Breaking News

মাধ্যমিক পরীক্ষাঃ তুঘলকি নিয়মে বেরিয়ে এল শিক্ষাব্যবস্থার ঘুণধরা চেহারা

 

গণতন্ত্রের ‘দায়িত্ব’ ও ‘অধিকার’ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত ২০২৪ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি এই অধিকার এবং দায়িত্ব– এই বিষয়দুটির মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনক্ষণ, রুটিন সব ঠিক হয়ে যায়প্রায় এক বছর আগেই। এবারও তাই হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর সপ্তাহ দুই আগে হঠাৎ একটি নোটিশ জারি করে জানানো হল, পূর্ব নির্ধারিত বেলা বারোটার পরিবর্তে এবারের মাধ্যমিক শুরু হবে প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে। শিক্ষকদের পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হতে হবে সকাল সাড়ে আটটায়। মাধ্যমিকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময়সূচিতে এই পরিবর্তন হঠাৎ কেন আনতে হল, তাও পরীক্ষার মাত্র সপ্তাহ দুই আগে, যখন শিক্ষক-পরীক্ষার্থী সহ সকলেই বারোটা থেকে তিনটে পরীক্ষা জেনে সেইমতো যাতায়াত এবং অন্যান্য বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে? এর কোনও সদুত্তর পর্ষদের থেকে পাওয়া যায়নি। সকাল দশটায় স্কুলে যেতেই যাঁদের দূর-দূরান্ত থেকে ভোরের বাস বা ট্রেন ধরতে হয়, কীভাবে এত সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছবেন সেই শিক্ষকরা? বাড়িতে শিশু, বয়স্ক বা অসুস্থ কারও রান্না এবং পরিচর্যা সেরে বেরোতে হয় যাঁদের, তাঁরাই বা কী ব্যবস্থা করবেন এত কম সময়ের নোটিশে? শীতের কুয়াশায় যখনপ্রায়শই ট্রেন বাতিল বা লেট হয়, সেই পরিস্থিতিতে কেউ পথে আটকে গেলে কী হবে?

গ্রামের চিত্র আরও কঠিন। শুধু শিক্ষকই নন, বহু ছাত্রছাত্রীও সেখানে নদী পেরিয়ে, বহুদূরের পথ হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। তাদের সবার জন্যই কি অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেল না এই সিদ্ধান্ত? সবচেয়ে বড় কথা, এরকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-অভিভাবক সহ কারও মতামত নেওয়ার বা জরুরি বৈঠক ডাকারও প্রয়োজন মনে করেনি পর্ষদ। এসটিইএ শিক্ষক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছিল, একটি জনস্বার্থ মামলাও হয়েছিল। সেসব যথারীতি ভেসে গেছে সরকারি হকুমের তোড়ে।

পরীক্ষা শুরুর দিন দুই আগে জানা গেল, পরিদর্শক-শিক্ষকদের এবার অতিরিক্ত একগুচ্ছ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নপত্রের খামের নির্দিষ্ট ক্রমিক নম্বর থাকবে এবং প্রতি প্রশ্নপত্রেরও ক্রমিক নম্বর থাকবে। সেই নম্বর অনুযায়ী পরপর পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন দিতে হবে, তারা খাতায় এবং অতিরিক্ত পাতা নিলে তার প্রতিটিতেও আট অঙ্কের সেই সংখ্যাটি লিখতে হবে। শিক্ষক সই করার আগে সেটি প্রতিবার মিলিয়ে নেবেন। আবার পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রতিটি ঘরে একটি করে ফর্ম দেওয়া হবে, যেখানে ওই ঘরের পরীক্ষার্থী সংখ্যা, প্রশ্নপত্রের খামের নম্বর, প্রশ্নপত্রের ক্রমিক সংখ্যা, কোনগুলো ব্যবহার হল, কেউ অনুপস্থিত থাকলে কোনগুলো অব্যবহৃত থাকল সেইসব প্রশ্নের ক্রমিক সংখ্যা ইত্যাদি লিখতে হবে। উত্তরপত্রের সাথে ম্যাপ বা গ্রাফ থাকলে খাতার ওপর সেটা লিখে আবার সই করতে হবে শিক্ষককে। প্রতিদিনের হাজিরার কাগজেও প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে পুরো নাম সই করতে হবে এবং প্রশ্নপত্রের ওই আট অঙ্কের ক্রমিক নম্বরটি আবার লিখতে হবে। শোনা গেছে, প্রশ্ন ফাঁস হওয়া আটকানো এবং পরীক্ষা ‘নির্বিঘ্নে’ সুসম্পন্ন করার জন্যই নাকি এত কাণ্ড। অথচ পরীক্ষার তিন ঘন্টা সময়ের মধ্যে যদি পাঁচ ছয় সাত বার শিক্ষক খাতা চেয়ে তথ্য মিলিয়ে সই করেন, এত বড় সংখ্যা এতবার লিখতে হয়, তাহলে পরীক্ষার্থীদের মনঃসংযোগের ক্ষতি হয় না কি? এর পিছনে যতখানি সময় চলে যাচ্ছে তারই বা কী হবে? শিক্ষকরা যদি এতরকম সই আর ফর্ম ফিল আপে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে পরীক্ষার হলে প্রয়োজনীয় নজর রাখার কাজটাই বা তাঁরা কীভাবে ঠিক করে করবেন?

যথারীতি এরও কোনও উত্তর নেই পর্ষদের কারও কাছে। প্রথম দু-তিনদিনের পরীক্ষার পরই বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখা গেল প্রশ্নপত্রের খামে কোনও নম্বরই নেই। কাজেই যে নম্বর লেখার গুরুদায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর দেওয়া হল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, পর্ষদ নিজেই তা ঠিক করে পালন করেনি।

তবে, শ্রেষ্ঠ চমকটি দেখা গেল অঙ্ক পরীক্ষায়। বিগত বছরে অঙ্ক পরীক্ষার দিন কোনও গ্রাফ পেপার সরবরাহ করা হয়নি। তাহলে গ্রাফের অঙ্ক কীভাবে কোথায় করবে এই প্রশ্নের উত্তরে পর্ষদ থেকে বলা হয়েছিল, ছাত্রছাত্রীদেরই খাতায় ছক কেটে গ্রাফের অঙ্ক করতে হবে। আর এবার প্রশ্নের খাম খুলে দেখা গেল, প্রশ্নের সাথে গ্রাফ পেপার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রশ্নে গ্রাফের কোনও অঙ্কই নেই! পরীক্ষা সম্পর্কে কতদূর দায়সারা মনোভাব এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার বিভিন্ন স্তরে কতখানি সংযোগহীনতা থাকলে এমন প্রহসন ঘটতে পারে!

এখানেই শেষ নয়। এর পরেও আরও অদ্ভূত নির্দেশ এসেছে। ওই অপ্রয়োজনীয় গ্রাফ পেপারটি প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে দিতে হবে। তারা সেটিতে নাম ইত্যাদি লিখবে, খাতার সাথে জুড়ে দেবে এবং যথারীতি পরিদর্শক শিক্ষক আবার সেগুলো মিলিয়ে সই করবেন। অর্থাৎ, যে গ্রাফ কাগজটির সাথে পরীক্ষার কোনও সম্পর্কই নেই, সেটির পিছনেও পরীক্ষা চলাকালীন কিছুটা সময় দিতে বাধ্য হল পরীক্ষার্থীরা।

বিগত কিছু বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের ‘চেক’ করার নামে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রায় যুদ্ধকালীন পরিবেশ তৈরি করা, সরকারি স্কুলগুলোর পড়াশুনার পরিবেশ নষ্ট করে প্রাইভেট টিউশনে মদত দিয়ে আবার মাঝে মাঝে লোকদেখানো টিউশন নিষিদ্ধ করার নোটিশ জারি করা, কিছু কিছু বিষয়ের প্রশ্নপত্র প্রতি বছরই অনাবশ্যক কঠিন এবং জটিল করে তোলা– এসব প্রসঙ্গ না হয় বাদ দেওয়াই গেল। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ যারা, সেই সাধারণ শিক্ষকসমাজ, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী সকলের কাছেই এটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, যা হচ্ছে তাই মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া এই বিরাট কর্মকাণ্ডে তাঁদের কোনও ভূমিকা নেই। নেই মতপ্রকাশের অধিকারও। আর এই অধিকারহীন দায়িত্বের অপর প্রান্তে বসে আছেন সরকারি কর্তাব্যক্তিরা, যাঁরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত গাফিলতি করেও একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতে পারেন। একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে যেতে পারেন এবং সেসব সিদ্ধান্ত যতই হাস্যকর বা অসুবিধাজনক হোক, তাকেই ‘দায়িত্ব’ বলে অন্যের ওপর চাপিয়েও দিতে পারেন।

মাধ্যমিকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এই চূড়ান্ত অরাজকতা এবং অবিবেচনা শিক্ষাব্যবস্থার ঘুণধরা চেহারাটাই আরও স্পষ্ট করে তুলল।