যক্তি ও পরিবার তাদের কেরিয়ার খুঁজতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অপরিণত রাজনৈতিক জ্ঞানের ফলে লোভ ও ক্ষমতালোভের সমুদ্রে গভীর খাত কোথায় তা যুবকেরা খুঁজে পায় না। এই অবস্থাতেই দরিদ্র-হতদরিদ্র, হাত-পা সর্বস্ব শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার যুবকেরা শাসকদলের নেতাদের লেজুড়ে পরিণত হয়। ভিড় করতে থাকে শাসকদলের স্থানীয় অফিস, পঞ্চায়েত, ব্লক ও শহরাঞ্চলের সমাবেশে। চূড়ান্ত অভাবের জ্বালা ও যথার্থ শিক্ষার অভাবে প্রবৃত্তিগত চাওয়া-পাওয়াগুলো এদের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। মদ, পর্নোগ্রাফি ও যৌনতার প্রবৃত্তিগত নেশায় তারা শাসকের ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রণহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদের নারী-শিশু-বৃদ্ধদের প্রতি চোখের চাউনি বদলে যায়। অন্ধকার-আবদ্ধ পরিবেশে এই যুবকেরা জীবন যাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সুযোগ পেলে এলাকার মাফিয়া ও ধাপে ধাপে এই চূড়ান্ত ক্ষমতালোভী সমাজবিধ্বংসী ভোগবাদী রাজনীতিই হয়ে ওঠে এদের জীবনদর্শন। এরা যা কিছু ভালোবাসে তা শুধু নিজের জন্য। এমনকি নিজের বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানকেও এরা প্রকৃত অর্থে ভালোবাসে না। ভালোবাসে শুধু নিজের ভোগের জন্য। ক্রমে এদের উগ্রতা চূড়ান্ত মাত্রা পায়। পাশাপাশি এই যুবকদের উদ্যোগে এলাকায় শাসকের প্রত্যক্ষ মদতে গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা চলে।
ক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রদর্শনের উগ্র ঝোঁক থেকে এই যুবকেরা এলাকায় ক্ষমতা প্রদর্শনের আকাঙক্ষায় লিপ্ত হয়। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ ও মারধর এদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। কখনও কখনও আঘাত পেয়ে প্রত্যাঘাত দিতে না পারলে বা চুরি-দুর্নীতিতে সন্তোষজনক ফল না মিললে পাল্টা আঘাতের জন্য এরা মুখিয়ে থাকে। এই পর্যায়ে যদি শাসকদল বদলের পালা চলে, অপরাধের উৎস খোঁজা বা নির্মূলের বদলে ‘অতীতের শাসকের থেকে বর্তমান শাসক ভালো, বা বর্তমান শাসকের থেকে অতীতের শাসক ভালো’–এই চর্চায় জনতা মশগুল হয়ে পড়ে। শিক্ষিত-অতি শিক্ষিত ডিগ্রিধারী দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ এদের দলবদল দেখে মুখরোচক গল্পে, কখনও কখনও হাততালি দিয়ে সমাজকে অতি সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়। বুর্জোয়া মিডিয়া ও শাসক দল যে আসলে এটাই চায়, ঘটনার স্রোতে, মুখরোচক গল্পের খপ্পরে পড়ে বহু ক্ষেত্রে জনতার তা উপলব্ধিতে আসে না।
এই অবস্থায়, ভোট যত এগিয়ে আসে বা ভোট পার হলে সরকারি ক্ষমতা দখল ও প্রতিশোধের লড়াই তীব্রতর হয়। এই পর্যায়ে হত্যা ও গণহত্যা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর মানসিকতায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মানবমনে পাশব প্রবৃত্তি সর্বোত্তম রূপে প্রতিফলিত হয়। নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই রেহাই পায় না। উগ্রতার আনন্দে ধর্ষণ ও খুন ধনতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের নয়া সংযোজন হয়ে দাঁড়ায়। পাশব প্রবৃত্তির ইতিহাসে জায়গা করে নেয় কংগ্রেস, সিপিআইএম, বিজেপি, তৃণমূল সহ এদেশের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক শাসকেরা। গড়ে ওঠে মরিচঝাঁপি, মৈপীঠ, কুলতলি, জয়নগর, নেতাই, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নানুর, সূচপুর, ছোট আঙারিয়া ও বগটুই।
একসাথে অনেক বন্ধু-সহপাঠী মিলে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করেছি নিম্ন মধ্যবিত্ত অর্থনীতির পরিসরে। আর্থ সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছোটো ছোটো অগণিত ঘটনার সাক্ষী আমরা। এ সমাজ ও শাসকসুলভ রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বড়ই নির্মম। অপরাধের শেকড় খুঁজতে গিয়ে প্রতিনিয়তই পাচ্ছি সেই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিপুষ্ট রাজনীতি, ক্ষমতা, লাভ, প্রবৃত্তি আর প্রতিহিংসাপরায়ণতার সীমাহীন উগ্রতা ও উন্মত্ততা। অগণিত মেহনতি মানুষের অসহায়ত্ব যেন দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই সেই পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতি তীব্র ধিক্কার জানাতে আবেদন জানাচ্ছে।
রাজীব সিকদার
ভবানীপুর, কলকাতা-২৫